কয়েকবছর আগে ইউরোপিয়ান জায়ান্ট বার্সেলোনা আর রিয়াল মাদ্রিদের দলবদলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল ফিফা। নিষেধাজ্ঞার কারণ অনেকের কাছেই অদ্ভুত ঠেকেছিল। বিশ্বের সেরা দুই ক্লাবের ওপর অভিযোগ ছিল নিয়ম বহির্ভূতভাবে আঠারো বছরের কম বয়সী খেলোয়াড়দের কেনা। সবার মনেই প্রশ্ন জেগেছিল, কম বয়সী খেলোয়াড় কেনার কারণে কেন দলকে দলবদল থেকে নিষিদ্ধ করা হবে?
নিজেদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার জন্য ১৮ বছরের কম বয়সী খেলোয়াড় কেনাও কি দোষের? না দোষের না, কিন্তু ফিফার এই অদ্ভুত নিয়মের পেছনে রয়েছে এক মহৎ উদ্যোগ। মডার্ন ফুটবল ট্র্যাফিকিং নামক এই নিয়ম প্রতিনিয়ত বাঁচিয়ে যাচ্ছে লাখো আফ্রিকান শিশু-কিশোরের প্রাণ।
একসময় বিশ্বজুড়ে প্রচলিত ছিল দাসপ্রথা। আফ্রিকা থেকে স্বল্পমূল্যে কিংবা কোনো মুল্য ছাড়াই ক্রীতদাস কিনে আনতো তাদের মালিকেরা। তাদের কাজে লাগানো হতো বিভিন্ন কাজে। সেই ক্রীতদাসপ্রথা এক হাতে নির্মূল করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান আব্রাহাম লিংকন। আমেরিকার হাত ধরে পরে বিভিন্ন দেশ থেকে আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হতে থাকে দাসপ্রথা। এখন আর পৃথিবীতে প্রচলিত দাসপ্রথা নেই বললেই চলে।
প্রায় শত বছর পার হয়ে গেলো আফ্রিকার অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটেনি বিন্দুমাত্র। প্রতিটি ঘরে দারিদ্রতা, নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা একেক জনের। একবেলা খেয়ে, আরেকবেলা আধপেটা থেকেই তাদের জীবন কাটে। তাদের ছোট জীবন, ছোট আশা নিয়েই কাটে জীবন। কিন্তু দাসপ্রথা লুপ্ত হলে কী হবে, ইউরোপের রেঁনেসার তো আর পরিবর্তন হয়নি। এখনও কল-কারখানার কাজে এখনও প্রয়োজন লোকবল।
আর এই লোকবলের জন্য সবসময়ই সবার আকর্ষণ, আফ্রিকা আর দক্ষিণ আমেরিকান জনগোষ্ঠী। আড়ালে আবডালে কম পয়সায় লোক জোটাতে কেই-বা না চায়? কিন্তু আফ্রিকা থেকে এতো মানুষ, আরো স্পষ্ট করে বললে টিন-এজার আনার উপায় কী?
