প্রায় দুই দশক পেরিয়ে গেলেও বিশ্ব সেরার খেতাবটা নিজেদের করে নিতে পারেনি ব্রাজিল। কাতার বিশ্বকাপের আগে তাই রাজপুত্রের কাছে ছিল বিশ্বকাপ ঘরে ফিরিয়ে আনার আবদার। তিনিও চেষ্টার কমতি রাখেননি, সার্বিয়ার বিপক্ষে চোটে পড়ে ছিটকে যাবার পরও ফিরে এসেছেন প্রবলভাবে।
অতিরিক্ত সময়ে একক দক্ষতায় অনিন্দ্যসুন্দর এক গোলে দলকে এগিয়েও নিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি, টাইব্রেকারে ক্রোয়েশিয়ার কাছে হেরে আরও একবার শেষ আট থেকে বিদায় নিতে হয়েছে ব্রাজিলকে। রাজপুত্র নেইমারের তাই মহাতারকা হয়ে ওঠা বোধহয় আর হল না। ২০১৪, ২০১৮-এর পর ২০২২ সালের বিশ্বকাপটাও মিস হল ব্রাজিলের, মিস হল নেইমারের।
দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে দ্বিতীয় রাউন্ডের ম্যাচে ফিরিয়ে এনেছিলেন পেলে-গ্যারিঞ্চাদের জোগো বোনিতোর স্মৃতি। কোয়ার্টার ফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষেও মন্দ খেলেছে ব্রাজিল এমনটা কেউ বলতে পারবে না। নেইমার চেষ্টা করে গেছেন, কখনো উইং দিয়ে আবার কখনও দূরপাল্লা থেকে জোরালো শটে। কিন্তু সবই আটকে গেছে লিয়াভকোভিচ নামের এক ক্রোয়াট দানবের সামনে।
কিন্তু অতিরিক্ত সময়ে আর আটকে রাখা যায়নি, একাই পুরো ক্রোয়াট রক্ষণভাগকে বোকা বানিয়ে বল জালে ঠেলে পুরো ব্রাজিলকে ভাসালেন আনন্দের আতিশয্যে। কাতারের এজুকেশন স্টেডিয়াম তখন পরিণত হয়েছে এক টুকরো ব্রাজিলে, চারিদিকে কান পাতা দায়।
কিন্তু, ফুটবল বিধাতার ভাবনাটা বোধহয় অন্যরকম, নইলে পরের দশ মিনিটে কেন ছন্নছাড়া হবে ব্রাজিল। টাইব্রেকারে দুর্বল সব শট মারবেন রদ্রিগো-মার্কুইনহোসরা। শট নেবার আগে কেনই বা হারের যন্ত্রণায় কাঁদতে হবে ব্রাজিলের রাজপুত্রকে!
বিশ্বকাপ প্রতিবারই নেইমারের জন্য বয়ে এনেছে যন্ত্রণার উপলক্ষ। ২০১০ বিশ্বকাপে কার্লোস দুঙ্গা দলে ডাকেননি বয়সের অজুহাতে, চার বছর বাদে মেরুদন্ডের যন্ত্রণায় কাতরে মাঠ ছাড়তে হয়েছে। বাইরে বসেই দেখতে হয়েছে দলের লজ্জাজনক হার।
রাশিয়া বিশ্বকাপেও ফুলফিট ছিলেন না, দুর্বল এক দলকে টেনে নিয়েছিলেন কোয়ার্টার পর্যন্ত। কিন্তু শেষতক থিবো কোর্তোয়া নামের এক অতিমানবে আটকে গিয়েছিলেন। এবারের বিশ্বকাপেও ইনজুরি সারিয়ে ফিরে এসেছিলেন আরো একবার ব্রাজিলকে আনন্দে ভাসানোর উপলক্ষ এনে দিতে, কিন্তু আরো একবার আটকে গেলেন শেষ আটে।
অথচ কোয়ার্টার ফাইনালে গোল করে ব্রাজিলের পক্ষে সর্বোচ্চ গোলের তালিকায় পেলেকে স্পর্শ করেন। বর্তমানে নেইমারের গোল ৭৭টি, আর এক গোল করলেই ছাপিয়ে যাবেন কালো মানিককে। রোনালদোর পর দ্বিতীয় ব্রাজিলিয়ান হিসেবে তিনটি ভিন্ন বিশ্বকাপে গোলের রেকর্ডও তাঁর দখলে।
হারের পরপরই পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী দলের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন ব্রাজিলের কোচ তিতে। এছাড়া চার বছর বাদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার বিশ্বকাপে নেইমারকে দেখার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। তিনি নিজেও স্বীকার করে নিয়েছেন সেটা।
ম্যাচ শেষে বলেছেন, ‘আমার জাতীয় দলের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবার জন্য খানিকটা সময় লাগবে এবং সবার জন্য ভালো এমন সিদ্ধান্তই নেব। আমি এখনই নিজের জন্য জাতীয় দলের দরজা বন্ধ করে দিচ্ছি না, তবে শতভাগ নিশ্চিত নই ফেরার ব্যাপারে। আমার কাছে সব কিছু দু:স্বপ্নের মতো লাগছে, বিশ্বাস করতে পারছি না। এই হার আমাকে বহুদিন পোড়াবে।’
পেলেকে ছোঁয়ার স্বপ্ন নিয়ে এবারের বিশ্বকাপে পা রেখেছিলেন নেইমার। কিন্তু ট্র্যাজিক হিরো হয়েই এবারের বিশ্বকাপ থেকে বিদায় ঘটলো তাঁর। এখন দেখার বিষয় ২০২৬ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের হয়ে আরো একবার সুযোগ পান কিনা নেইমার। অন্যথায় পেলে নয় বরং সক্রেটিস-ফ্যালকাও হয়েই ক্যারিয়ারের ইতি টানতে হবে ব্রাজিল ফুটবলের দু:খী রাজপুত্রকে। নাকি, ২০২৬ সালে শেষ একটা চেষ্টা করবেন?