দুই দশকের ২০ গল্প

টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের সাফল্য আর ব্যর্থতার বিচারে অধিকতর ভারি থাকবে ব্যর্থতার পাল্লাটাই। নামের সাথে মিল রেখে টেস্ট ক্রিকেট যে আক্ষরিক অর্থেই একটা 'টেস্ট' নেয় সে যাত্রায় বলতে গেলে বরাবর ব্যর্থই হয়েছে বাংলাদেশ। টেস্ট ক্রিকেটটা বাংলাদেশের কাছে রয়েছেন গেছে দুর্বোধ্য এক ধাঁধা হিসেবে, যার জট খুলতে কিংবা হিসাব মিলাতে বাংলাদেশ পারেনি আজো।

ঐতিহ্যবাহী সাদা পোশাকের উপর সবুজ ব্লেজার পরে সেন্ট্রাল উইকেটে টস করতে নামবেন অধিনায়ক, ব্লেজারের গায়ে বুক পকেটে থাকবে বাঘের ছবি, টেস্ট খেলুড়ে দেশে তালিকায় থাকবে বাংলাদেশের নাম, সাদা পোশাক গায়ে জড়িয়ে ২২ গজের সবুজ গালিচায় লাল বলের ক্রিকেটে দাপিয়ে বেড়াবে টাইগাররা; এই স্বপ্নটাই দেখেছিলেন তৎকালীন বাংলাদেশ ক্রিকেটার ও ক্রিকেটের কর্তাব্যক্তিরা। বিশেষ করে তৎকালীন বোর্ড প্রধান সাবের হোসেন চৌধুরী, যার নেতৃত্বেই কূটনৈতিক সে লড়াইয়ে জিতে অবশেষে অধরা সে স্বপ্নটাই ধরা দিলো, মিললো কাঙ্ক্ষিত টেস্ট স্ট্যাটাস।

হাটি হাটি পা পা করে ক্রিকেটের রাজসিক ফরম্যাট সাদা পোশাকের টেস্ট ক্রিকেটে দুই যুগ অর্থাৎ বিশ বছর পূর্ণ করতে যাচ্ছে। এই পথচলার শুরুটা হয়েছিল ২০০০ সালের ১০ নভেম্বর। বিশ বছরের এই পথচলায় যেমন বাঘের ঘেরায় শিকারে পরিণত হয়েছে বিশ্ব ক্রিকেটের প্রতাপশালী অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড, তেমনি মুদ্রার উল্টো পিঠে টাইগাররা অসহায় আত্মসমর্পণ করেছে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানদের কাছেও।

টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের সাফল্য আর ব্যর্থতার বিচারে অধিকতর ভারি থাকবে ব্যর্থতার পাল্লাটাই। নামের সাথে মিল রেখে টেস্ট ক্রিকেট যে আক্ষরিক অর্থেই একটা ‘টেস্ট’ নেয় সে যাত্রায় বলতে গেলে বরাবর ব্যর্থই হয়েছে বাংলাদেশ। টেস্ট ক্রিকেটটা বাংলাদেশের কাছে রয়েছেন গেছে দুর্বোধ্য এক ধাঁধা হিসেবে, যার জট খুলতে কিংবা হিসাব মিলাতে বাংলাদেশ পারেনি আজো।

এই বিশ বছরে বাংলাদেশের খেলা টেস্ট ম্যাচগুলোতে বছরওয়ারী সাফল্য আর ব্যর্থতার বিশ্লেষণ থাকছে নিচে।

  • ২০০০ সাল

২০০০ সালের ২৬ জুন টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তির পর ঐ বছরেরই আজকের এই দিনে টেস্ট ক্রিকেটে ১০ম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভিষেক হয় ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ঐ ম্যাচে তৎকালীন ভারতীয় অধিনায়ক ও বর্তমান বোর্ড প্রধান সৌরভ গাঙ্গুলীর সাথে টস করতে নামেন বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট অধিনায়ক নাইমুর রহমান দুর্জয়ের। বিশ্ব ক্রিকেটে চমক জাগানিয়া বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেকটাও হয়েছিল চমক জাগানিয়া।

অভিষেক টেস্টে প্রথমে ব্যাট করে আমিনুল ইসলাম বুলবুলের ১৪৫ রানের ইনিংসের ভর করে প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশ স্কোরবোর্ডে জমা করে চারশ রান। কিন্তু মুদ্রার উল্টাপিঠ দেখতেও সময় নেয়নি বাংলাদেশ। দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশ গুটিয়ে যায় মাত্র ৯১ রানে। সে ম্যাচে ভারত ৯ উইকেটে জয় লাভ করলেও ম্যাচটি স্মরণীয় হয়ে আছে আমিনুল ইসলাম বুলবুলের ১৪৫ রানের ইনিংস ও নাইমুর রহমান দুর্জয়ের ৬ উইকেটের জন্য। বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিয়ানের পাশাপাশি বিশ্বের তৃতীয় ক্রিকেটার হিসেবে নিজের এবং দেশের অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরি করার গৌরব অর্জন করেন বুলবুল।

ক্রিকেটের অভিজাত এ সংস্করণে পা অভিষেক বছরে এই একটি ম্যাচই খেলে বাংলাদেশ।

  • ২০০১ সাল

টেস্ট অভিষেকের পরবর্তী বছরে বাংলাদেশ আটটি ম্যাচে মাঠে নামলেও এরমধ্যে ৭ টিতেই পরাজয় বরণ করতে হয় বাংলাদেশকে। বাকি টেস্টটিও ড্র হয় বৃষ্টির বদৌলতে। এই বছরেই টেস্ট ক্রিকেটে অনেক প্রথমের সাক্ষী হয় বাংলাদেশ। প্রথম টেস্ট সিরিজ খেলতে যাওয়া বিদেশ সফরে বুলাওয়ের কুইন্স স্পোর্টস ক্লাব মাঠে তৎকালীন তুমুল প্রতাপশালী জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অনুষ্ঠিত প্রথম টেস্টেই ইনিংস ও ৩২ রানে হেরে প্রথমবারের মতো ইনিংসের হারের অভিজ্ঞতা হয় বাংলাদেশের। ম্যাচে হারলেও দুই ইনিংসেই দারুণ ব্যাটিংয়ে প্রথম বাংলাদেশি ক্রিকেটার হিসেবে টেস্টে ম্যাচে সেরার পুরস্কার উঠে অভিষিক্ত জাভেদ ওমরের হাতে, তিনি অভিষেক ম্যাচের দুই ইনিংসেই অর্ধশতক হাঁকানো বিশ্বের ২২তম ব্যাটসম্যান। এই সিরিজেই হারারেতে অনুষ্ঠিত পরের টেস্টেও হেরে প্রথমবারের মতো টেস্ট সিরিজে (২-০) হোয়াইটওয়াশ হয় বাংলাদেশ।

