মর্ত্যে থাকা সেদিনের দেবদূত!

‘প্রথমে আমি ভেবেছিলাম লাহোরে হয়তো মানুষজন বাজি ফোটাচ্ছে। কিন্তু এরপর দুজন যখন আমার দিকে এগিয়ে আসল আর আমার দিকে বন্দুক ধরল আমি বুঝতে পারলাম এখানে কি ঘটছে। পেছন থেকে ক্রিকেটাররা ‘গো’ ‘গো’ করে চিৎকার করছিল। এতে বন্দুকধারী যেন আরো ক্ষেপে উঠছিল। আমার কাছে সেটা ৪৪০ ভোল্টের মত শক ছিল। আমি নিজেকে শান্ত করলাম, এরপর থ্রটল চেপে ধরলাম। খেলোয়াড়েরা টিম হোটেল থেকে ফিরছিল, জঙ্গিরাও সংখ্যায় ১০-১২ জন ছিল। আল্লাহকে ধন্যবাদ। আমি নিজে খুবই আত্মবিশ্বাসী ছিলাম আর খেলোয়াড়দের নিরাপদেই স্টেডিয়ামে নিয়ে গেছিলাম।’

কথাগুলো মেহের খলিলের, লাহোরের মেহের খলিল। দশ বছর আগের মেহের খলিল।

দশটা বছর কম সময় নয়, স্মৃতির রোমন্থন তাও বারেবারেই হয়, ভাগ্যিস সেদিন তিনি ছিলেন সাথে, স্টিয়ারিংয়ের বুদ্ধিদীপ্ত হাতে।

হ্যাঁ, বছর দশেক তো পার হয়েই গেছে। কিন্তু ২০০৯ এর স্মৃতি এখনও যেন ফিরে ফিরে আসে, চকিত চাউনিতে মনে করিয়ে দেয় ক্রিকেটের গায়ে হাত দিয়েছিল কালো ছোবলের সাপ। ক্রিকেট নিস্তার পায়নি, যেমন নিস্তার পায়নি সেদিনের ২ জন আমজনতার মানুষ আর ৬ জন পাকিস্তানি পুলিশ, জীবন দিতে হয়েছিল তাদের। ৬ জন শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটারও তো আহত হয়েছিলেন। পাকিস্তান নিষিদ্ধও থেকেছে বেশ অনেকদিন, কিন্তু বাকি ক্রিকেটাররা নিস্তার পেলেন আরেকজনের গুণে- মেহের খলিল!

মেহের খলিল সেদিন ছিলেন শ্রীলঙ্কা দলের বাস ড্রাইভার। ইংরেজিতে একটা কথা আছে ‘ফিঙ্গার ক্রসড’। ঠিক এরকমভাবেই তিনি বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন গোটা শ্রীলঙ্কান দলের ক্রিকেটারদের। পাহাড়সম বিপদের মধ্যে, অস্ত্রধারী জঙ্গিদের সামনে যিনি শান্ত থেকেছেন, স্টিয়ারিং ঘুরিয়েছে, বাসকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে গেছেন।

আগেই তো বলা হয়েছে, সে ঘটনার পর অনেকদিন ক্রিকেট থেকে নির্বাসিত থেকেছে পাকিস্তানের ক্রিকেট স্টেডিয়ামগুলো। তবে সে নির্বাসনও কেটে গেছে। নির্বাসন থেকে পাকিস্তানের সিরিজ ছিল জিম্বাবুয়ের সাথে। সেদিন কিন্তু কেউই মেহের খলিলকে ভুলে যায়নি। বহুদিন পর ফেরা সিরিজের প্রথম ম্যাচেই পিসিবি লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল খলিলকে। খলিল অবশ্য খুব বেশি প্রতিক্রিয়া জানাননি। তিনি বলেছিলেন, এই ঘটনা মনে রাখার চাইতে ভুলে যাওয়াই ভাল।

আসলেই তাই। যত বীরত্বই হোক, যত অসম সাহসেরই পরিচয় তিনি দেন না কেন, নিজ দেশের জঙ্গি হামলার ঘটনা ভুলে যেতে কে না চাইবে!

যা হোক, পিসিবির আমন্ত্রণে গিয়ে সেদিন মেহের খলিল সেদিন লাহোরে আরেকটা দাবিও জানিয়েছিলেন। তিনি প্রথম টি-টোয়েন্টিতে জিম্বাবুয়ে দলের বাসটি ড্রাইভ করতে চান। বহু পুরনো ইচ্ছে বলতে হবে। পুরনো কেন? কারণ মেহের খলিল এখন আর বাস চালান না।

তিনি এখন একটা বাস কোম্পানির মালিক। এর পুরো কৃতিত্ব অবশ্য শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট বোর্ডের। নিজের দেশের ক্রিকেটারদের বাঁচানোর কৃতজ্ঞতা স্বরূপ শ্রীলঙ্কান সরকার মেহেরকে ডেকে নিয়ে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিল। টোকেন হিসেবে দিয়েছিল ২১ হাজার মার্কিন ডলার। আর তা দিয়েই এই বাস কোম্পানি হয়েছে খলিলের।

তা শ্রীলঙ্কা সরকার মেহেরকে কতটা খাতির করেছিল সেটা তো এএফপিকে দেওয়া খলিলের সাক্ষাৎকারেই স্পষ্ট। তিনি সেখানে বলেন, ‘প্রথমে শ্রীলঙ্কা দলের খেলোয়াড়েরা আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। আমি তখন ওদেরকে বলেছিলাম আমি পরিবার নিয়ে থাকতেই পছন্দ করি আর সেসময়ও তাই থাকব। কিন্তু ওটার এক মাস পর শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট আমাকে আমন্ত্রণ করে আর আমি সেখানে যাই। আমি যখন শ্রীলঙ্কার বিমানবন্দরে নামি, আমার মনে হয় ড্রাইভার মেহের খলিল এখানে আসেনি। এখানে যে এসেছে সে একজন ভিভিআইপি। আমি সেখানে যতদিন ছিলাম, আমি যখন বাজারে যেতাম , বাইরে যেতাম, মানুষ আমাকে হিরো বলত।’

লাহোরে দাঁড়িয়ে খলিল বলেছিলেন তিনি ভুলে যেতে চান। এএফপিকেও তাই বলেছেন। মনে হয় খুব ভুল কিছু বলেননি।

অবশ্য ট্রাজিক থ্রিলার শুধু গল্পেই মানায়, জীবনে হলে তা ভুলে যেতে হয়।

লেখক পরিচিতি

আদ্যোপান্ত স্টোরিটেলার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link