সেই নতুন পথ কিংবা অস্ত্র হয়ে এসেছে ফুটবল। অবাক হতে পারেন, কিন্তু এটাই সত্যি। যে ফুটবল আনন্দে ভাসায়, মুখে এনে দেয় এক চিলতে হাসি; সে ফুটবলই হয়ে উঠেছে পুরনো সে জঘন্য প্রথার গোপন অস্ত্র। এক দল লোক এই ফুটবলকে ব্যবহার করছে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য। আফ্রিকার দারিদ্রতার সুযোগ নিয়ে তাদের কম বেতনে বেশি খাটানোর ইচ্ছে কমেনি লোভীদের। তাই এখনও আফ্রিকা থেকে অবৈধ উপায়ে লোকজন আনার পথটা হয় ফুটবল।
২০০৭ সাল, টেরিনফে সমুদ্র সৈকত, সময়টা গ্রীষ্মকাল। ভরা সমুদ্রসৈকতে অনেকেই ব্যস্ত সান-বাথে, কেউ নিজের প্রেয়সী বাচ্চা-কাচ্চার সাথে আনন্দে ব্যস্ত। এরমধ্যেই মধ্য সাগর থেকে একদল লোক এসে পরলেন সমুদ্র সৈকতে। এক নৌকাভর্তি আফ্রিকান মাইগ্রেন্টদের দেখা মিলল সেখানে। ১৪ থেকে ১৭ বছর বয়সী ১৫ জনের একটা দল এসে পরলো একদম সমুদ্র সৈকতের মাঝে।
খাদ্য, পানির অভাবে ক্লান্ত সেই বাচ্চাদের কোনোভাবে কথা বলানোর মতো অবস্থায় নিয়ে যেতেই জানা গেল তাদের আসল উদ্দেশ্য। সমুদ্র পাড়ি দিয়ে স্পেন আসার উদ্দেশ্য? ফুটবল ক্লাবে ট্রায়াল দেওয়া। দলও যে সে দল নয়, একেবারে ফার্স্ট ডিভিশন দল টেরিনফে, মায়োর্কা ও রিয়াল মাদ্রিদ। অথচ তাদের কারো কাছেই নেই কোনো আসল কাগজপত্র কিংবা কোনো প্রমাণ।
শুধুমাত্র লোকের কথায় বিশ্বাস করে আফ্রিকা ছেড়ে স্পেনের পথে পা বাড়িয়েছে তারা। এ তো মাত্র একটি ছোট্ট ঘটনা। এরকম হাজারো ছোট ছোট ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে স্পেন, ফ্রান্স, ইতালির সমুদ্র সৈকতে।
আফ্রিকার দারিদ্রপীড়িত অঞ্চলে বেড়ে উঠা ছোট ছোট বাচ্চাদের স্বপ্ন থাকে ফুটবলকে ঘিরে। তারা ঘুমাতে যায় বল পায়ে বিশ্ব জয়ের স্বপ্ন বুনতে বুনতে। কেউ স্বপ্ন দেখে দিদিয়ের দ্রগবার মতো বিশ্ব জয় করবার, কেউবা স্বপ্ন দেখে ইয়াইয়া তোরের মতো মাঝমাঠ সামলানোর। তাদের সামনে দেবদূতের মতো হাজির হয় এজেন্টরা। খেলার প্রশংসা করে মনে প্রবেশ করায় ছোট্ট স্বপ্নগুলো, স্বপ্ন দেখায় ফুটবল ক্লাবে হাতেখড়ি করানোর।
সুযোগ দিতে চায় ইউরোপে বড় ক্লাবে ট্রায়াল দেওয়ার। স্বপ্ন পূরণের এতো বড় সুযোগ হারাতে চায় না কোন পরিবারই। এ তো শুধ স্বপন পূরণ নয়, বরং কোনোমতের ইউরোপের কোনো ক্লাবে খেলতে পারলেই তো পুরো জীবনের জন্য সেটেল হয়ে যাওয়া। হাতছোঁয়া দূরত্বে স্বপ্ন দেখে অনেককিছু না ভেবেই হাত বাড়ায় তারা। নিজেদের প্রাণপ্রিয় সন্তানকে তুলে দেয় এজেন্টদের হাতে।
এই এজেন্টরাই মূল ফাঁদ। নামেই তার ফুটবল এজেন্ট, অথচ তাদের সাথে না আছে কোনো ক্লাবের সম্পর্ক, না ফুটবলের। তাদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ থেকে কলকারখানার মালিকদের। বাবা-মায়ের হাতে নামেমাত্র কিছু টাকা দিয়ে তাদের সন্তানকে উঠিয়ে দেয় ইউরোপের নৌকায়। দিন যায়, মাস যায়, অবশেষে দৃশ্যমান হয় ইউরোপ। কিন্তু ইউরোপে এসেই বুঝতে পারে, কোন ফাঁদে পা দিয়েছে তারা।