পরবর্তীতে বাংলাদেশ আগষ্টে এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ খেলতে যায় পাকিস্তানে। মুলতানে অনুষ্ঠিত একমাত্র টেস্টে আবারো ইনিংস হারের তিক্ত অভিজ্ঞতা হয় বাংলাদেশের। এই বছরেই এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের দ্বিতীয় ম্যাচে কলম্বোয় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথমে ব্যাট করে ৯০ রানে অলআউট হয়ে প্রথমবারের মতো টেস্টে শতরানের নিচে অলআউট হওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কা ৫৫৫ রান করে ইনিংস ঘোষণা করলে ৪৬৫ রানে পিছিয়ে থেকে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নামে বাংলাদেশ। ঐ ইনিংসে বাংলাদেশের পক্ষে সেঞ্চুরি করে মাত্র সতেরো বছর বয়সে বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট সেঞ্চুরিয়ানের রেকর্ড গড়েন বাংলাদেশের মোহাম্মদ আশরাফুল, যে রেকর্ডটি এখনো পর্যন্ত অক্ষত রয়েছে। পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুই হার দিয়েই এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশের।

নভেম্বরে ফিরতি সফরে দ্বিতীয় দল হিসেবে টেস্ট খেলতে বাংলাদেশে আসে জিম্বাবুয়ে। ঢাকায় প্রথম টেস্টের তৃতীয় ও চতুর্থ দিন বৃষ্টিতে ভেসে গেলে বৃষ্টির বদৌলতে ঐ ম্যাচ শেষ হয় দুই দলের সমতায় থেকে। চট্টগ্রামে দ্বিতীয় টেস্টে জিম্বাবুয়ের কাছে হারতে ৮ উইকেটে হারতে হয় বাংলাদেশকে। এই সিরিজের চট্রগ্রাম টেস্ট শতক হাকান হাবিবুল বাশার সুমন।

২০০১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশকে টেস্ট সিরিজ খেলার আমন্ত্রণ জানায় নিউজিল্যান্ড। দেশের দ্বিতীয় টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে খালেদ মাসুদ পাইলটের ঐ এ্যাসাইনমেন্টের অভিজ্ঞতাও ছিল বেশ তিক্ত। ইনিংস হারের পাশাপাশি কিউইদের বিপক্ষে ঐ সিরিজেও ২-০ তে হোয়াইটওয়াশ হয়ে আসে বাংলাদেশ।

  • ২০০২ সাল

আগের বছরের মতো এবারও আটটি ম্যাচ খেললেও এবার ফলাফলে শতভাগ ব্যর্থতার বৃত্ত পূর্ণ করে বাংলাদেশ। এরমধ্যে আবার ছয়টিতেই ডুবতে হয় ইনিংস হারের লজ্জায়।

জানুয়ারিতে তৃতীয় দল হিসেবে টেস্ট খেলতে বাংলাদেশ সফরে আসে পাকিস্তান। ঢাকায় প্রথম টেস্টে ইনিংস ও ১৭৮ রানের বড় ব্যবধানে হেরে প্রথমবারের মতো দেশের মাটিতে ইনিংস হারের লজ্জায় ডুবে পাইলট-বাশার-বুলবুলরা। দ্বিতীয় টেস্টে চট্রগ্রামে ওয়াকার ইউনিসের পাকিস্তানের কাছে আবারো ইনিংস ব্যবধানে হারে বাংলাদেশ।

জুলাইয়ে শ্রীলঙ্কা সফরে গিয়ে সেখানেও সনাৎ জয়সুরিয়ার দলের কাছে দুই টেস্টেই হারের বৃত্ত পূর্ণ করে বাংলাদেশ। এরমধ্যে আবার প্রথম টেস্টটি হারে ইনিংস ব্যবধানে।

এরপর ষষ্ঠ দল হিসেবে টেস্টে বাংলাদেশের মুখোমুখি হয় দক্ষিণ আফ্রিকা।

দুই টেস্টের সিরিজ খেলতে ২০০২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা গিয়েছিল বাংলাদেশ দল। কিন্তু সেই সময়ের কার্স্টেন-স্মিথ-ক্যালিসদের নিয়ে গড়া দলটার সামনে দাঁড়াতেই পারেননি জাভেদ ওমর-খালেদ মাসুদ পাইলট-হাবিবুল বাশাররা। দুইটি টেস্টেই যথারীতি ইনিংস ব্যবধানে জেতে স্বাগতিক প্রোটিয়ারা।

কি বলবেন, লাকি সেভেন নাকি আনলাকি সেভেন ফর বাংলাদেশ?

সপ্তম দল হিসেবে বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্ট খেলতে ডিসেম্বরে বাংলাদেশে আসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ক্যারিবিয়ানরা সেবার একটুও ছাড় দেয়নি স্বাগতিকদের। ইনিংস ও ৩১০ রানের বিশাল জয়েই সিরিজ শুরু করে তাঁরা। চট্রগ্রামে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় টেস্টও সফরকারীরা জিতে নেয় ৭ উইকেটে।

এভাবেই টেস্ট আঙ্গিনায় অভিষেকের তৃতীয় বর্ষটা বাংলাদেশ শেষ করে পাহাড়সম ব্যর্থতা নিয়ে।

  • ২০০৩ সাল

আরো একটি ব্যর্থতায় কাটানো বছরের পর এই বছরে বাংলাদেশ এক ক্যালেন্ডার ইয়ারে সবচেয়ে বেশি নয়টি টেস্ট খেলে। কিন্তু যথারীতি ফলাফলে হারের বৃত্ত পূর্ণ হয় শতভাগই।

