তোমার বাড়ি আমার বাড়ি, আমার বাড়ি নেই

পিটারসেনরাই পারেন শেন ওয়ার্নকে স্পিনের বিপরীতে মিড উইকেটের উপর দিয়ে ফেলে দিতে, গ্লেন ম্যাকগ্রার একাগ্রতাকে কভার বাউন্ডারিতে ধাক্কা মারতে, ডেল স্টেনের বিষাক্ত আউট স্যুইং হেঁটে গিয়ে মিড উইকেট দিয়ে ফ্লিক করতে অথবা স্যুইচ হিট জনপ্রিয় করে মুরালিধরনের মতো বড় স্পিন করা অফস্পিনারকে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টের উপর বাউন্ডারির বাইরে ফেলে দিতে। মার্জিত ভাষায় বলে আত্মবিশ্বাস আর রকের ভাষায় আমরা বলি ‘রেলা’!

ইংল্যান্ডের ক্রিকেটের সাম্প্রতিক ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে যদি খুঁজতে যাই গত পঞ্চাশ বছরের সেরা ব্যাটসম্যান কে, তাহলে অধিকাংশ উত্তরই আসবে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত অ্যালিস্টেয়ার কুক। একটা সময় ভাবা হয়েছিল শচীন টেন্ডুলকারের রেকর্ড ভেঙে দেবেন অ্যালিস্টেয়ার কুক। কিন্তু মাত্র ৩৪ বছর বয়সে ১৬১ টেস্টে প্রায় সাড়ে বারো হাজার রান আর তেত্রিশটা সেঞ্চুরিতে থেমে যায় কুকের রান মেশিন।

কিন্তু বরাবরের আমি, প্রথাগত পথে না হাঁটা আমি, যার ফেভারিট শচীন নয়, সৌরভ নয়, ম্যারাডোনা নয়, মাধুরী নয়, তাকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়। উত্তর আসবে কেভিন পিটারসেন! কেভিন পিটারসেন? সেই লোকটা যার টেস্ট ক্যারিয়ার মাত্র দশ বছর টিকেছিল। যে না ঘরকা না ঘাটকা। পিতৃভূমি দক্ষিণ আফ্রিকা স্বেচ্ছায় ছেড়েছিলেন, জাতীয় দলে ৫ জন কালার্ড ক্রিকেটার খেলাতেই হবে এই নীতির প্রতিবাদে অথচ মাতৃভূমি ইংল্যান্ডেও থিতু হতে পারেননি। শেষে, ২০১৪ তাঁকে জানিয়ে দেওয়া হয় যে ইংল্যান্ডের জাতীয় দলে তাঁর আর জায়গা নেই।

অধিনায়ক থাকাকালীন, কোচের সঙ্গে ঝগড়া, অধিনায়ক না থাকাকালীন ক্যাপ্টেনের সঙ্গে, নির্বাচকদের সঙ্গে, সাংবাদিকদের সঙ্গে, বোর্ডের সঙ্গে, কার সঙ্গে না হয়নি মনমালিন্য, মন কষাকষি। মাত্র তিনটে টেস্ট আর দশটা ওয়ানডেতে অধিনায়কত্বের পরেই ছেড়ে দেন অধিনায়কত্ব। সেই কেভিন পিটারসেন?

হ্যাঁ, সেই কেভিন পিটারসেন। মনে করে দেখি প্রথম গুরুত্বপূর্ণ একদিনের সিরিজ। বিপক্ষে পিতৃভূমি দক্ষিণ আফ্রিকা। তাদের মাটিতেই। সারা সিরিজ ধরে পিটারসেনকে শুনতে হল সে দেশদ্রোহী, বিশ্বাসঘাতক। বড় হয়েছে যে দেশে, সেই দেশ ছেড়ে চার বছর অপেক্ষার পর ইংল্যান্ডের হয়ে খেলতে চলে গেলে শুনতে হতেই পারে। যদিও কেভিনের কারণ ছিল।