এ পথ খোলা মাঠের নয়, বরং বদ্ধ কারখানার। এখানে এসে পায়ে ফুটবল নেওয়া সম্ভব নয়, বরং হাতে-পায়ে ঠেলে করতে হয় অবর্ণনীয় পরিশ্রম। এসব কলকারখানার মালিক, শিল্পপতিরাও এই মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত প্রত্যক্ষভাবে। বড় বড় শিল্পপতিদের কোন না কোন ক্লাবের সঙ্গে উঠাবসা থাকেই। তাকা দিলেই যেখানে ক্লাবের সোশিও হয়ে যাওয়া সম্ভব, সেখানে কাগজপত্র তৈরি করতেও তেমন সমস্যা হয় না। আর একবার ক্লাবের একটা অংশ বা গভর্নিং বডিতে প্রবেশ করতে পারলেই হয়।
আসলের মত দেখতে ভুয়া কাগজপত্র বের করতে আর কতক্ষণ? সেই কাগজপত্র দেখিয়েই আফ্রিকা থেকে ইউরোপে টেনে আনে হাজার হাজার শিশুকে। তারপর নামে মাত্র পয়সায়, কোনো কোনো জায়গায় আবার খাবারের বিনিময়েও কাজ করিয়ে নেয় তারা। পুলিশের কাছেও যাওয়ার জো নেই তাদের। না জানে ভাষা, না চেনা তাদের পথঘাট। এমনকি নেই কোনো কাগজপত্র।
পুলিশের কাছে গেলে আগে স্থান হবে জেলখানা। তাই সেখানে যাওয়ার থেকে কারখানার জীবনকেই শান্তির মনে হয় তাদের। ইট-পাথরের মাথে শৈশবে বেড়ে উঠা বসন্তের সবুজ পাতার মতন জেগে উঠা ফুটবলের স্বপ্ন ঝড়ে যায় ফুটবার আগেই, শীতের মৃত পাতার মতো।
২০০৫ থেকে ২০১৪, এই ৯ বছরে ফ্রান্সের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেওয়া ৭ হাজার আফ্রিকান শিশুর খোঁজ মেলেনি এখনও। কেউ জানেইনা কি ঘটেছে সেসব দূর্ভাগা শিশুর কপালে। এমনকি তাঁদেরকে নিয়ে আসা অনেক নামধারী এজেন্টদের ধরা হলেও কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
‘এজেন্ট’রা শুধু তাদের নৌকায় উঠিয়ে দিয়েই খালাস। এরপর আর তাদের খোঁজ-খবর থাকে না তাদের কাছে। অবাক হলেও সত্যি এটাই যে ফুটবলের স্বপ্ন নিয়ে ইউরোপে পাড়ি জমানো শিশুদের ভাগ্য ফুটবলে নয়, হারিয়ে গিয়েছে কালে গহ্বরে। তাদের খোঁজ পায়নি তাদের আত্মীয়-স্বজন কিংবা মাতা-পিতাও। বড় বড় ক্লাবের নাম দিয়ে বাবা-মায়ের কাছ থেকে নিয়ে আসা এসব শিশুদের আদৌ চিনেও না এসব ক্লাব।
এ পরিসংখ্যান নিয়ে ঘাটাঘাটি চলছিল অনেক বছর ধরেই, প্রকাশ্যে নানাভাবে কথাবার্তাও বলেছেন অনেক খেলোয়াড়। চোখ এড়ায়নি ফুটবলের নীতি-প্রণেতা ফিফার। ফিফা তড়িৎ সিদ্ধান্ত নেয়, অবিলম্বে এই শিশুদের ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে হবে। আর যেন কোন শিশু ফুটবলের স্বপ্ন বুকে নিয়ে অকালে হারিয়ে না যায়। মায়ের কোল থকে ফুটবলের নাম দিয়ে যেন কেউ শিশুদের ছিনিয়ে না আনতে পারে।
‘মোর দ্যান আ গেম’ স্লোগান নিয়ে শুরু হওয়া ফুটবলের মান রক্ষার জন্য দলবদলের উপর নতুন আইনের সূচনা করে ফিফা। আইনের নাম ‘মডার্ন ফুটবল ট্র্যাফিকিং’। বর্তমানে ফিফা আর্টিকেল ১৯ অনুযায়ী কোন ১৮ বছরের নিচে কিশোর ফুটবলারকে সরাসরি কোনো ক্লাব কিনতে পারবে না।