বাংলাদেশের এই বছরের টেস্ট মিশন শুরু হয় প্রোটিয়াদের বিপক্ষে হোম সিরিজ দিয়ে। বিশ্বকাপে ব্যর্থতার পর পাইলটের থেকে নেতৃত্ব ভার এবার তুলে দেয়া হয় খালেদ মাহমুদ সুজনের কাধে। কিন্তু পাইলটের মতো এই ফরম্যাটে অধিনায়ক হিসেবে তিনিও ছিলেন শতভাগ ব্যর্থ।

দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দেশের মাটিতে দুই টেস্টেই ইনিংস ব্যবধানে হারের পর খালেদ মাহমুদের দল টেস্ট খেলতে যায় অস্ট্রেলিয়ায়। কিন্তু যথারীতি বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের সামনে পাত্তাই পায়নি বাংলাদেশ। স্টিভ ওয়াহর দলের কাছে দুই টেস্টেই ইনিংস ব্যবধানে হেরে আসে বাংলাদেশ।

এই বছরের আগষ্টে ফের পাকিস্তান সফরে যায় বাংলাদেশ দল। প্রথম দুই টেস্টে হারের পর আসে ঐতিহাসিক মুলতান টেস্ট। লোকে বলে- সময় গড়ালে নাকি মানুষ দুঃখ ভুলে যায়। কিন্তু সব দুঃখ বোধহয় না। এই যেমন মুলতান টেস্টের কথাই ধরুন। তখনকার সময়ে বাংলাদেশ ক্রিকেটের একেকটা জয় যেন ঈদ উৎসবের আমেজ নিয়ে আসতো এদেশে মানুষের মাঝে। প্রথমবারের মতো টেস্ট জয়ের হাতছানি তাও আবার পাকিস্তানের মতো বড় দলের বিপক্ষে! কিন্তু সেবার হাবিবুল বাশারের অনবদ্য ফিফটি, খালেদ মাহমুদ-মোহাম্মদ রফিকদের বোলিং বীরত্বের পরও পাকিস্তানকে হারানো যায়নি শেষমেশ এই ইনজামামের জন্য।

পাকিস্তান ২৬১ রান তাড়ায় ১৩২ রানে ৬ এবং ২০৫ রানে ৮ উইকেট হারানোর পরেও ‘মুলতানের সুলতান’ খ্যাত ইনজামামের টেলএন্ডারদের আড়াল করে ১৩৮ রানের অবিশ্বাস্য, অতিমানবিক সে ইনিংসের কাছেই যে জিততে জিততেও হৃদয়ভঙ্গ হয়েছিল বাংলাদেশের। মুলতান টেস্ট শেষে খালেদ মাহমুদদের কান্নাভেজা চোখে মাঠ ছাড়ার দৃশ্য আজো বাংলাদেশ ক্রিকেটের এক বড় দুঃখগাথার অংশ। পাকিস্তানি উইকেটরক্ষক রশিদ লতিফের প্রতারণার বিরতিতে মোহাম্মদ রফিকের ‘জেন্টলম্যানশিপ’ এর জন্যেও স্মরণীয় হয়ে থাকবে এই টেস্ট।

এই সফরে জাভেদ ওমর তার ক্যারিয়ারের একমাত্র সেঞ্চুরিটি করেন।

৯ম দল হিসেবে টাইগারদের বিপক্ষে খেলতে বাংলাদেশ সফরে আসে ক্রিকেটের জনক ইংলিশরা। মাইকেল ভনের নেতৃত্বাধীন দলটির কাছে দুই টেস্টেই হেরে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেকের মাত্র তিন বছরের মাথায়ই টেস্ট খেলুড়ে সবগুলো দলের বিপক্ষেই হারের তিক্ত স্বাদ পায় বাংলাদেশ।

  • ২০০৪ সাল

ম্যাথু হেইডেনের ৩৭৫ রান টপকে একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে ক্যারিয়ার বরপুত্র ব্রায়ান চার্লস লারার চারচালা রানের ইনিংস খেলার এই বছরটা পিছনের দুটি বছরের তুলনায় টেস্ট আঙিনায় কিছুটা হলেও স্বস্তিকর ছিল বাংলাদেশের জন্য। তবুও এই বছরে আটটি টেস্ট ম্যাচে অংশ নিয়ে ছয়টিতেই হারতে হয় বাংলাদেশকে, এর মধ্যে আবার পাঁচ টিতেই ছিল ইনিংস হারের লজ্জা।

বাংলাদেশের এই বছরের টেস্ট অভিযানটা শুরু হয় জিম্বাবুয়ে সফরের মধ্য দিয়ে। অধিনায়ক হিসেবে নিজের প্রথম অ্যাসাইনমেন্টে হারারেতে প্রথম টেস্টে ১৮৩ রানে হারের পর বুলাওয়েতে দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম দুই ও চতুর্থ দিন বৃষ্টিতে ভেসে নিজেদের দ্বিতীয় টেস্ট ড্র পায় হাবিবুল বাশারের দল। এই সফরে হারারে টেস্টে প্রয়াত বাংলাদেশী অলরাউন্ডার মানজারুল ইসলাম রানার টেস্ট অভিষেক হয়।

জিম্বাবুয়ে সিরিজে ব্যর্থতার পর ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ সফর করে বাংলাদেশ। সেন্ট লুসিয়ায় প্রথম টেস্টে প্রথমে ব্যাট করে অধিনায়ক হাবিবুল বাশার ও মোহাম্মদ রফিকের জোড়া শতক এবং মোহাম্মদ আশরাফুলের ৮১ রানের ইনিংসে ভর করে ভারতের বিপক্ষে অভিষেক টেস্টে করা চারশ রান টপকে স্কোরবোর্ডে ৪১৬ রান তোলে বাংলাদেশ। ক্রিস গেইলের শতকের পরেও ব্রায়ান লারার দল ৩৫২ রানে গুটিয়ে গেলে টেস্ট ক্রিকেটে প্রথমবারের মতো লিড নেয়ার স্বাদ পায় বাংলাদেশ। দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশ স্কোরবোর্ডে ২৭১ রান তুলে ইনিংস ডিক্লেয়ার্ড করলে পঞ্চম দিনে জয়ের জন্য ৩২৬ রানের লক্ষ্য পায় ক্যারিবিয়ানরা। এই টেস্টই ছিল বাংলাদেশের লড়াই করে ড্র করা প্রথম ম্যাচ, পরাক্রমশালী ক্যারিবিয়ানদের বিপক্ষে যা ছিল তৎকালীন বাংলাদেশের জন্য বিজয়তুল্য।