এমন দলে সে খেলতে পছন্দ করত না যেখানে শুধুমাত্র ক্রিকেটীয় কারণে নির্বাচন হয় না। অশ্বেতাঙ্গ ক্রিকেটার যথেষ্ট আছে কি না সেটাও দেখা হয়। কেভিন প্রতিবাদ করতে পারে, তার সুযোগ ছিল তাই মায়ের জন্মভূমি ইংল্যান্ডের হয়ে খেলতে চলে যায়। কিন্তু দর্শকদের নিরবচ্ছিন্ন টিটকারির  মধ্যে নেমেও পাঁচটি সীমিত ওভারের ম্যাচে অনবদ্য ৪৫৪ রান করলেন তিনি। ইংল্যান্ড ৪-১ এ সিরিজে হারলেও পিটারসেন সিরিজ সেরা। তিনটা সেঞ্চুরি। সিরিজ শুরুর টিটকারি সিরিজের শেষে অভিনন্দনে পর্যবাসিত।

এরপর? এরপর সেই মহামূল্যবান অ্যাশেজ। ২০০৫ আমার দেখা সেরা টেস্ট সিরিজ। স্টিভ ওয়র অস্ট্রেলিয়ার ফাইনাল ফ্রন্টিয়ারে পরাজয় তো মাত্র ৩ টেস্টের ছিল। অস্ট্রেলিয়া বুঝে ওঠার আগেই সিরিজ হেরে যায় এক ঝটকায়। কিন্তু অ্যাশেজ ছিল ৫ টেস্টের। প্রথম টেস্ট হেরে ইংল্যান্ড  ফিরে আসে। পরের দুই টেস্ট জিতে নেয়। চতুর্থ টেস্ট জিততে জিততে রয়ে যায়। আর পঞ্চম টেস্ট? শেন ওয়ার্নের শেষ টেস্ট, গ্লেন ম্যাকগ্রা ফিরে এসেছেন চোট সারিয়ে।

প্রথম ইনিংসে মাত্র ৬ রানে এগিয়ে থেকে দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করেছে ইংল্যান্ড এই বৃষ্টি বিঘ্নিত শেষ টেস্টে। লাঞ্চে ১০০ রানে এগিয়ে হাতে পাঁচ উইকেট। অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক পন্টিং বল তুলে দিয়েছেন তাঁর সর্বকালের অন্যতম সেরা বোলিং জুটি ওয়র্ণ ও ম্যাকগ্রার হাতে। উল্টোদিকে ব্যাট হাতে পিটারসেন। কেভিন পিটারসেন। সিরিজটা মোটামুটি গেছে তাঁর। প্রথম টেস্টের দুই ইনিংসে পঞ্চাশ।

আর মাত্র একটি পঞ্চাশ করেছেন তিনি। ইতোমধ্যেই ক্রিকেট বিশ্ব দেখে নিয়েছে যে ছ ফুট তিন ইঞ্চির এক মূলত ফ্রন্টফুটে খেলা ব্যাটসম্যান তাঁর উচ্চতাকে কাজে লাগিয়ে ম্যাকগ্রা, গিলেস্পি, ক্যাস্প্রোউইচ এবং সর্বোপরি শেন ওয়ার্ন নৈপুণ্যের সঙ্গে খেলে দিচ্ছে। মাথার মাঝে সোনালি মোহক দু পাশ কালো, পুল মারে ফ্রন্টফুটে, স্কোয়ার কাটও তাই, শেনকে অবলীলাক্রমে স্পিনের বিপরীতে মিড উইকেটের উপর দিয়ে উড়িয়ে দেয়। এমন কি ম্যাকগ্রাকেও সমীহ করে না সেই ছেলে।