তার জন্য কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি ফিফাকে। অনুর্ধ্ব-১৮ খেলোয়াড়দের কিনেই অনেক দল নিজেদের ক্লাব স্ট্রাকচার গঠন করে। কম বয়সী তারকাদের ট্যালেন্ট দেখে মুগ্ধ হয়ে টাকার বস্তা নিয়ে আসে বড় দলেরা, আর সেখান থেকেই নিজেদের ক্লাব সামলায় বিভিন্ন দল। ইউরোপে সেলিং ক্লাব হিসেবেই যাদের পরিচিতি বেশি। তাদের মাথ্যায় যেন আকাশ ভেঙে পরলো।
অনেক দলই বাধ সাধে এই নিয়মের। যে কারণে আরো কিছু নিয়ম অন্তর্ভুক্ত করে ফিফা। নিয়ম অনুযায়ী তরুণ খেলোয়াড়ের সঙ্গে যদি তাঁর পরিবার কিংবা পরিবারের কোনো সদস্যকে সে দেশে নিয়ে আনা হয়, তবেই খেলোয়াড়কে কেনা যাবে। এই নিয়ম শুধুমাত্র ইউরোপের বাইরের ক্লাবের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। ইউরোপের ভেতরের ক্লাবগুলোর ক্ষেত্রে কিছুটা শিথিলতা বিদ্যমান।
ইইউ অর্থাৎ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশের খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রে ক্লাবের সঙ্গে চুক্তি করেই কেনা যাবে খেলোয়াড়কে। তবে খেলোয়াড়ের পড়াশোনা ও ফুটবল ট্রেনিংয়ের যথেষ্ট ব্যবস্থা করতে হবে। এবং তার ট্রান্সফাররের সকল কাগজপত্র জমা দিতে হবে ফিফার কাছে। এই নিয়মে কোনো আফ্রিকান কবা এশিয়ান খেলোয়াড় কেনা সম্ভব হবে না আর।
এই নিয়মের ফলে অনেকাংশেই রোধ করা সম্ভব হয়েছে হিউম্যান ট্র্যাফিকিং। আফ্রিকা থেকে নিয়ম বহির্ভুতভাবে খেলোয়াড় কিনতে পারে না কেউ। এমনকি ক্লাবের আসল এজেন্ট নিজেদের সম্পূর্ণ আসল কাগজপত্র দেখালেও সম্ভব নয় খেলোয়াড়ের দলবদল। যে কারণে অনেকটা কমে এসেছে এই নিয়মবহির্ভূত কেনাকাটা।
তবে রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনার মতো দল কম বয়সী খেলোয়াড় নিয়মবহির্ভূতভাবে কিনে ইতোমধ্যে দলবদল থেকে নিষিদ্ধ হয়েছে। রিয়ালের যুব তারকা তাকেফুসো কুবোকে নিয়ম বহির্ভূতভাবে কিনে শাস্তি পেয়েছিল বার্সেলোনা। যে কারণে তাকে আবারও জাপানে ফেরত পাঠিয়েছিল ফিফা। সেখান থেকে বার্সার চোখের সামনে থেকে কিনে আনে রিয়াল। সেটাও ঠিক নিয়মের ফাঁক-ফোকর গলিয়ে। ফাঁকটা হলো ১৮ বছর বয়স।
একজন খেলোয়াড়ের বয়স আঠারো বছর হলেই তাঁকে এক ক্লাব থেকে অন্য ক্লাবে কেনা সম্ভব। যে কারণে ১৮ বছর হওয়ার আগেই খেলোয়াড়দের সাথে চুক্তি করে রাখে বড় দলগুলো। যাতে ১৮ বছর হওয়ার সাথে সাথেই দলে চলে আসতে পারে সেই তারকা। রিয়ালের অ্যাটাকের মূল দুই স্তম্ভ ভিনিসিয়াস জুনিয়র আর রদ্রিগোও রিয়ালে এসেছে এই নিয়মের অধীনেই।
যখন এই আর্টিকেলটি পড়ছেন, তখনও হয়তো আফ্রিকার কোন এক কোনে কোন এক এজেন্ট স্বপ্ন দেখাচ্ছে কোন তরুণকে; বার্সেলোনার জার্সি গায়ে বিশ্বজয় করবার। কেউ একজন বিশাল ফাঁদ ফেলছে তরুণকে। নিয়মের বেড়াজালে হয়তো দলগুলোকে আটকানো গিয়েছে, বাড়ানো গিয়েছে সতর্কতা; কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ হয়নি এই ঘৃণ্য কাজ। ফুটবল ফিরে পাক সেই সৌন্দর্য্য, আর কেউকে না হারাতে হোক ফুটবলের স্বপ্ন নিয়ে অকালে।