আশাহতের উপাখ্যান

সুযোগ দেয়া হয়েছে অনেককে। ধারাবাহিকতা রাখতে পারেনি অধিকাংশই। তরুণ দল, সম্ভাবনাময়ী দল এই শব্দযুগল গুলো শুনতে শুনতে আমাদের পরে আরো দুটো দল ক্রিকেটের কুলীন পরিবারে যোগ দিয়েছে। এখন কখনও মানের প্রশ্ন এসে যায় তাদের সাথে তুলনাতেও। অথচ ক্রিকেটকে ঘিরে উন্মাদনা ছিল ও আছে এদেশে সব সময়েই। তবে কেন আমরা পেরে উঠছি না?

হাঁটি হাঁটি পা পা করে বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটকাল পৌছালো ২০ বছরে। সংখ্যাটা বিশাল, দুটো দশক। সেই ২০০০ এর ১০ নভেম্বরের সকালে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে নাইমুর রহমান দুর্জয় যখন সৌরভ গাঙ্গুলির সাথে টস করতে নামছিলেন, হলফ করে বলতে পারি এ দেশের সিংহভাগ মানুষই তখন টেস্ট ক্রিকেটের অ আ ক খ শেখেনি। কিন্তু আসল ক্রিকেট যে টেস্ট ক্রিকেট সেটা জানা ছিল কম বেশি সকলের।

সকালের সেশনে মেহরাব হোসেন অপি আর শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুতের ব্যাটে এক প্রকারে রোমাঞ্চ অনুভূত হচ্ছিল, হাবিবুল বাশারের উদ্ধত ৫০ আমাদের সাহসী করে তুলছিল। দুপুরের পর থেকে আমিনুল ইসলাম বুলবুলের ব্যাট আমাদের যে স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছিল তা আরও বেগ পায় অধিনায়ক দুর্জয়ের আগ্রাসী স্পিন জাদুতে। এমন কি মনের মধ্যে এক অসম্ভব সম্ভাবনা উঁকি দেয় আমরা কী তবে জয় করতে এসেছি এই মাধ্যম?

কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসই আমাদের কে মাটিতে ফিরিয়ে আনে। বাস্তবতাটা বুঝিয়ে দেয়। প্রথম টেস্ট ম্যাচের সেই যে দোলাচল, অনেক ভাল থেকে অনেক খারাপে নেমে আসার ধারা সেটাই যেন আমাদের গোটা টেস্ট ক্যারিয়ারে স্থান করে নিয়েছে। এজন্য ২০ বছর শেষ হলেও আমাদের অর্জনের খাতা প্রায়ই খালি। পূর্ণ শক্তির বিরূদ্ধে এখনও আমাদের মাথা কিছুক্ষণ উঁচু হলেও পরক্ষণে নিজেদের ভুল আবারও পিছিয়ে পড়ি।

আমাদের ২০ উইকেট নেবার মত আক্রমণ ভাগ তৈরি নয়। গেল বছর লজ্জাজনক ভাবে নিজেদের মাটিতে হেরেছি নবাগত আফগানদের স্পিন। আমাদের সফলতা এই মাধ্যমে অনেকটাই ব্যক্তিগত অর্জন নির্ভর হয়ে আছে  । সিংহলিজ মাঠে আশরাফুলের সেঞ্চুরি, সাকিবের সেরা অলরাউন্ডার হয়ে কাটানো দিন, মাস, বছর, কিছু হ্যাটট্রিক, তামিমের দুর্বিনীত কিছু সেঞ্চুর্‌ ঘরের মাঠে মুমিনুলের ব্যাটে হাসি, খর্বশক্তির ওয়েস্ট ইন্ডিজ বা জিম্বাবুয়ের সাথে পাওয়া দাপুটে জয় আর সময় সময়ে আমাদের স্পিনার দের কিছু ভয়ংকর স্পেলের বাইরে দল হয়ে ওঠা তাই আমাদের হয়েও হয় নি।

১১৯ টি টেস্ট খেলেছি আমরা এই ২০ বছরে, যার মধ্যে জয় মাত্র ১৪ টি ( যার মাঝে সর্বোচ্চ ৭ বার জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে), অমীমাংসিত ছিল ১৬ টি ম্যাচ, আর পরাস্ত হয়েছি ৮৯ টি ম্যাচে। পাঁচটি দেশের বিপক্ষে এখনো কোন ম্যাচ জেতা হয়নি। ইনিংস ব্যবধানে হারের দিক থেকে আছি লজ্জাজনক রেকর্ডের সামনে।

আমাদের বাঁধাগুলো কোথায়?

দলে সুযোগ দেয়া হয়েছে অনেককে । প্রতি টেস্ট সিরিজে ১-২ জন করে অভিষেক ঘটানো দল টার নাম বাংলাদেশ। কেউ টি২০ তে ভাল করুক আর ওডিয়াই তে, তাকে কিছুদিনের মাঝেই আমরা টেস্ট ক্রিকেটে নামিয়ে দিচ্ছি । প্রতিষ্ঠিত পরাশক্তিগুলোতে যেমন অন্তত ১৫-২০ টা ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ খেলে টেস্টে অভিষেক হয় একজন খেলোয়াড়ের, আমাদের বেলায় একজন ক্রিকেটারের প্রথম ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচই থাকে টেস্ট ম্যাচ।

যে কারণে এক দু ইনিংসে একটা ফিফটি কিংবা ৩-৪ উইকেটের পর  ধারাবাহিকতা রাখতে পারেনি অধিকাংশই। তরুণ দল, সম্ভাবনাময়ী দল এই শব্দযুগল গুলো শুনতে শুনতে আমাদের পরে আরো দুটো দল ক্রিকেটের কুলীন পরিবারে যোগ দিয়েছে। এখন কখনও মানের প্রশ্ন এসে যায় তাদের সাথে তুলনাতেও। অথচ ক্রিকেট কে ঘিরে উন্মাদনা ছিল ও আছে এদেশে সব সময়েই। তবে কেন আমরা পেরে উঠছি না?

