ইমরানের ইটের জবাবে কপিলের পাটকেল

তার ঠিক আগে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ণে ফাইনালে পাকিস্তানকে হারিয়ে বেনসন হেইজেস কাপ জিতে এসেছে ভারত ১২ দিন আগে আর পাকিস্তান তখন ছিল বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্রিকেট টিম।

পাঁচ জুন, ২০১৯। ভারত বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচ।

১৯ জুন, ২০১৯। নিউজিল্যান্ড বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচ।

২১  জুন, ২০১৯। শ্রীলঙ্কা বনাম ইংল্যান্ড ম্যাচ।

এবং ২২ জুন ২০১৯, ভারত বনাম আফগানিস্থানের এপিক ম্যাচ।

বড় স্কোরের ২০১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপে ‘২২ জুন, ২০১৯’ অবধি এই চারটি ম্যাচ ছিল ব্যতিক্রম।

অনেকেই তখন বলেছিলেন নব্বই দশকের ওডিআই লড়াইয়ের ফ্লেভার ছিল এই ম্যাচগুলোতে। সেই বোলারদের দাপট। সেই ফিল্ডারদের রমরমা। সেই প্রতিটি রান বাঁচানোর জন্য প্রাণান্তকর লড়াই। সেই প্রতিটি উইকেট দখলের লড়াইতে ‘সূচ্যগ্র মেদিনী’ না ছাড়া।

এই প্রেক্ষাপটে চলুন নয়ের দশক থেকে আরো একটু পিছিয়ে গিয়ে একটা খুব ছোট্ট স্কোরের একটা খেলায় দর্শক হয়ে যাই টাইম মেশিনে চড়ে। আশির দশকের মাঝামাঝি, ১৯৮৫-এর ২২ মার্চে ফিরে যাব এখন। শারজাহ-তে ভারত বনাম পাকিস্তান ম্যাচ, রথম্যানস কাপের গ্রুপ লিগের ম্যাচে।

তার ঠিক আগে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ণে ফাইনালে পাকিস্তানকে হারিয়ে বেনসন হেইজেস কাপ জিতে এসেছে ভারত ১২ দিন আগে আর পাকিস্তান তখন ছিল বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্রিকেট টিম।
৫০ ওভারের খেলাটা শুরু হচ্ছে এইবার। টসে জিতে ইমরান খান ভারতকে ব্যাট করতে দিলেন। নিজে প্রথম বল করতে এলেন। এবং রবি শাস্ত্রীকে প্রথম বলে এলবিডবলু আউট করলেন।

দলের ১২ রানে নিজের ৫ বল খেলে ৬ রানে ফিরে গেলেন কৃষ্ণমাচারী শ্রীকান্ত, ইমরান খানেরই বলে ডিপ স্কোয়ার লেগে ক্যাচ নেন সেলিম মালিক। একটু পরেই ভারত ৩ উইকেটে ২০। ৪ বলে ১ রান করে ইমরান খানের তৃতীয় শিকার দিলীপ ভেঙসরকার, উইকেটকিপার আশরাফ আলীর হাতে ক্যাচ দিয়ে। অচিরেই ৪ উইকেটে ২৮ এবং ৫ উইকেটে ৩৪।

ইমরান খানের চতুর্থ আর পঞ্চম শিকার, আশরফ আলির হাতে ক্যাচ দিয়ে সুনীল গাভাস্কার (৯ বলে ২) আর মহিন্দর অমরনাথ (১০ বলে ৫) বোল্ড। অন্যদিকে মরিয়া লড়াই দেওয়া মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন এবং স্বভাবসিদ্ধ আক্রমণাত্মক অধিনায়ক কপিল দেব (৪টি চার সহ ৪৪ বলে ৩০) ৮০ অবধি পৌঁছে দেন ভারতকে। ৬ উইকেটে ৮০ হয়, যখন কপিল দেব বোল্ড হয়ে যান তৌসিফ আহমেদের অফ স্পিনে। এরপর রজার বিনি (১৯ বলে ৮ করে কট জাভেদ মিয়াঁদাদ বো মুদাসসর নজর) আর মদনলালকেও (৩৯ বলে ১১ করে কট আশরফ আলী বো ইমরান খান) ফিরে যেতে দেখেন মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন।

৭ উইকেটে ৯৫ হয়ে ভারত পৌঁছে যায় ৮ উইকেটে ১১৩ রানে। দলের ১২১ রানে ফেরেন আজহারউদ্দিন (৩টি চার সহ ৯৩ বলে ৪৭) তৌসিফ আহমেদের বলে বোল্ড হয়ে। ওয়াসিম আকরামের বলে সেলিম মালিকের হাতে ক্যাচ দিয়ে লক্ষ্ণণ শিবারামকৃষ্ণণ (৬ বলে ১) ফিরে যেতেই ভারতের ইনিংস শেষ হয়ে যায় ১২৫ রানে, ৪২ ওভার ৪ বলে। অসম্ভব লড়ে ২৮ বলে ৩ রান করে অপরাজিত থেকে যান উইকেটরক্ষক সদানন্দ বিশ্বনাথ।

ভারতীয় ইনিংসে ধ্বংসের মূল হোতা ছিলেন ইমরান খান (১০-২-১৪-৬)। তৌসিফ আহমেদ (১০-০-২৭-২) যোগ্য সঙ্গত করেন তাঁকে। ওয়াসিম আকরাম আর মুদাসসর নজর ১টি করে উইকেট নেন যথাক্রমে ২৭ আর ৩৬ রান দিয়ে। উইকেটরক্ষক আশরফ আলী নেন ৩টি ক্যাচ। সব মিলিয়ে মোট ১১টি বাউন্ডারি হয় ভারতীয় ইনিংসে।