প্রথম টেস্টে বীরত্ব দেখালেও দ্বিতীয় টেস্টে এসে ঠিকই পুরোনো রূপে ফিরে আসে বাংলাদেশ। হারে ইনিংস ও ৯৯ রানের ব্যবধানে।

অক্টোবরে প্রথমবারের মতো টেস্ট সিরিজ খেলতে বাংলাদেশ সফরে আসে নিউজিল্যান্ড। এই সিরিজ দিয়েই আবার অধিনায়কত্ব ফিরে পান খালেদ মাসুদ পাইলট। কিন্তু কিউইদের কাছে দুই টেস্টেই ইনিংস ব্যবধানে হারের লজ্জায় ডুবতে হয় পাইলটের দলকে।

বছরের শেষ দিকে বাংলাদেশ সফরে আসে সৌরভ গাঙ্গুলীর ভারত। হাবিবুল বাশারের নেতৃত্বে ঢাকায় প্রথম টেস্টে ইনিংস ও ১৪০ রানে হারের পর চট্রগ্রামে দ্বিতীয় টেস্টেও বাংলাদেশ হারে ইনিংস ও ৮৩ রানের ব্যবধানে।

  • ২০০৫ সাল

টেস্টে টানা ১৬ সিরিজে হার! হারতে হারতে কোনঠাসা হয়ে পড়া বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত টেস্ট আঙ্গিনায় পথচলার পঞ্চম বছরে এসে সাফল্যের পায় খোঁজ।

টেস্ট আঙিনায় পদার্পনটা যেমন সরবে ছিল, নিজেদের ইতিহাসের প্রথম জয়টাও তেমনই দাপুটে ছিল বাংলাদেশের। চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত নিজেদের ৩৫তম এই টেস্টের প্রথম দিন থেকেই চালকের আসনে ছিল বাংলাদেশ। প্রথম ইনিংসে নিজেদের অতীতের সব রেকর্ডকে দুমড়েমুচড়ে দিয়ে সর্বোচ্চ ৪৮৮ রানের পাহাড়সম সংগ্রহ দাঁড়াবো করায় বাংলাদেশ। জবাবে জিম্বাবুয়ে গুটিয়ে যায় ৩১২ রানেই। চতুর্থ ইনিংসে ৩৮১ রানের লক্ষ্যমাত্রা তাড়া করতে নেমে জিম্বাবুয়ে ১৫৪ রানে অলআউট হলে ২২৬ রানের বিশাল ব্যবধানে জয় পায় বাংলাদেশ, সাগরিকা থেকে উৎসব ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে, ইতিহাসের প্রথম টেস্টের জয়ের উৎসবে মাতে সমগ্র বাংলাদেশ।

ওই সিরিজেই নিজেদের ইতিহাসের প্রথম সিরিজ জয়েরও দেখা পায় বাংলাদেশ। দ্বিতীয় টেস্টটি ড্র করে ১-০ ব্যবধানে সিরিজ জিতে নেয় হাবিবুল বাশারের দল।

এই বছরে খেলা বাকি চারটি টেস্টের সবগুলোতেই ইনিংস ব্যবধানে হারতে হয় বাংলাদেশ। এরমধ্যে ক্রিকেটের মক্কা খ্যাত ঐতিহাসিক লর্ডসেও টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা হয় বাংলাদেশের, যদিও সে অভিজ্ঞতায় তিক্তটাই মিশে গিয়েছিল বেশি।

  • ২০০৬ সাল

এই বছরে মাত্র চারটি টেস্ট খেলে বাংলাদেশ, যার সবগুলোই ছিল ঘরের মাটিতে। এরমধ্যে চট্টগ্রাম ও বগুড়ায় দুই টেস্টেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হারে বাংলাদেশ।

২০০৩ সালের মুলতান ট্রাজেডি’র পর এই বছরে বাংলাদেশ ক্রিকেটের আরেকটি আক্ষেপগাথা রচিত হয় ফতুল্লায়। নাক উচা অজিদের বিপক্ষে ফতুল্লা টেস্টের গল্পটা আরেকটু এদিক-সেদিক হলেই ফতুল্লার এই টেস্টটা হয়ে থাকতে বাংলাদেশের জন্য একটি গৌরবময় বিজয়গাথা।

ইংরেজিতে বলা হয় ‘মর্নিং শোওজ দ্য ডে’। ব্রেট লি, স্টুয়ার্ট ক্লাক, জেসন গিলেস্পি, শেন ওয়ার্ন, স্টুয়ার্ট ম্যাকগিলদের সমন্বয়ে গড়া বোলিং আক্রমণের সামনে শুরুটা করেছিলেন শাহরিয়ার নাফিস আর জাভেদ ওমর। ক্রিকেট পাড়ায় কথিত আছে- ওয়ার্নের দুঃস্বপ্নে নাকি শচীন আসতেন নিয়মিত+। সেই কখনো শাহরিয়ার নাফিসও এক ঝলক এসেছিলেন কি? কেননা মাত্র চার টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা নিয়ে খেলতে নামা নাফিস সেদিনের ১৩৮ রানের ইনিংসটা খেলার পথে ১৯ চারের ১০টাই মেরেছিলেন তাকে।

শেষপর্যন্ত বাংলাদেশের ৪২৭ রানের জবাব দিতে নেমে ফলোঅনের শঙ্কায় পড়া অজিরা শেষমেশ স্কোরবোর্ডে সংগ্রহ করতে পারে মাত্র ২৬৯ রান। চতুর্থ ইনিংসে ৩০৭ রানের লক্ষ্যতাড়ায় ২৩১ রানে ৬ উইকেট হারানো অজিদের তখনকার পাড়ি দেয়ার ছিল ৭৬ রানের ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার’।

রিকি পন্টিংয়ের অসামান্য বীরত্বে এখান থেকেই এই টেস্টটা জিতে নেয় অস্ট্রেলিয়া। এই টেস্টটা যেন আরেকবার বুঝিয়ে দিয়ে গেল, চ্যাম্পিয়নরা কীভাবে ঘুরে দাঁড়ায়, আর বড় মঞ্চে অভিজ্ঞতার ঘাটতি থাকা দলগুলো কীভাবে বারেবারে ‘এত কাছে, তবু এত দূরের’ হৃদয়বিদারক দৃশ্যগুলোর মুখোমুখি হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে। তাইতো সম্ভাবনার বাতি জ্বালিয়েও শেষমেশ আর ফতুল্লা টেস্টে জয়ের মশালটা জ্বালানো যায়নি।

