ক্লান্তি আসলে একটা গান। আলগা হাওয়া কিংবা ছোঁয়াচ সুর পেলে জুড়িয়ে দেয় চোখ। অফিস সেরে যখন উঠছি ঘড়িতে বাজে রাত ১১ টা। বিগত কিছুদিন লেখা ও কাজের চাপে ঘুম হচ্ছে মেরেকেটে ঘন্টা চারেক। এমন কিছু অস্বস্তিকর দিনে আমার ইমরান খানকে মনে পড়ে।
বিরানব্বই-এর সেমিফাইনালে আনকোরা ইনজামামকে নামিয়ে ম্যাচ জিতিয়ে দিলেন। ম্যাচের পর হেসে বলেলেন আমি অধিনায়ক, আমি যেটা ডিসাইড করব সেটাই ফাইনাল, আমি হারতে আসিনি এটা বাকিদের বোঝা উচিত। ‘আই হ্যাভ লার্জ শোল্ডার টু ক্যারি এভরিথিং…’ ম্যাচ শেষে ক্লান্তির অন্তরায় ইমরান বুলিয়ে দিচ্ছেন তিনতালের মাদক!
সে সময়ে ভারতে এলে দিল্লীর বিখ্যাত পাঁচতারা হোটেলের লাউঞ্জে খালি গায়ে একটা তোয়ালে নিয়ে বসে থাকতেন পাক অধিনায়ক। বলিউডের তাবড় নায়িকাদের হার্ট থ্রব, দিলীপ কুমার বা রাজেশ খান্না স্ক্রিনেই আগুন ঝরাতেন আর ইমরান? মাঠে, মাঠের বাইরে সেক্সবম্ব, হোটেলের চেকইন রিসেপশনে চিঠি রেখে যেত মেয়েরা। ইমরান নাকি খুলে দেখতেন, মাঝে মাঝে হাতের লেখা ভালো লাগলে সাথে নিয়েও যেতেন।
ব্র্যাড পিট কিংবা ডেভিড বেকহ্যামের কখনো কি এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়নি নিজেকে আয়নায় দেখে অদৃশ্য হাত দিয়ে চাপড়ে দিতেন নিজেরই পিঠ? এই প্রশ্নচিহ্নকেই সপাটে প্রত্যাখ্যান করেন ইমরান।
আত্মতৃপ্তির দৈবসুখকে ছুঁড়ে ইমরান হাতে তুলে নেন নিষ্ঠুর চাবুক, যা কেবলই নিজের ক্লান্তি-তৃপ্তির ওপর প্রয়োগ করা যায়। রূপ-যশ-প্রতিভার এমন নিখুঁত বুনোট যার শরীরে বুনে দিয়েছেন সেই মানুষটা কেন এমন টো টো করে ঘুরে বেরাচ্ছেন সারাজীবন? রাজনীতির ময়দান তো দূর, লোকটা তার অনেক আগে থেকেই ঘুরছেন পাকিস্তানের আনাচ-কানাচ। মিয়াদাদ থেকে আব্বাস, ওয়াসিম সকলেই তো কমেন্ট্রি বা ক্রিকেট বিশ্লেষক হয়ে কোটি কোটি টাকা কামাচ্ছেন তাহলে ইমরান কই?
এখানেই আসল ইমরান, এখানেই ইমরান খান তার সমস্ত ঐশ্বরিক প্রতিভাকে মুঠোর ভেতর এনে ফেলতে পারেন। ফাস্ট বোলার হিসেবে জীবন শুরু করলেন, বিশ্বের ত্রাস ফাস্ট বোলার হলেন। অলরাউন্ডার হবার তারণায় ব্যাটিং-এ ধার বাড়ালেন, সেখানেও অবিসংবাদী এক নম্বর। অধিনায়ক হবার পর পাকিস্তানকে দিলেন অধরামাধুরী, উপমহাদেশ এমন অধিনায়ক আর পেল ক’জন? কিন্তু তারপর? ভ্যানিশ!
নব্বই-এর মাঝামাঝিই জোর গুজব ইমরান নাকি পাকিস্তান বোর্ডের সব টাকা নিজের ক্যান্সার হাসপাতাল তহবিলে পাচার করছেন। এ বিষয়ে কথা হতে কিচ্ছু বললেন না তিনি, নি:শব্দে সরে গেলেন ক্রিকেট থেকে। ক্রিকেট ছেড়েই ক্যান্সার হাসপাতাল, সেখান থেকে রাজনীতিতে আসা, সেখান থেকে লাহোরে সেচের জল প্রকল্পে নিজে হেঁটে হেঁটে এলাকা পর্যবেক্ষন, পাকিস্তানে কুষ্ঠ রোগীদের জন্য ক্লিনিক তৈরির টাকা তুলতে হাত মেলালেন অখ্যাত কলেজপড়ুয়াদের সঙ্গে- সফল রাজনীতিবিদ এবং উপমহাদেশের সবচেয়ে উত্তপ্ত রাজনীতির দেশের প্রধানমন্ত্রী!
ইমরান নিজের যাপন খোলামুকুচির মতো ওড়াচ্ছেন পড়ন্ত দিনের হাওয়ায়। ‘ক্রিকেট খেলেছি, এক নম্বর হয়েছি, ব্যস, আর ঐ মৃত কাঠামোয় ফিরে তাকাব না’ – রাজনীতিতে পা দিলে সর্বোচ্চ জায়গায় যাব, সেখান থেকে আচমকা একদিন ছেড়ে পালিয়ে যাব, হয়ত পালিয়ে যাব কোনো নিশ্চিন্দিপুরে। ইমরান নাকি গত একুশ বছর রাতে ৪ ঘন্টা ঘুমোন। বাকি ১৭ ঘন্টা শুধু কাজ, কাজ আর কাজ, কিন্তু কীসের এত ক্ষিদে?
ইমরান জানেন শেষবার তিনি হ্যান্ডশেক করতে গিয়ে বলবেন, ‘ Dear, I have done my best, and I left no stones unturned to be the best.. ’ রফি সাবের বন্দীশে বেজে ওঠে ইমরানের জীবনদর্শন – ‘ইয়ে দুনিয়া আগার মিল ভি জায়ে, তো ক্যায়া হ্যায়?’
পৃথিবীতে প্রতিটা মানুষের একটা বেস্ট ভার্সান থাকে। জীবনের পাথরের ওপর অক্লান্ত পরিশ্রমের ছেনি হাতুরি দিয়ে আঘাত করে তাকে বের করে আনতে হয়। ইমরান বলেন, এই শ্রেষ্ঠ ভার্সানটা বের করার আগে পৃথিবী যদি মুঠোতেও চলে আসে, কী যায় আসে?
অনেক রাতে ক্লান্ত শরীরে ইমরানকে নিয়ে কিছু লিখতে গেলে ক্লান্তি বাড়ে না, দূর হয়ে যায়, ইমরান ম্যাজিক আঁকড়ে মনে মনে বলি- ‘ইয়ে দুনিয়া আগার মিল ভি জায়ে তো ক্যায়া হ্যায়…’