পেনাল্টি স্পটে বল। বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা তারকা ফুটবলার কিলিয়ান এমবাপ্পে রয়েছেন দাঁড়িয়ে। প্যারিসের পার্ক দ্য প্রিন্সেসে খানিক নিরবতার মৃদু হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। রেফারি বাশি বাজালেন। এমবাপ্পের জোড়ালো শট। কিন্তু তা জালে জড়ায়নি।
পুরো স্টেডিয়াম জুড়ে একরাশ হতাশার দীর্ঘশ্বাস। না, এই পেনাল্টি থেকে গোল করতে না পারার পেছনে প্রতিপক্ষ আরবি লেইপিজের গোলরক্ষক পিটার গুলাসসি এর বিশেষ কোন কৃতিত্ব নেই। পুরোটাই এমবাপ্পের ভুল কিংবা স্নায়ুচাপের কারণে।
তবে সেই পেনাল্টি থেকে সম্ভবত গোল হতে পারতো। তাঁর সাথে হতে পারতো পিএসজি জার্সিতে লিওনেল মেসির প্রথম হ্যাট্রিক। হ্যা, মেসি নির্দ্বিধায় ম্যাচের অন্তিম মুহূর্তে নিজের হ্যাটট্রিক করার সুযোগটা হাতছাড়া করলেন। মিনিট সতেরো আগেই মেসি আরো একটি পেনাল্টি শট নিয়েছিলেন। বুদ্ধিদীপ্ত চিপ শটে গোলরক্ষককে বোকা বানিয়ে দলকে লিডও এনে দেন তিনি।
চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপ পর্বের তৃতীয় ম্যাচে প্যারিস সেইন্ট জার্মেই এর ঘরের মাঠে মুখোমুখি পিএসজি এবং জার্মান ক্লাব আরবি লেইপজিগ। এর আগে নিজেদের মাঠে ম্যানচেস্টার সিটিকে হারিয়ে বেশ চাঙ্গা মনোভাব নিয়েই খেলতে নামে পিএসজি।
তবে দলে ছিলেন না নেইমার। অন্যদিকে গ্রুপ পর্বের প্রথম দুই ম্যাচে হেরে কিছুটা ব্যাকফুটে থাকা লেইপজিগ ঘুরে দাড়াবার প্রত্যয় নিয়েই যেন এদিন নেমেছিল মাঠে। এর প্রতিফলন স্পষ্ট পরিলক্ষিত হয় ফুটবলের সবুজ গালিচায়।
তবে আধিপত্য বিস্তার করতে বিন্দুমাত্র কালক্ষেপণ করেনি মাউরিসিও পচেত্তিনোর শীর্ষরা। ম্যাচের নয় মিনিটের মাথায় প্রতিআক্রমণ থেকে বল পায় জুলিয়ান ড্রাক্সলার৷ সেই বল বাড়িয়ে দেন এমবাপ্পের উদ্দেশ্যে। অনেকটা ফাঁকা পেয়ে ক্ষিপ্রতার সাথে কিছুটা ছুটে গিয়ে গোলবারের বাম দিকের নিচের কোণা দিয়ে ম্যাচের এবং দলের প্রথম গোল আদায় করে নেন এমবাপ্পে।
তারপর আক্রমণ-প্রতিআক্রমণে ম্যাচ এগোতে থাকে। পিএসজি বলের দখল নিজেদের কাছে রেখে প্রভাব বিস্তারের ধারা অব্যাহত রাখতে থাকে। তবে স্রোতের বিপরীতে ম্যাচের ২৮ মিনিটে লেইপজিগে পর্তুগিজ ফরোয়ার্ড আন্দ্রে সিলভা গোল করে সমতা নিয়ে আসেন ম্যাচ। সেই সমতা নিয়েই দুই দল চলে যায় মধ্যবিরতিতে। বিরতি থেকে ফিরে খেলার ধারা আগের মতোই চলতে থাকে। বিচ্যুতি ঘটান লেইপিজের মিডফিল্ডার নর্দি মুকেলি। ৫৭ মিনিটে গোল করে দলকে এগিয়ে দেন এই ফরাসি খেলোয়াড়।
জয়ের আশায় হয়ত কিছুটা ভাটা পড়েছিল কিংবা জেগেছিল কিঞ্চিৎ শঙ্কা। কিন্তু দলে থাকা পৃথিবী নন্দিত খেলোয়াড় মেসি কি এত সহজেই হাল ছেড়ে দেবেন? না তা কি করে হয়। তিনি তাঁর পূর্ণ সামর্থ্য দিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন। সফলতাও এলো লেইপিজের দ্বিতীয় গোলের ঠিক মিনিট দশেক বাদে।