  • ২০০৭ সাল

২০০৭ এ ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে বসে বিশ্ব ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আসর। সেই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কাছে হেরে গ্রুপ পর্বেই বিদায় নিতে হয় ভারতকে। বিশ্বকাপের পরপরই এই দগদগে ক্ষত নিয়ে বাংলাদেশে সফরে আসে রাহুল দ্রাবিড়ের নেতৃত্বাধীন ভারত। চট্টগ্রামে বৃষ্টিবিঘ্নিত প্রথম টেস্টে ড্রয়ের পর দ্বিতীয় টেস্টে ভারতের কাছে ইনিংস ব্যবধানে হারে বাংলাদেশ। চট্টগ্রাম টেস্টের মধ্য দিয়ে টেস্ট ক্রিকেটের রাজসিক ফরম্যাটে অভিষেক ঘটে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের।

এর পরপরই টেস্টে চতুর্থ অধিনায়ক হিসেবে মোহাম্মদ আশরাফুলের নেতৃত্বে শ্রীলঙ্কা সফরে যায় বাংলাদেশ। কিন্তু অধিনায়ক হিসেবে যাত্রাটা মোটেও সুখকর ছিলনা আশরাফুলের জন্য। ঐ সফরের দুইটি টেস্টেই ইনিংস ব্যবধানে হারের লজ্জায় ডুবে বাংলাদেশ।

  • ২০০৮ সাল

এই বছরে নয়টি টেস্ট ম্যাচে মাঠে নামে বাংলাদেশ। তন্মধ্যে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বৃষ্টিবিঘ্নিত একটি টেস্ট ড্র বাদে সবগুলো টেস্টেই হারে বাংলাদেশ। এরমধ্যে চট্টগ্রামে সাকিব আল হাসানের ক্যারিয়ার সেরা (৩৬-৭) বোলিংয়ে কিউইদের ১৭১ রানে অলআউট করার পরেও জিততে পারেনি বাংলাদেশ। বাংলাদেশের জয়ের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হলেও চতুর্থ ইনিংসে রান তাড়ায় অধিনায়ক ড্যানিয়েল ভেট্টোরির দৃঢ়তায় ৩১৭ রান টপকে জিতে নেয় কিউইরা।

  • ২০০৯ সাল

টেস্ট ক্রিকেট আঙ্গিনায় পদার্পণের নবম বছরে এসে বাংলাদেশ একটি সাফল্যময় বছর পার করে। এই বছরে মাত্র তিনটি টেস্ট খেলে তারমধ্যে দুইটি টেস্টেই জিতে নেয় বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কা সিরিজে ব্যর্থতার পর আশরাফুলকে অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে দেয় বিসিবি এবং বাংলাদেশকে ওয়েস্ট ইন্ডিজে পাঠানো হয় মাশরাফি বিন মর্তুজার কাধে অধিনায়কের দায়িত্ব দিয়ে। কিন্তু প্রথম টেস্টেই মাশরাফি ইনজুরিতে পরলে পরবর্তীতে দলকে নেতৃত্ব দেন সাকিব আল হাসান।

খর্বশক্তির ক্যারিবিয়ানদের বিপক্ষে প্রথম টেস্টে বাংলাদেশ ৯৫ রানের জয় তুলে নেয়। এটি ছিল বাংলাদেশের দ্বিতীয় টেস্ট জয় এবং বিদেশের মাটিতে জেতা প্রথম টেস্ট। গ্রানাডায় দ্বিতীয় টেস্টে বৃষ্টিবাধা উপেক্ষা করে বাংলাদেশ ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারায় ৪ উইকেটের ব্যবধানে। এই জয়ে প্রথমবারের মতো টেস্টে কোন দলকে হোয়াইটওয়াশ করার স্বাদ পায় বাংলাদেশ। দেশের বাইরে এটিই ছিল বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়। সিরিজ সেরার পুরস্কার উঠে সাকিব আল হাসানের হাতে।

  • ২০১০ সাল

এই বছরে সাকিব আল হাসানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সাতটি টেস্টে মাঠে নামে। কিন্তু টেস্ট অভিষেকের এক দশকে এসেও সবগুলো ম্যাচেই হারের তিক্ত অভিজ্ঞতা হয় বাংলাদেশের। এই বছরে টেস্ট ক্রিকেটে অর্জন বলতে ক্রিকেটের মক্কা খ্যাত লর্ডস টেস্টে শাহাদাত হোসেন রাজিবের পাঁচ উইকেট শিকার ও তামিম ইকবালের শতক হাঁকানোর কৃতিত্বে অনার্স বোর্ডে নাম উঠে দুই বাংলাদেশী ক্রিকেটারের।

লর্ডসে ইংরেজ পেসারদের বিপক্ষে অবিস্মরণীয় সেই সেঞ্চুরির পর দৌড়ে এক লাফ দিয়ে কয়েকবার জার্সির পেছন দিকে হাত দিয়ে লর্ডসের বিখ্যাত অনার্স বোর্ডের দিকে “আমার নামটা এবার লিখে দাও, ইঙ্গিত করে তামিমের করা সেই রাজসিক উৎযাপন বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের এক গৌরবগাথার অংশ হয়ে আছে।

  • ২০১১ সাল

ঘরের মাঠে ২০১১ বিশ্বকাপে সাফল্য আর ব্যর্থতার মিশ্র অনুভূতি গ্রহণের পর আগস্টে জিম্বাবুয়ে সিরিজে যায় বাংলাদেশ। ওয়ানডে সিরিজে হারের পর হারারেতে একমাত্র টেস্টেও হারের তিক্ত অভিজ্ঞতা হয় সাকিব আল হাসানের দলের। এই সিরিজে এমন নিদারুণ ব্যর্থতার খেসারত হিসেবে অধিনায়কত্ব হারাতে হয় সাকিব-তামিমকে।

