‘মনে হয়েছিল, টেস্টটা আমরা জিততেও পারি’

‘একটা সময় তো মনে হয়েছিল, এই টেস্টটা আমরা জিততেও পারি। আমরা ৪০০ রান করলাম। পরে ওদের ২০০ রানেরও কমে ৭ উইকেট পড়ে গেলো মনে হয়। ওখান থেকে আমরা কোচরা, খেলোয়াড়রা আর খেলায় নিজেদের ইনভলব রাখতে পারিনি। ড্রেসিংরুমে কর্মকর্তারা চলে এসেছিলেন। আসলে যেটা করা দরকার ছিলো, তা আমরা পারিনি।’

বাংলাদেশের টেস্ট শুরুর গল্পটা শুনতে চান? জানতে চান সেই সময়ের প্রস্তুতির কথা? জানতে চান এই ২০ বছরেও কেনো টেস্ট ক্রিকেট পায়ের নিচে মাটি পেলো না?

এসব কথা বলার সেরা মানুষ হলেন দেশের অভিজ্ঞতম কোচ এবং প্রথম টেস্টের জাতীয় দলের কোচ সারোয়ার ইমরান। খেলা-৭১ এর সাথে একান্ত আলাপে দেশের টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে মন খুলে কথা বলেছেন এই ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ।

শুরু থেকে শুরু করা যাক। প্রথম টেস্টে তো হুট করে প্রধান কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেন।

না, ঠিক হুট করে বলা যাবে না। জাতীয় দলে তো আগে পরেও কাজ করেছি। টেস্টে দায়িত্ব পালন করার আগেই আমাকে কয়েকটা সিরিজে কাজ করতে হয়েছিলো। ২০০০ সালের এপ্রিল মাসে আবাহনী প্রিমিয়ার লিগ চ্যাম্পিয়ন হলো। প্রায় ওই সময়ই এডি বারলো অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন এশিয়া কাপের জন্য আমাকে বাংলাদেশ দলের কোচ ঘোষনা করা হলো। মে মাসে দেশেই হলো টুর্নামেন্টটা। এশিয়া কাপে অনেকদিন পর বাংলাদেশ দল আড়াই শ পার করা একটা স্কোর করেছিলো। এরপর নাইরোবিতে আমরা আইসিসির নক আউট টুর্নামেন্ট খেলতে গেলাম। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলে ফিরে এসেছিলাম।

তখন কী আপনাকে টেস্ট অবধি দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া হলো?

না। নাইরোবি থেকে ফেরার পর আবার আলোচনা হতে থাকলো, কে কোচ হবে। তখন প্রতি সিরিজের আগে এভাবে আলোচনা চলছিলো। অক্টোবরে আমরা ফিরলাম। পরপর জানলাম, আমি টেস্টেও দায়িত্ব পালন করবো।

আপনার কোচিং দল কেমন ছিলো?

কোচিং দল বলতে আমি ছিলাম। আর আমার সাথে একজন ফিজিও ছিলো।

কোনো স্পেশালিস্ট কোচ ছিলো না?

না। কোনো ডিপার্টমেন্টের জন্য আলাদাভাবে সেরকম কেউ ছিলো না।

আপনাদের প্রস্তুতিটা কেমন ছিলো?

আমরা তখন ব্যাটসম্যানদের বলছিলাম, যত বেশি বল খেলতো পারো। কে কতো বল খেলতে পারে, সেটা ছিলো প্রস্তুতি। আমাদের ইচ্ছে ছিলো সেশন বাই সেশন এরকম খেলতে পারলে যদি টেস্টটা ড্র করা যায়।

অভিষেক টেস্টের কোচ ও অধিনায়ক

এডি বারলোর ওই সময় ভূমিকাটা কী ছিলো?

আমি ওনাকে সুস্থ অবস্থায় তো খুব বেশি পাইনি। হ্যা, সুস্থ থাকতে কয়েকটা সিরিজে মনে হয় কাজ করেছিলাম। কিন্তু টেস্টের আগে ওই সময়টা উনি একেবারেই হুইল চেয়ারে ছিলেন। মাঝে মাঝে টিম মিটিংয়ে কথা বলতেন। তাও কষ্ট হতো।

শুরুটা তো আপনাদের মন মতোই হয়েছিলো।

হ্যা, প্রথম ইনিংসটা আমরা যেমন আশা করেছিলাম, তার চেয়েও ভালো হয়েছিলো। একটা সময় তো মনে হয়েছিল, এই টেস্টটা আমরা জিততেও পারি। আমরা ৪০০ রান করলাম। পরে ওদের ২০০ রানেরও কমে ৭ উইকেট পড়ে গেলো মনে হয়। ওখান থেকে আমরা কোচরা, খেলোয়াড়রা আর খেলায় নিজেদের ইনভলব রাখতে পারিনি। ড্রেসিংরুমে কর্মকর্তারা চলে এসেছিলেন। আসলে যেটা করা দরকার ছিলো, তা আমরা পারিনি।

আবেগে ভেসে গিয়েছিলেন?