সেই ছেলে, তার প্রথম টেস্ট সিরিজে, প্রথম অ্যাশেজ সিরিজে প্রাচীর হয়ে দাঁড়াল অস্ট্রেলিয়ার অ্যাশেজ ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সামনে। ১৯৮৯ থেকে জিতে আসছে অস্ট্রেলিয়া। ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বাধিক পরিচিত এই দ্বৈরথ। ১৯৯৭ ছাড়া প্রতিবারই একের বেশি টেস্টের মার্জিনে। সেই অস্ট্রেলিয়া ২-২ করতে পারলেই উইকেট পোড়া ছাইয়ের সেই ছোট্ট কাঠের আধারটিকে নিয়ে ফিরে যাবে ক্যানবেরায় ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার হেডকোয়ার্টারে। কিন্তু ওই ছ ফুট তিনের দক্ষিণ আফ্রিকীয় তরুণ কী খেলাটাই না খেললেন। এলেন ওয়ার্ন, স্থান হল মিড উইকেট বাউণ্ডারি আর লং অফের বাইরে। ম্যাকগ্রাকে পরপর আছড়ে ফেললেন কভার সীমানায়। গিলেস্পি ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্ট আর অফ স্ট্যাম্পের উপর হেঁটে গিয়ে মিড উইকেট দিয়ে ফ্লিক। ১৫৮য় যখন পিটারসন থামলেন। অস্ট্রেলিয়ার মাত্র ১ ওভার ব্যাট করার সময়।

সেই শুরু। এরপর নয় নয় করে বেশ অনেকগুলি প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলে ফেললেন পিটারসন। ২০১০ অ্যাসেজ, ইংল্যান্ড প্রথম অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অ্যাশেজ জিতল ৩৪ বছর পর। পিটারসনের ব্যাটে রান ছিল না, প্রায় দু’বছর টেস্টে সেঞ্চুরি নেই। সেই পিটারসন, মাঠে নামলেন যখন, ট্রট এবং কুকের দৌলতে ইংল্যান্ড অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংসের মাত্র ২০ রান দূরে। জেভিয়ার ডোহার্টি বাঁ হাতি স্পিনার।

নেওয়াই হয়েছিল টিমে, পিটারসেনের বাঁ হাতি স্পিনারদের বিরুদ্ধে আপাতত দুর্বলতার কারণে। দ্বিতীয় বল লঙ অফের উপর দিয়ে উড়ে গেল। তৃতীয় বলে আবার স্টেপ আউট, কিন্তু ব্যাটে বলে ঠিক হল না। বল কভার আর পয়েন্টের মাঝে বেশ কিছুটা সময় ধরে ঝুলে রইল। পিটারসন সামলে নিলেন নিজেকে। সদ্য তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরেছেন কোচ গ্রাহাম ফোর্ডের পরামর্শ নিয়ে।

এমনিতে যদি কেভিনের ব্যাটিং দেখেন, ব্যাটিং স্ট্যান্সটা অনেকটা আইফেল টাওয়ারের মতো, দুটো পা বেঁকে অনেকটা  দূরে দাঁড়িয়ে একটা পঞ্চভুজ তৈরি করেছে। ব্যাট হাওয়ায় দুলছে, গ্রিপ হ্যাণ্ডেলের উপর দিকে, উপরের হাতটা প্রায় পিছনের দিকে ঘোরানো আর তিন আঙুলে নিচের হাত ধরে আছে গ্রিপের মাঝামাঝি। খেলে দিচ্ছেন তিনি, কিন্তু ফোর্ড ধরে দিলেন মাথা যাচ্ছে না বলের উপর। বেশ কথা। মাথা বলের উপর যেতে শুরু করল।

মাথা খেলাতেও যেতে শুরু করল। অ্যাডিলেডে মালুম পেল অস্ট্রেলিয়ার বোলাররা। ডোহার্টি ছাড়াও, ডগ বলিঞ্জার, মিশেল জনসন সিরিজ শুরু হতে না হতেই  টেস্ট ক্রিকেট থেকে সাময়িকভাবে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। মানসিকভাবে দূরে চলে গেছেন বলে, তার জায়গায় এসেছেন বলিঞ্জার, রায়ান হ্যারিস আর পিটার সিডল। সাম্প্রতিক অতীতে বেশ কয়েকবার সিডল পিটারসেনকে শিকার করেছেন। এবারেও তৈরি স্কোয়ারলেগ, লং লেগ আর ডিপ মিডউইকেট নিয়ে।