১২৫ রানের মূলধন নিয়ে ভারত কতদূর লড়াই দেবে শক্তিশালী পাকিস্তানকে, এ চিন্তা করাই ছেড়ে দিয়েছিলেন ভারতের সমর্থকরা। তারা ভাবছিলেন, পাকিস্তানের জয় শুধু সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু কপিলের একাদশ ভেবেছিলেন অন্য কিছু। ৩৬ বছরের সুনীল গাভাস্কার ওই প্রখর গ্রীষ্মের দিনটিকেই তার স্লিপফিল্ডিং জীবনের বসন্তদিনে পরিবর্তন করেন, ৪ টি ক্যাচ নিয়ে। কপিল দেব ৩টি (৬.৫-১-১৭-৩), রজার বিনি (৩-০-২৪-১) আর মদনলাল ১টি করে (৬-২-১২-১) এবং রবি শাস্ত্রী (১০-৫-১৭-২) আর লক্ষ্ণণ শিবারামকৃষ্ণণ (৭-২-১৬-২) ২টি করে উইকেট নেন ঐ ইনিংসে। সব মিলিয়ে মোট মাত্র ৫টি বাউন্ডারি হয় পাকিস্তান ইনিংসে।

ওপেন করতে এসে উল্টো দিকে ৬ জনকে খুব তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে দেখেন ওপেনার রমিজ রাজা। যখন মহসিন খান রান আউট হন তখন পাকিস্তান ১ উইকেটে ১৩। সেখান তারা থেকে ২ উইকেটে ৩৫ হয়ে যায় যখন মুদাসসর নজর ফিরে যান ২টি চারসহ ১৮ বলে ১৮ রান করে বিনির বলে স্লিপে গাভাস্কারের হাতে ধরা পড়ে। ডানদিকে ঝাঁপিয়ে একহাতে নেওয়া ঐ ক্যাচটি ছিল চোখের আরাম।

গাভাস্কারের এর পরের ক্যাচটি ছিল আরো অসাধারণ এবং রোমহর্ষক, আরো নীচু এবং সেই এক হাতেই নেওয়া। ওই ক্যাচে ফিরে যান পাকিস্তানের ব্যাটিং ত্রাস জাভেদ মিয়াঁদাদ, রবি শাস্ত্রীর বলে এবং পাকিস্তান ৩ উইকেটে ৪০ হয়ে যায়। তারপরে খুব দ্রুত তারা ৪ উইকেটে ৪১ হয়ে ৫ উইকেটে ৪১ হয়ে যায়। আশরাফ আলী (ক দিলীপ ভেঙসরকার) আর ইমরান খান (স্টাম্প সদানন্দ বিশ্বনাথ), দুজনেরই উইকেট নেন লক্ষ্ণণ শিবারামকৃষ্ণণ এবং দু’জনেই খাতা খুলতে ব্যর্থ হন।

এখান থেকে সেলিম মালিকের (৩৯ বলে ১৭) হাল্কা প্রতিরোধ শেষ হয় কট গাভাসকার বো রবি শাস্ত্রী হয়ে। নিচু কিন্তু রেগুলেশন ক্যাচ ছিল এটা। ৬ উইকেটে ৭০ হয় স্কোর। রমিজ রাজার ৭১ বলে ২৯ রানের প্রতিরোধ যখন ভাঙ্গে, স্কোর তখন ৭ উইকেটে ৮৫। কপিল দেবের বলে সেই গাভাস্কার তার চতুর্থ এবং এদিনের সহজতম ক্যাচ নেন।

আর দু’রানের মধ্যে গুটিয়ে যায় পাকিস্তান ইনিংস। শেষ তিনটি উইকেটই পড়ে ৮৭ রানের মাথায়। তাহির নাকাশ (৮ম উইকেট, ২বলে ১ রান) কপিলদেবের বলে সদানন্দ বিশ্বনাথের হাতে ক্যাচ আউট হন। মনজুর ইলাহি মদনলালের বলে তারই হাতে ক্যাচ আউট হন (৯ম উইকেট, ২৪ বলে ৯ রান)। আর তৌসিফ আহমেদ (৭ বলে শূন্য রান) শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে কপিলদেবের বলে বোল্ড আউট হন।

ঠিক এইভাবেই ১২৫ রানে ইনিংস শেষ করেও ৩৮ রানে ঐ ম্যাচ আর কাপ জিতে নেয় ভারত। ইমরান খানের ১০-২-১৪-৬-এর পরে আর কারো ‘ম্যাচ সেরা’ হওয়ার কথা উঠতেই পারে না বলে মনে করা হলেও শোনা যায় যে গাভাস্কারের নাম নিয়েও দীর্ঘ আলোচনা হওয়ার পরেই ইমরান খানের নাম এই পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হয়। দু’টি অসাধারণ ক্যাচ সহ মোট চারটি ক্যাচ নিয়ে সেদিন নিজেকে এই জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন সানি।

ঠাকুরমার ঝুলির শ্রুতিমধুর কিন্তু কাল্পনিক রূপকথার বাইরেও এমন অনেক সত্যিকারের রূপকথা লুকিয়ে আছে আট-নয় দশকের ক্রিকেটে। ‘সেলেব ট্রোলিং’ পেরিয়ে যার বেশির ভাগের উপরেই আজকাল আর আলো পড়ে না।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...