টেস্টে বাংলাদেশের সপ্তম অধিনায়ক হিসেবে মুশফিকুর রহিমের যাত্রাটা শুরু হয় ঘরের মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর দিয়ে। প্রথম এ্যাসাইনমেন্টে বৃষ্টিবিঘ্নিত চট্টগ্রাম টেস্ট ড্র হলেও ঢাকায় দ্বিতীয় টেস্টে ২২৯ রানের বিরাট ব্যবধানে হারতে হয় মুশফিকুর রহিমের দলকে। এরপরে চট্টগ্রামে পাকিস্তানের বিপক্ষে ইনিংস ব্যবধানে হার দিয়ে অধিনায়ক হিসেবে নিজের প্রথম বছরের অভিজ্ঞতাটা বেশ তিক্তই হয় মুশফিকের জন্য।

টেস্ট আঙিনায় পদার্পণের একাদশ বছরে ৫টি টেস্ট খেলে চারটিতেই হারতে হয়েছিল বাংলাদেশক, এরমধ্যে আবার একটিতে ছিল ইনিংস হারের লজ্জাও।

  • ২০১২ সাল

অভিষেকের পর বাংলাদেশের সবচেয়ে কম টেস্ট খেলা বছরগুলোর একটি এই ২০১২ সাল। এই বছরে শুধুমাত্র ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দুইটি টেস্টে মাঠে নামে বাংলাদেশ। যার দুইটিতেই হেরে হোয়াইটওয়াশ হয় মুশফিকুর রহিমের দল।

  • ২০১৩ সাল

বড় সাফল্য ধরা না দিলেও এই বছরে এসে অতীতের ব্যর্থতা সামাল দেয়া গেছে অনেকখানিই। গলে শ্রীলঙ্কা সফরের প্রথম টেস্টে স্বাগতিকদের ৫৭০ রানের ইটের জবাবে রীতিমতো পাটকেল ছুঁড়ে বাংলাদেশ। প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে অধিনায়ক মুশফিকুর রহিমের ডাবল সেঞ্চুরি ও মোহাম্মদ আশরাফুলের ১৯০ এবং নাসির হোসেনের শতকে ভর করে টেস্ট ইতিহাসে নিজেদের সর্বোচ্চ ৬৩৮ রান সংগ্রহ করে বাংলাদেশ। শেষ পর্যন্ত গল টেস্টে চালকের আসনে থেকে সম্মানের সাথে ড্র করতে সমর্থ বাংলাদেশ।

 

শ্রীলঙ্কা সফর শেষে বাংলাদেশ দল সফর করে জিম্বাবুয়েতে। সেখানে প্রথম টেস্টে হারের পর দ্বিতীয় টেস্টে জিম্বাবুয়েকে ১৪৩ রানে হারাল বাংলাদেশ।

এরপরে অক্টোবরে বাংলাদেশ সফরে আসে নিউজিল্যান্ড। কিউইদের বিপক্ষে দুই টেস্টেই কোন ফল না আসলেও, দুটি ম্যাচেই দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে বাংলাদেশ। প্রথম টেস্টে সোহাগ গাজী ম্যাচ সেরা হওয়ার পর দ্বিতীয় টেস্ট ও সিরিজ সেরা হন বর্তমান টেস্ট অধিনায়ক মমিনুল হক সৌরভ।

এই বছরে খেলা ছয়টি টেস্টের দুইটিতে হারের বিপরীতে বাংলাদেশ জয় পায় একটি ম্যাচে, বাকি তিনটি ম্যাচেই লড়াই করে ড্র করে টাইগাররা। যে লড়াইগুলো জানান দেয় বিশ্ব ক্রিকেটে ধীরে ধীরে বাংলাদেশের উত্থানের।

  • ২০১৪ সাল

যদিও ২০১৪ সালে বাংলাদেশের শুরুটা হয় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হার দিয়ে, এই বছরে বাংলাদেশের সাফল্য আর ব্যর্থতার বিচারের পাল্লাটা থাকবে সমান-সমান। মোট সাতটি টেস্ট খেলে তিনটিতে জয় আর হারের বিপরীতে অবশিষ্ট ম্যাচটিতে ড্র করে বাংলাদেশ।

স্বাগতিকরা চট্টগ্রামে দ্বিতীয় টেস্টের পূর্ণ পাঁচদিন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বুক চিতিয়ে লড়ে গিয়ে শেষমেশ পঞ্চম দিনের শেষ বিকেলে দুই অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম আর অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউস টেস্টটির অমীমাংসিত ফলাফল মেনে নেয়ার মাধ্যমে প্রথমে টেস্টে ইনিংস হারের গ্লানি কিছুটা হলেও বাংলাদেশ ভুলতে পারে।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর গিয়ে ক্যারিবিয়ানদের বিপক্ষে দুই টেস্টেই হেরে আসার পর বাংলাদেশ দল অক্টোবরে ঘরের মাঠে আতিথেয়তা দেয় দুঃসময়ের পরম বন্ধু জিম্বাবুয়েকে।

আতিথেয়তার জন্য প্রশংসনীয় বাঙালিরা কিন্তু ঘরের মাঠে সফরকারীদের ছাড় দেয়নি একচুলও। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনায় অনুষ্ঠিত তিন টেস্টেই বাংলাদেশ জয় তুলে নেয় যথাক্রমে ৩ উইকেট, ১৬২ রান ও ১৮৬ রানে। এই সিরিজে জিম্বাবুয়েকে হোয়াইটওয়াশের পাশাপাশি তৃতীয় টেস্ট সিরিজ জয়ের কৃতিত্ব গড়ে বাংলাদেশ। পুরো সিরিজজুড়েই অসাধারণ অলরাউন্ডিং পারফরম্যান্সের জন্য সিরিজ সেরার পুরস্কার উঠে সাকিব আল হাসানের হাতে।

  • ২০১৫

মুলতান টেস্টের দগদগে ক্ষততে বাংলাদেশ কিছুটা হলেও প্রলেপ দিতে সমর্থ হয়েছিল পাকিস্তান সিরিজটাতে। ঘরের মাঠে ওয়ানডেতে পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করার পর খুলনায় প্রথম টেস্টে তৃতীয় ইনিংসে ৩৫১ মিনিট উইকেটে অবিচ্ছিন্ন থেকে ৩১২ রান তুলে বিশ্বরেকর্ড গড়েন তামিম ইকবাল ও ইমরুল কায়েস। ১৫০ করে ইমরুল থামলেও দ্বিতীয় বাংলাদেশি হিসেবে ঠিকই ডাবল সেঞ্চুরি তুলে নিয়েছিলেন তামিম ইকবাল।