পিটারসেনও তৈরি, তাঁর নির্দেশিকা নিয়ে। গোদা গোদা অক্ষরে নির্দেশিকার প্রথম বিন্দুতে লেখা আছে, শর্ট অব লেন্থ বল যেন বাউন্ডারি খুঁজে নিতে পারে, প্রয়োজনে ব্যাট দিয়ে সেই খোঁজে সাহায্য করতে হবে। একটা লম্বা স্ট্রাইড অফ মিড বরাবর, শর্ট বল তারপর পিছন দিকে হেলে মাটি কামড়ে বারবার ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসতে লাগল বিলবোর্ডে। ডোহার্টির বলে যখন থামলেন ততক্ষণে তাঁর নিজের সর্বাধিক ২২৭ করা হয়ে গেছে।

অথবা ওয়াংখেড়েতে ২০১২-এর ১৮৬। পাকিস্তানের কাছে সদ্য ৩-০ হেরে ভারতে এসেছে ইংল্যণ্ড। ভারত ফুটছে ইংল্যণ্ডে ০-৪ হারের বদলা নেবার জন্য। প্রথম টেস্টে ইংল্যণ্ড হারল ৯ উইকেটে। কিন্তু খেলা ঘোরালেন পিটারসন। ওয়াংখেড়ের বাদামী খোঁয়াড়ে রবিচন্দ্রন অশ্বিন, প্রজ্ঞান ওঁঝা এবং হরভজন সিং-এর চামড়া ছাড়িয়ে খেলা ঘোরানো ১৮৬। সেঞ্চুরি এল মাত্র ১২৬ বলে।

ধূসর ভঙ্গুর পিচে স্পিন খেলার এক নতুন কোচিং ম্যানুয়াল লিখলেন তিনি। কুক সেঞ্চুরি করেছিলেন। কিন্তু পিটারসন অন্য জাতের সেঞ্চুরি। সেখানে লড়াইটড়াইয়ের জায়গা নেই। হাতে ব্যাট, স্পিনবোলারদের স্থান প্যাভিলিয়নে। যে ঝটকাটা লাগল, ভারত সামলাতে পারল না। গ্রেম সোয়ান আর পানেসরের হাতে পরাস্ত হল ২-১এ সিরিজ হার ভারতের।

তবে লড়াই কি কেভিন করেননি নাকি? মাঠের বাইরের লড়াই ছাড়াও দেখি দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে মাঠের ভিতরের লড়াই। এই সিরিজেই ইংল্যণ্ড অধিনায়ক অ্যাণ্ড্রু স্ট্রাউসের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটারদের মেসেজ করে বসেন কেভিন। অথচ হেডিংলেতে ডেল স্টেন, মরনে মরকেল, ভার্নন ফিলান্ডারদের পেস সহায়ক উইকেটে সামলে যে ১৪৯ করলেন তার তুলনা মেলা ভার। ২১তম টেস্ট সেঞ্চুরি কেভিনের।

এরপরে আর বড়জোর  দেড় বছর। অস্ট্রেলিয়ায় মিশেল জনসনের ফিরে আসার সিরিজে কেভিন রান করলেন ইংল্যণ্ডের হয়ে সর্বাধিক। কিন্তু অধিনায়ক অ্যালিস্টেয়ার কুকও সেই স্ট্রস পরবর্তী ঘটনা থেকেই জানিয়ে দিলেন যে কেভিন পিটারসেনকে টেস্ট টিমে চান না। দলগত সঙ্ঘটির পক্ষে কেভিনের আচার ব্যবহার বড় বাধা। আর ফেরা হয়নি কেভিন পিটারসেনের।

বস্তুত ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ডের (ইসিবি) সঙ্গে বারবার সংঘাত বেঁধেছে পিটারসেনের। অধিনায়কত্ব করেছেন মাত্র ৩টি টেস্ট এবং ১০টি একদিনের ম্যাচ। বিশেষ মনে থাকার কথা মুম্বই উগ্রপন্থী হানার সময় ইংল্যণ্ড ভারতেই তখন। ৫-০ হারছে সিরিজ। অধিনায়ক কেভিন পিটারসেন দুটো পঞ্চাশোর্ধ রান করলেও দলের ভাগ্য ফেরাতে পারেননি।