বলা যেতে পারে। আমরা নিজেদের নিয়ন্ত্রন করতে পারিনি। এটা আমাদের জন্য একটা বড় শিক্ষা ছিলো। টেস্ট যে কিভাবে খেলতে হয়, সেটা বুঝতে পেরেছিলাম।

আমরা শুনেছি, ড্রেসিংরুমের পরিবেশটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো তৃতীয় দিন থেকে। এটা কী সত্যি?

অনেকটা। আমি বলতে পারি, আমরা ড্রেসিংরুমের ওপর কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলেছিলাম; নিয়ন্ত্রনটা আমাদের হাতে ছিলো না। আমাদের যে টেকনিক্যাল ও মানসিক ফোকাস থাকা দরকার ছিলো, তা আমরা রাখতে পারিনি। সে জন্য অনেক কারণ ছিলো।

ইমরান ভাই, আবার প্রস্তুতিপর্বে একটু ফিরি। আমরা তো তখন মূলত লিমিটেড ওভার ক্রিকেট খেলি। সেখানে আপনি টেস্টের জন্য আসলে টিমকে বিশেষ কী ট্রেনিং করাচ্ছিলেন?

না, সেরকম বিশেষায়িত কোনো ট্রেনিং আমরা করাতে পারিনি। আমাদের তো কোচ বা খেলোয়াড়, কারোরই টেস্ট বা পাচ দিনের খেলা নিয়ে কোনো ধারণা ছিলো না। আমরা তখনো মনে হয় চার দিনের ম্যাচই খুব একটা খেলিনি। তিন দিনের ম্যাচ খেলতাম। তিন দিন থেকে এভাবে পাঁচ দিনের খেলায় হঠাৎ চলে যাওয়াটা মোটেও সোজা ব্যাপার ছিলো না। তারপরও প্রথম ইনিংসে কিন্তু আমরা ব্যাপারটা ভালো করতে পেরেছিলাম।

 

মানে, ওই সামান্য প্রস্তুতি নিয়ে একটা শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলা?

হ্যা, বুলবুলের (আমিনুল ইসলাম) কথা ধরুন। সে অসাধারণ একটা ইনিংস খেললো। হাবিবুল বাশার সুমনও দারুন ইনিংস খেললো। আকরাম খানের ব্যাটিং বা নাঈমুর রহমান দূর্জয়ের বোলিংও খুব ভালো ছিলো। এটা সত্যি যে, টেস্টের জন্য যে প্র্যাকটিস করার দরকার ছিলো, সেটা করতে পারিনি। তারপরও খেলোয়াড়রা চেষ্টা করেছিলো। এটা ঠিক পুরো পাঁচ দিন ধরে আমরা টেস্ট মেজাজে থাকতে পারিনি। সত্যি কথা বলতে, এখন পর্য়ন্ত আমরা টেস্টে সেই ক্রিকেটটা খুব বেশি খেলতে পারিনি।

এই পয়েন্টটায় আসতে চাচ্ছিলাম। ২০ বছর ধরে তো খুব কাছ থেকেই দেশের ক্রিকেট দেখছেন। দুই দশকে যতটা এগোনো উচিত ছিলো, আমাদের টেস্ট ক্রিকেট কী তা এগোতে পেরেছে?

(হাসি) দুই দশক এগোনো! এটা তো আপনারা ভালো বলতে পারবেন। হ্যা, আমরা এগোতে পারতাম। যা উচিত ছিলো, তা সম্ভবত হয়নি। আমরা ফাস্ট বোলার প্রডিউস করতে পারিনি। ব্যাটসম্যান কিছু তৈরী হয়েছে। তারও টেম্পারেমেন্টের জায়গায় টেস্ট মাসের ক’জন, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এক শ রান করার পরও যে নিজেকে ঠান্ডা রাখা, আরও এগোনো; টেস্টের এই বৈশিষ্ট্যগুলো এসেছে কি না, সন্দেহ। ওভারঅল বললে অতোটা এগোতে পারিনি।

এর কারণ কী?

কারণ ঘরোয়া ক্রিকেটে। আমরা টি-টোয়েন্টি ও ওয়ানডের জন্য অনেক কিছু করছি। কিন্তু লংগার ভার্শন ম্যাচ নিয়ে তো কারো আগ্রহ দেখি না। ঢাকার বাইরে ম্যাচ হলে আমি তো আপনাদের সাংবাদিকদেরও দেখি না। খেলোয়াড়দের বাইরে মাঠে থাকেন কোচ আর কর্মকর্তারা; কয়েক জন পুলিশ থাকেন। দু’চার জন দর্শকও আসে না। তার মানে, এই ফরম্যাটটার প্রতি আমরা আকর্ষণই তৈরি করতে পারিনি।

সেই সোনালী দিন

উইকেটও তো একটা সমস্যা?