শেষপর্যন্ত পঞ্চম দিনের শেষে বিকেলের এক ঘন্টা বাকি থাকতেই ড্রয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন পাকিস্তান অধিনায়ক মিসবাউল হক। চাপের মুখে তামিম-ইমরুলের খেলা ঐ ইনিংসকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের বড় এক টার্নিং পয়েন্ট বলে অভিহিত করেছিলেন তৎকালীন কোচ চান্দিকা হাতুরুসিংহে।

এই বছরে খেলা পাঁচটি টেস্টের চারটিতেই ড্র করে বাংলাদেশ।

  • ২০১৬ সাল

টেস্টে বাংলাদেশের সেরা সাফল্যের অন্যতম একটি এসেছে এই বছরে। চট্রগ্রামের পয়মন্ত ভেন্যুতে স্পিনিং ট্রাক বানিয়েও ইংরেজ সিংহ শিকার করা যায়নি। ২২ রানের ফাঁক গলে কোনরকমে চট্রগ্রাম টেস্ট জিতে ঢাকায় আসে ইংরেজরা। দ্বিতীয় টেস্টে ইংরেজদের জন্য প্রস্তুত করা হয় আরো বড় পরীক্ষা মঞ্চ। যে পরীক্ষায় ইংরেজ সিংহ উতরাতেতো পারেইনি উল্টো বলতে গেলে বাঘের থাবায় তৃতীয় দিন চা বিরতির পর এক সেশনেই দশ উইকেট হারিয়ে তাসের ঘরের মতো তছনছ হয়ে গিয়ে তিনদিনই বাংলাদেশের কাছে টেস্ট হারে নাক উঁচা জিওফ বয়কটের দেশের খেলোয়াড়েরা। জিম্বাবুয়ে আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের পর ক্রিকেটের জনক ইংলিশদের ১০৮ রানের বড় ব্যবধানে হারিয়ে টেস্টে নিজেদের অষ্টম জয় তুলে নেয় বাংলাদেশ।

দারুণ এক ঘূর্ণিতে বোল্ড করার পর বেন স্টোকসকে দেয়া সাকিবের সেই স্যালুট বাংলাদেশ ক্রিকেটের গৌরবময় দেয়ালে চিরভাস্বর এক জ্বলজ্বল অধ্যায়। ঐতিহাসিক এই টেস্ট ও সিরিজ সেরার পুরস্কার জিতেন তরুণ অলরাউন্ডার মেহেদি হাসান মিরাজ।

  • ২০১৭ সাল

এখনো পর্যন্ত টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল সাফল্যমন্ডিত বছর এটি। ঘরের মাঠে অজিদের হারানোর পাশাপাশি এই বছরে জয় এসেছে নিজেদের শততম টেস্টেও।

ক্রিকেটে বাংলাদেশের উত্থান আর পতনের মেলবন্ধনের মতোই এই বছরটাও শুরু হয়েছিল চোখের সামনে খুব কাছ থেকে মুদ্রার দুটি দিক দেখার মধ্য দিয়ে। উইলিংটনে তৃতীয় বাংলাদেশী হিসেবে সাকিব আল হাসানের দ্বিশতক আর মুশফিকের ১৫৯ রানের বীরত্বগাথার পর প্রথম ইনিংসে ৫৯৫ রান তুলে ইনিংস ঘোষণার বীরত্ব দেখায় বাংলাদেশ। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে ১৬০ রানে অলআউট হয়ে ঐ টেস্টই ৭ উইকেটে হেরে যাওয়ার মাধ্যমে ২০১৭ সালের শুরুটা হয়েছিল বাংলাদেশ।

টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তির সতেরো বছরের মাথায় এই বছরই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশকে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানায় বিসিসিআই। যদিও প্রথমবারের ভারত সফরের অভিজ্ঞতা সুখ্যাতি হয়নি বাংলাদেশের।

২০০৬ সালে ফতুল্লায় যে শিকারটা বেরিয়ে গিয়েছিল ফাঁক গলে, সে শিকারটাই ২০১৭ তে এসে ধরা পড়লো বাঘের খপ্পরে। বাঁক বদলের চক্রে রুদ্ধশ্বাস সময়ে শঙ্কা-সম্ভাবনার দোলাচলে শের-ই-বাংলা স্টেডিয়াম, সাথে যেন দুলছিল সমগ্র বাংলাদেশ। অস্ট্রেলিয়ার জয় থেকে ২১ রান দূরে থাকতে তাইজুল ইসলাম জজ হ্যাজেলউডকে ফিরিয়ে দিলে গর্জনে, স্লোগানে প্রকম্পিত হয় মিরপুর, সাথে সমগ্র বাংলাদেশ। বাংলাদেশের বিশ্বের ক্রিকেটের সফলতম দল, বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট জয়! যে সমর্থকরা এদেশের ক্রিকেটের অন্তঃপ্রাণ সে সমর্থক দেশবাসীকে ঈদের আগ মুহুর্তে দারুণ এক ঈদ উপহারই দিয়েছিল মুশফিক-সাকিব-তামিমরা।

এর আগে এই বছরেই শ্রীলঙ্কার কলম্বোয় নিজেদের ইতিহাসের মাইলফলক স্পর্শ করা শততম টেস্টে লংকানদের চার উইকেটে হারিয়ে ঐতিহাসিক ঐ টেস্ট ম্যাচটিকে স্মরণীয় বরণীয় করে রাখে বাংলাদেশ।

এই বছরে মোট নয়টি টেস্ট খেলে ঐতিহাসিক এই দুই জয়ের বিপরীতে বাকি সাতটিতেই হেরে যায় বাংলাদেশ। এরমধ্যে আবার দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে একটিতে ছিল ইনিংস হারের লজ্জার রেকর্ডও।