এই দায় হয়ত ভাগ হয়ে যাবে খেলোয়াড়দের ও কর্মকর্তাদের মাঝে। আমরা কি সঠিক পথে হেটেছি? কিছু প্রশ্ন রেখে যাওয়া যাক।

  • আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ক্রিকেট ভেন্যুর সংখ্যা আমাদের আটটি, তবু ক্রিকেটকে আমরা কেন কেবল ঢাকা র মাঝেই বন্দী রেখেছি? কেন তৃণমূল পর্যায় থেকে প্রতিভা অন্বেষণ কার্যক্রম গুলো কে নিয়মিত চালাতে পারি নি ?স্থানীয় পর্যায়ে কোচদের নিয়ে আলাদা কোন কার্যক্রম চোখে পড়েছে কি? কেবলমাত্র বিকেএসপি নির্ভর যে আমাদের ক্রিকেট, সেখানের মাঠ ও পিচের মান কি আন্তর্জাতিক মানের? বিকেএসপি থেকে উঠে আসা ব্যাটসম্যানেরা উপমহাদেশের বাইরের পিচে কেমন পারফর্ম করছে
  • টেস্ট ক্রিকেটে আসার আরও আগে থেকে লঙ্গার ভার্সনের ক্রিকেট শুরু এখানে । আমরা কি পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করতে পেরেছি ? আটটি বিভাগের দল গুলোর কি কোন আলাদা করে ক্যাম্প, খেলোয়াড় বাছাই হয় স্থানীয় পর্যায় থেকে? এখনও কি আমরা এখানে পেশাদারিত্ব নিয়ে আসতে পেরেছি ?
  • এতোটা সময় পার হয়ে গেলেও আমাদের ক্রিকেটার দের আন্দোলনের মাধ্যমে পেশাদারিত্ব, জিম ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার জন্য দাবি তুলতে হয় অথচ আমাদের ক্রিকেট বোর্ডে কর্মকর্তা, পদ, পদবীর অভাব নেই। কিন্তু অভাব আছে স্থানীয় সংগঠকদের। স্থানীয় পর্যায়ে স্কুল ক্রিকেট চলে থেমে থেমে কখনও বা হারিয়েও যায়। এই জায়গা গুলোতে কাজ শুরু হবে কখন?
  • এবারে আসি খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত উপলব্ধি ও আত্মোন্নয়ন নিয়ে । বিরাট কোহলি থেকে বাবর আজম কিংবা বুমরাহ, স্টোকসরা, ক্যারিয়ারে ব্যাড প্যাচের মধ্য দিয়ে যায় না কে? কিন্তু তাদের প্রচেষ্টা ও অধ্যবসায় তাদের কে আবারো ফিরিয়ে আনে সঠিক কক্ষপথে। আমাদের খেলোয়াড়দের মাঝে জাতীয় দলে এসে পড়ার পরে কিছু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়া, পণ্যের মডেলিং ছাড়া কতটা নিজেকে বদলানো বা ঝালাই করে আরও সামনে এগোবার তাড়া থাকে?

কিছু উদাহরণ টানা যাক।

বিষ্ময় নিয়ে হাজির হওয়া মুস্তাফিজের কাটার আজকে অনেকটাই নির্বিষ । শুরু থেকে ইনসুইংগারে অনভস্ত মুস্তাফিজ কী কাজ করেছেন কী করে ডান হাতি ব্যাটসম্যান এর জন্য বল স্ট্যাম্পের ভেতরে আনা যায় ? টেস্টে যে আমাদের লম্বা রেসের ঘোড়া হবে বলে আশা ছিল, এখন আমাদের কে তাকে টেস্ট থেকে দূরে রাখতে হয় তার টি২০ তে ফিটনেস রক্ষা করতে

কিংবা অসাধারণ ভাবে শুরু করে ইংল্যান্ড কে মিরপুরে নাস্তানাবুদ করা মিরাজ হোসেন কি তাঁর তূণে নতুন কোন অস্ত্র যোগ করতে পেরেছেন নাকি সাদামাটা হয়েই ক্যারিয়ার পার করে দেবেন ? ক্যারিয়ারের শুরুতেই ‘বাংলাদেশের ব্র্যাডম্যান’ হিসেবে পরিচয় পাওয়া মমিনুল কী দেশের বাইরে কেন রান পান না সেটা নিয়ে পর্যাপ্ত কাজ করেছেন?

কিংবা পঞ্চপাণ্ডবদের একজন বলে বিবেচিত মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ তাঁর ১৩ বছরের টেস্ট ক্যারিয়ারে এসেও কী ফুটওয়ার্ক ঠিক করতে পেরেছেন? টেস্টে তার ৫০-এর ওপর ইনিংসের সংখ্যা ক’টা ?

সব থেকে অবাক হতে হয় এখনও টেস্ট ক্রিকেটে আমাদের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী পেসারের নাম এখনো মাশরাফি বিন মুর্তজা যিনি তার সর্বশেষ টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন ১১ বছর আগে। এর থেকে বড় খরার উদাহরণ কীই বা হতে পারে।এসব কারণেই হয়তে ১৫ সেশনের টেস্ট ক্রিকেট আমাদের আনন্দ এনে দেয় বড়জোর ২-৪ সেশনে, যেখানে হয়ত তামিম-মুশফিক-সাকিব দের কিছু নান্দনিক ব্যাটিং উপভোগ করা যায় কিংবা সাকিব এর বাঁ-হাতের ঘূর্ণির।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...