অবশ্যই। উইকেটে বোলারদের জন্য কিছু থাকে না। এখানে যারা এক জায়গায় বল ফেলতে পারে, তারা সার্ভাইব করে যায়। এই ধরণের উইকেট হলে বোলারদের তো নিজেদের কাজের প্রতি প্রেরণা থাকে না। শুধু ফাস্ট বোলিংয়ের কথা বলছি না। ভালো স্পিনারও কিন্তু তৈরি হচ্ছে না। লঙ্গার ভার্শন খেলতে যেরকম স্পিনার দরকার, তা কোথায়!

একটা কথা বলা হয় যে, খেলোয়াড়দেরও লংগার ভার্শন খেলার আগ্রহ কম। এটার কারণ কী, টাকা কম পায় বলে?

টাকাই সব না। কিন্তু টাকাটা একটা ব্যাপার। লংগার ভার্শন খেলাটা তো কষ্টের ব্যাপার। ফলে তাদের ওই খেলাটার জন্য ভালো আকর্ষন থাকতে হবে। একটা তুলনা করেন। প্রিমিয়ার লিগে একটা খেলোয়াড় ১৬টা ম্যাচ খেলে, মানে ১৬ দিন মাঠে কাটিয়ে ৫০-৬০ লাখ টাকা আয় করে ফেলছে। সেখানে লঙ্গার ভার্শন খেলতে ২৪ দিন মাঠে থাকার বিনিময়ে কয় টাকা পাচ্ছে? ৫০ হাজার টাকা ম্যাচ ফি পাচ্ছে। ফলে লঙ্গার ভার্শনের প্রতি আগ্রহ যে কমে যাবে, সেটাই স্বাভাবিক। এখানে তো আসলে টাকা বা প্রনোদনা কোনোটাই পাচ্ছে না।

অবকাঠামোর দিক থেকে তো আমরা অনেক এগিয়েছি। এখন জিম আছে, প্রতিটা বিভাগে আলাদা আলাদা কোচ আছে, কম্পিউটার অ্যানালিস্ট আছে…

এটাকে আমি সেই অর্থে আমুল পরিবর্তন বলবো না। ফ্যাসিলিটিজটা তো শুধু মিরপুরে আছে, জাতীয় দলের জন্য আছে। এটা তো সারা দেশে ছড়ানো নেই। শত শত খেলোয়াড়ের জন্য নেই। ফলে এটাকে আমি অপ্রতুলই বলবো।

ব্যক্তিগত প্রতিভার দিক থেকে আমরা অনেক এগিয়েছি মনে হয়?

বুলবুল তখন ইনডিভিজুয়াল ব্রিলিয়ান্ট ছিলো। এখন সাকিব আছে, তামিম, মুশফিক, লিটন আছে। এই ব্যক্তিগত পারফরমার দিয়ে আপনি উন্নতি বিচার করতে পারবেন না। আমাদের দেখতে হবে সামগ্রিক ভাবে ক্রিকেট কাঠামোর উন্নতি হয়েছে কি না।

আপনি একজন স্পেশালিস্ট ফাস্ট বোলিং কোচ। সে জায়গা থেকে একটু বলেন যে, এই ২০ বছরে আমরা একটাও স্পেশালিস্ট টেস্ট বোলার পেলাম না কেনো? আমরা কী টেস্টের ফাস্ট বোলার তৈরীর জন্য যথেষ্ঠ কাজ করেছি?

অনেক কিছু করা দরকার। অবশ্যই করা দরকার। এই যে আজকে যাদের আপনি ভালো করতে দেখছেন; রুবেল, তাসকিন, আল আমিন; এদের নিয়ে কিন্তু আমাদের একটা ফাস্ট বোলিং অ্যাকাডেমি ছিলো। যদিও আমাদের কোনো অফিস ছিলো না। তারপরও এদের নিয়ে আমরা কিছু সেশন করেছি। আপনি বাকী টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর দিকে দেখেন, তাদের প্রতিটা স্টেটে দারুন পেস বোলিং অ্যাকাডেমি আছে। আমাদের তো কিচ্ছু নেই। আমরা অনেকবার বলেছি, ১২-২৪টা পেসার নিয়ে সারা বছর একটা অ্যাকাডেমি করা হোক। করবো, করবো করে করা হয়নি। ২০০৬ থেকে ২০০৯ সালে কিছুটা কাজ হয়েছে। তার ফলে কয়েক জন ফাস্ট বোলার বেরিয়েছে। রুবেল, আল আমিনরা ওখান থেকেই বেরিয়েছে। সব ধরণের সুবিধা না থাকা স্বত্তেও আমরা কিছু প্রোডাকশন পেয়েছিলাম। সেই সব কাজ এখন আর নেই।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...