  • ২০১৮ সাল

গত বছরের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের ব্যর্থতার পরপরই নেতৃত্ব থেকে মুশফিক সরে দাঁড়ালে আবারো অধিনায়কত্ব দেয়া হয় সাকিব আল হাসানকে। কিন্তু ইনজুরির জন্য সাকিব মাঠের বাইরে থাকায় জানুয়ারি-ফ্রেব্রুয়ারিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুই টেস্টেই অধিনায়কত্ব করেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। প্রথম টেস্টে রিয়াদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ দারুণ লড়াই করে ড্র করলেও দ্বিতীয় টেস্টে ব্যর্থ হয় বাংলাদেশ। এই সিরিজ দিয়েই বাংলাদেশের দায়িত্ব ছাড়া হাথুরুসিংহে তার শ্রীলঙ্কা-অধ্যায় শুরু করেন।

এই বছরের সাকিবের নেতৃত্বে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে টেস্টে হোয়াইটওয়াশ হয়ে আসার পর সিলেটে ঘরের মাঠে মাহমুদুল্লাহর নেতৃত্বে জিম্বাবুয়ের প্রথম টেস্টে হারে বাংলাদেশ। ঢাকায় দ্বিতীয় টেস্টে ২১৮ রানের বড় ব্যবধানে জিম্বাবুয়েকে হারিয়ে মধুর প্রতিশোধ নেয় বাংলাদেশ।

বছরের শেষদিকে ফিরতি সফরে বাংলাদেশে আসে ক্যারিবিয়ানরা। চট্টগ্রামে প্রথমে টেস্টে ৬৪ রানের ব্যবধানে হারানোর পর ঢাকায় দ্বিতীয় টেস্টে ইনিংস ও ১৮৪ রানের বড় ব্যবধানে ক্যারিবিয়ানদের হারিয়ে সিরিজে বাংলাওয়াশ ও মধুর প্রতিশোধটাও নিয়ে নেয় বাংলাদেশ। সিরিজ সেরা হন অধিনায়ক সাকিব আল হাসান।

এই বছরে খেলা মোট ৮টি ম্যাচ খেলে তিনটিতে জয়ের বিপরীতে ৪টিতে হার ও অবশিষ্ট ম্যাচটিতে ড্র করে বাংলাদেশ।

  • ২০১৯ সাল

১৯ বছরের টেস্ট ক্রিকেট অঙ্গনে বিচরণে বাংলাদেশ ক্রিকেটে যতটা পরিণতিবোধ, উন্নতি আসার কথা ছিল এই বছরে এসে তার বিপরীত দিকটাই উন্মুক্ত হয় ক্রিকেট বিশ্বের সামনে। নিউজিল্যান্ড সফরে স্বাগতিকদের বিপক্ষে দুই টেস্টেই ইনিংস ব্যবধানে হারের পর টেস্ট ক্রিকেটের নবীনতম দল যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানদের বিপক্ষে ঘরের মাঠে নিজেদের পয়মন্ত ভেন্যু বলে বিবেচিত চট্রগ্রামে বৃষ্টিবিঘ্নিত টেস্ট ম্যাচে হেরে বসে বাংলাদেশ। পুরো টেস্টে চরম বাজে পারফর্ম করা বাংলাদেশ বৃষ্টির আশীর্বাদে শেষ বিকেলে চার উইকেট নিয়ে মাত্র ১৮.৩ ওভার টিকে থাকতে পারলেই যেখানে টেস্টে হার এড়ানো যেতো সেখানেই উল্টো হেরে গিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট যেন প্রবেশ করে দুঃস্বপ্নের গহবরে৷

নির্ধারিত ভারত সফরে আগমুহূর্তে আসে ১১ দফা দাবিতে ক্রিকেটারদের বিদ্রোহ। বিদ্রোহের রেশ কাটতে না কাটতেই জুয়াড়ির কথোপকথনের তথ্য আকসুকে জানাতে ব্যর্থ হওয়ায় সবধরনের ক্রিকেট থেকে আইসিসি কর্তৃক এক বছরের নিষেধাজ্ঞার খবর আসে সাকিব আল হাসানের। টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তির পর প্রথমবারের মতো পূর্ণাঙ্গ সিরিজ খেলতে বাংলাদেশকে ভারত সফরে যেতে হয় সাকিবকে ছাড়াই। টেস্টের নতুন অধিনায়ক মুমিনুল হকের নেতৃত্বে ইনদোর টেস্ট হারের পর কলকাতায় অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক গোলাপী বলের দিবারাত্রির টেস্ট ক্রিকেটে ইনিংসে ব্যবধানে হেরে যায় বাংলাদেশ।

টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেকের মতো দিবারাত্রির টেস্ট ক্রিকেটেও বাংলাদেশের অভিষেকটা হয়েছিল প্রতিবেশী ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে। কিন্তু তাতেই ফলাফল অংশ লেখা থাকবে ইনিংস হারের লজ্জা।

যতটা ম্যাচ, ততটাই পরাজয়, কিছু আছে ড্র আর কিঞ্চিৎ থাকে জয়- টেস্টের পথচলার পর এভাবেই চলছিল বাংলাদেশের ক্রিকেট। আর এই বছরের ক্যানভাসের পুরো ছবিটায়ই পরাজয়ের আঁকিবুকি।

  • ২০২০ সাল

বছরের শুরুতেই পাকিস্তান সফরে যায় বাংলাদেশ। কিন্তু পাকিস্তানের বিপক্ষে হওয়া একমাত্র টেস্টেও ইনিংস হারের লজ্জায় ডুবতে হয় মুমিনুল হকের দলকে।

বাংলাদেশ তার সবশেষ টেস্ট ম্যাচটি খেলেছে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার আগে ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। সেখানে মুশফিকুর রহিমের দ্বিশতক আর অধিনায়ক মুমিনুলের জোড়া শতকে ভর করে সফরকারীদের ইনিংস ও ১০৬ রানের বড় ব্যবধানে হারিয়েছে বাংলাদেশ। এই টেস্টটিতে ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতেছিলেন মুশফিকুর রহিম।

এই বছরের জুনে বাংলাদেশ সফরে আসার কথা ছিল অস্ট্রেলিয়ার। কিন্তু করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে সে সফর ও বাংলাদেশ -পাকিস্তান টেস্ট ম্যাচটি এবং বাংলাদেশের শ্রীলঙ্কা সফর বাতিল/স্থগিত হওয়ায় আইসিসির নির্ধারিত সূচির ৩/৫ টি টেস্ট ম্যাচে মাঠা নামা হচ্ছেনা বাংলাদেশের।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...