২৬ নভেম্বরের পর শেষ দুটি একদিনের ম্যাচ না খেলেই ফিরে যায় ইংল্যণ্ড দল। কিন্তু অধিনায়ক হিসাবে পিটারসন তার স্বভাবসিদ্ধ ডাকাবুকো মনোভাবেই জানান যে ভারতে খেলা ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। টেস্ট সিরিজ যেন জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হয়। কারণ উগ্রপন্থার কাছে ক্রিকেট হেরে যাবে অধিনায়ক থাকতে কেভিন তা হতে দেবেন না। দেনওনি। আর তারপরেই সেই বিখ্যাত অথবা কুখ্যাত মন্তব্য যুবরাজ সিং-এর বোলিং নিয়ে। প্রথম টেস্টে সেই ‘পাই চাকার’ যুবরাজই তুলে নিলেন কেভিন পিটারসনের উইকেট।

তবে মূল সমস্যা সামনে এলো দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে। যেখান দল গঠন, অনুশীলন এবং সর্বোপরি টিমের মনোভাব নিয়ে কোচ পিটার মুরের সঙ্গে তাঁর সংঘাত জনসমক্ষে চলে এলো। নির্বাচক অথবা ইসিবি কর্তাদের অবশ্যই জানিয়েছিলেন পিটারসন। কিন্তু তা কে যেন কোনোভাবে মিডিয়ার কাছে ফাঁস করে দেয়। কেভিন ইস্তফা দেন অধিনায়কত্ব থেকে। মুর আগেই অপসারিত হয়েছেন।

কিন্তু পারফরম্যান্সে তার প্রভাব পড়েনি। ২০০৯ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে উল্লেখযোগ্য পারফরম্যান্সের পরে। ২০১০ বিশ্বকাপ টি-টোয়েন্টি জেতালেন ইংল্যান্ডকে তিনি। বিশ্বমঞ্চে ইংল্যণ্ডের প্রথম টুর্ণামেন্ট বিজয় পিটারসন অবিস্মরণীয় করে রাখলেন ২৪৮ রান করে এবং সেমি ফাইনাল ও ফাইনালে গুরুত্বপূর্ণ যোগদান রেখে। টুর্নামেন্টের মাঝেই অবশ্য ইংল্যান্ড উড়ে এসেছিলেন সন্তান জন্মের সময় স্ত্রীর পাশে থাকার জন্য।

কেভিন পিটারসন, ইংল্যণ্ডের সর্বাধিক ভুল বোঝা ক্রিকেটারও, বিতর্কিত কিন্তু সোনার হৃদয়ের এই ক্রিকেটারকে শুধু আমি নই, যাঁর সঙ্গে ঝামেলা থেকে ইংল্যণ্ড টিম থেকে বিতারণের সূত্রপাত সেই অ্যাণ্ড্রু স্ট্রসও স্বীকার করেছেন যে সব খেলোয়াড়দের সঙ্গে স্ট্রস ইংল্যান্ড দলে খেলেছেন কেভিন তাঁদের মধ্যে সেরা। প্রভাবে সেরা।

অ্যালিস্টেয়ার কুক হয়ত কেভিন পিটারসনের থেকে বেশি টেস্ট জিতেছেন বা টেস্ট জয়ে নিজের যোগদান দিয়েছেন। কিন্তু যে পদ্ধতি এবং যে দ্রুততার সঙ্গে পিটারসন নিজের রান করেছেন এবং দলের বিজয়ে সাহায্য করেছেন তা হয়তো কুকের উপরে নিয়ে যাবে তাঁকে। গত পঞ্চাশ বছরে বয়কট, গুচ, গাওয়ার, ভন, ট্রেসকোথিক, স্ট্রস, কুক অথবা হাল আমলের জো রুট ট্রিপল লায়নের হয়ে ব্যাট হাতে নেমেছেন।