এমবাপ্পের রক্ষণ চেড়া দৌড় সেখান থেকে পেনাল্টি স্পটের সামনে মাইনাস করা বলে মেসির শট প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে হাত দিয়ে নিজের ডানদিকে ঠেলে দেন লেইপজিগগোলরক্ষক। কিন্তু তা বারপোস্টে লেগে গোললাইন বরাবর একপাশ থেকে আরেকপাশে অগ্রসর হওয়ার সময় তাতে আলতো ছোঁয়ায় গোল আদায় করে নেন দ্য গ্রেট লিওনেল মেসি।
কিন্তু তাঁর দ্বিতীয় গোলটি প্রমাণ করে তাঁর বুদ্ধিদীপ্ততা, তাঁর স্নায়ুচাপ সংবরণ করবার ক্ষমতা। ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট সেটাই। সমতা ফেরানোর সুযোগ কোনভাবেই বিফলে যেতে দেননি মেসি। দলের দ্বিতীয় গোলের পাঁচ মিনিটের মাথায় এমবাপ্পকে অবৈধভাবে ডি-বক্সের ভিতরে বাঁধা দেওয়ার ফলস্রুতিতে পেনাল্টি পায় পিএসজি।
সেই পেনাল্টি নেবার দায়িত্ব আসে অভিজ্ঞ মেসির কাঁধে। জয়সূচক গোল কিংবা জয়ের দাঁড় উন্মোচন। মেসি শান্তশিষ্ট, এক চিপ শটে পরাস্ত করলে প্রতিপক্ষ গোল রক্ষক গুলাসসিকে। এগিয়ে যায় পিএসজি।
নতুন ঘর, নতুন জার্সি, নতুন পতাকাতলে মেসির প্রথম হ্যাট্রিক সুযোগ। নিন্দুকদের নিন্দার জবাব, নিজেকে নতুন পরিচয়ে ছাড়িয়ে যাবার, রেকর্ড বইয়ে নতুন সংযোজনের হাতছানি, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর রেকর্ড ভেঙ্গে তাঁকেও ছাড়িয়ে যাবার সুযোগ। তার সাথে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ইতিহাসে প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে নবম হ্যাট্রিক করবার দাড়প্রান্তে দাঁড়িয়ে ম্যাচের বাকি ১৬ মিনিট যখন সবাই প্রত্যাশায় মেসির হ্যাট্রিকের, সুযোগ যেন আর হয়ে উঠলো না। কিন্তু ভাগ্য বিধাতা বরাবরই প্রসন্ন মেসির উপর। সুযোগ এনে দিলেন তাঁর পায়ের কাছে।
ম্যাচ তখন গড়িয়েছে ইনজুরি টাইমে। পিএসজি রাইটব্যাক আশরাফ হাকিমিকে ডি-বক্সের ভেতরে ফাউলের সুবাদে পেনাল্টি পেয়ে যায় পিএসজি। এইতো সুযোগ প্রতিদ্বন্দিকে ছাড়িয়ে যাবার। পুরো পার্ক দে প্রিন্সেস থেকে শুরু করে পৃথিবী জুড়ে থাকা মেসি ভক্তরা যখন বসে রয়েছেন মেসির রেকর্ড গড়া হ্যাট্রিকের আশায়।
তখন মেসি শোনালেন সাম্যের গান, মেসি দেখালেন ভ্রাতৃত্ব। শেষ মহুর্তের সেই পেনাল্টি নিতে তিনি উদ্বুদ্ধ করলেন কিলিয়ান এমবাপ্পেকে। কিন্তু আস্থার কিংবা ত্যাগের প্রতিদানে ব্যর্থ এমবাপ্পে। অপেক্ষার পালা দীর্ঘ হলো মেসি ভক্তদের। আরো একবার রোনালদোকে ছাপিয়ে যাবার সম্ভাবনার অপেক্ষা।
তবে কি এভাবে ত্যাগ-তিতিক্ষায় লিওনেল মেসি হয়ে ওঠেন সবার প্রিয়। জায়গা করে নেন দর্শক-সমর্থকদের মনের মণিকোঠায়। দিনশেষে বনে যান ‘দ্য কিং অব ফুটবল’ কিংবা তকমা জোটে ‘ভিনগ্রহের ফুটবলার’-এর।