কিন্তু, একার ব্যাটিংয়ে দ্রুততার সঙ্গে ম্যাচ ঘুরিয়ে জিতিয়ে দেওয়ায় পিটারসনের সমকক্ষ কেউ নেই। পিটারসনের দৌলতেই ইংল্যণ্ড টেস্ট ক্রিকেটে এক নম্বরের শিরোপা পেয়েছে, টেস্ট দল হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে, একদিনের আন্তর্জাতিকে বহু হারা ম্যাচ জিতেছে এবং গত একদিনের বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত একমাত্র বিশ্বস্তরীয় সাফল্য পেয়েছে।

কিন্তু এটা ঘটনা, ইংল্যান্ড তার স্টিফ আপার লিপ আর বহুদিনের মেনে আসা নিয়ম শৃঙ্খলার বেড়াজাল দিয়ে পিটারসনের প্রতিভার প্রতি সুবিচার করেনি। যদিও পিটারসন নিজেই বা কতটা করেছেন তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাবে। তবে যাই হয়েছে না কেন, অদ্ভুত ব্যাটিং স্ট্যান্স এবং ইংল্যান্ডের প্রথাগত মানসিকতার সম্পূর্ণ বাইরে গিয়ে এই ডাকাবুকো ক্রিকেটারকে ভালোবাসে না এমন ক্রিকেট দর্শক পাওয়া বিরল।

টেস্ট ক্রিকেট ছেড়ে দেবার পর টি-টোয়েন্টির পৃথিবীতে যাযাবরের জিন্দেগি অতিবাহিত করার পর পিটারসনের ব্যাট ২০১৮ সালে থেমে যায়। কোনও আড়ম্বর নেই কোনও উৎসব নেই। শুধু টুইটারে জানিয়ে দেওয়া ‘বুটস আপ, থ্যাঙ্কিউ’। এটুকুই। বিন্দাস ছিলেন বিন্দাস আছেন, ধারাভাষ্য দিচ্ছেন। এই লকডাউনের সময় বিভিন্ন ক্রিকেটারদের সঙ্গে খুনসুঁটি করছেন, সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন।

মোদ্দা কথা ক্রিকেট ছাড়তে পারেননি। আসলে পিটারসনের মত ক্রিকেটারদের মূল্যায়ন সঠিকভাবে আমরা করতে পারি না। নিত্য নৈমিত্যিক সারেগামার বাইরের কোনও চাবি টিপে যখন সুরে বাজান পিটারসনরা, মানুষ প্রথমে বিচলিত হয়, ঘরছাড়া করে তাদের। পরে হাহুতাশ করে, কেন সকল উজাড় করে দিইনি আমার মনের রাজাকে।

পিটারসনরাই পারেন শেন ওয়ার্নকে স্পিনের বিপরীতে মিড উইকেটের উপর দিয়ে ফেলে দিতে, গ্লেন ম্যাকগ্রার একাগ্রতাকে কভার বাউন্ডারিতে ধাক্কা মারতে, ডেল স্টেনের বিষাক্ত আউট স্যুইং হেঁটে গিয়ে মিড উইকেট দিয়ে ফ্লিক করতে অথবা স্যুইচ হিট জনপ্রিয় করে মুরালিধরণের মতো বড় স্পিন করা অফস্পিনারকে ব্যাকওয়র্ড পয়েন্টের উপর বাউন্ডারির বাইরে ফেলে দিতে। মার্জিত ভাষায় বলে আত্মবিশ্বাস আর রকের ভাষায় আমরা বলি ‘রেলা’!

কখনও বলেছিলাম যে গ্যারি লিনেকার আর ডেভিড গাওয়ার ছাড়া ইংল্যান্ডের কাউকে সহ্য হয়নি। পিটারসন সেই বক্তব্য খণ্ডন করিয়েছেন। অথবা হয়তো তিনি আদতে ইংলিশ নন বলেই, এভাবে বর্ণময় হয়ে জীবন কাটিয়ে যেতে পেরেছেন, পারেন এখনও।

কৃতজ্ঞতা: ময়দানী স্ক্র্যাপবুক

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...