আমি আড়ালে লুকিয়ে রই,
ওখানে জ্বলুক তারা;
নিশীথে জ্বলিবে ফানুস
আমার নাম ছাড়া।
কবিতার লাইনগুলো যেনো এই মানুষটিকে নিয়েই লেখা হয়েছে। হ্যা, জোসেপ পেপ গার্দিওলা।
ফুটবলকে শৈল্পিকতার পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে ২০১০ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলো স্পেন। স্বভাবতই সমস্ত কৃতিত্ব গিয়ে পড়ে তাদের প্রধান কোচ দেল বস্কের ওপর। স্পেনের সাফল্যে দেল বস্কের অবদান আছে বটে। কিন্তু তিনি একচ্ছত্রভাবে এই কৃতিত্বের ভাগ নিতে পারবেন না। স্পেনের বিশ্বকাপ জয়ের নেপথ্যে যে আরও একটা মুখ জ্বলজ্বল করে আড়ালে জ্বলছে তা অস্বীকার করার ক্ষমতা ফুটবল বিশ্বের নেই; তিনি গার্দিওলা, তিনিই জাদুকর।
সে সময়ে তার ক্লাব বার্সেলোনায় খেলতো জাতীয় দলের সাত খেলোয়াড়। এতে জোর গলায় বলাই যায় যে, তাদের ফুটবলীয় কৌশল রপ্ত করানো মানুষটা পরোক্ষভাবেই জিতিয়ে দিয়েছেন নিজ দেশকে। গার্দিওলার শেখানো টিকি-টাকা দিয়ে ডাচ ওলন্দাজদের টোটাল ফুটবলকে নাস্তানাবুদ করে শেষ হাসি জাভি-ইনিয়েস্তারাই হেসেছিল।
জীবনের সূচনালগ্ন হতেই ফুটবলকে বানিয়েছেন নিজের একমাত্র লক্ষ্য, ফুটবল কি তাকে ছেড়ে যেতে পারে?
না, ফুটবল তাকে ছাড়েনি; ঢেলে দিয়েছে সবটুকু প্রেম।
স্প্যানিশ ক্লাব বার্সেলোনার তখন অবস্থানটা খুব শোচনীয়ই বলা যায়; তিন নম্বরে থেকে শেষ করেছে মৌসুম। এমন এক পরিস্থিতিতে দ্বিতীয় শ্রেণীর গার্দিওলা পেয়ে গেলেন মূল দলকে পরিচালনার দায়িত্ব। ভাগ্যবিধাতা যেন নিজ হাতে প্রদ্বীপ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘যা, এবার ছড়িয়ে দে আলো।’
সুযোগটা যেন আশীর্বাদ হয়েই এলো তার জীবনে।
স্পেনের এই মানুষটির আজীবন বার্সেলোনাময়। বার্সেলোনার সি, বি দল হয়ে উঠে এসে মূল দলের খেলোয়াড় হয়েছিলেন। ক্লাবের হয়ে ছয়টি লা লিগা, একটি ইউরোপিয়ান কাপ (চ্যাম্পিয়নস ট্রফি) কাপ উইনার্স কাপ সহ এক গাদা ট্রফি জিতেছেন। খেলেছেন স্পেন জাতীয় দলেই। আর অবসরের পর বার্সেলোনা ‘বি’ দলেই কোচিং শুরু করেছেন। এরপর হাতে পেলেন বার্সেলোনার মূল দল।
দলের দায়িত্ব নিয়ে শুরুতেই বড় চমক দিলেন পেপ। রোনালদিনহো, স্যামুয়েল ইতোর মতো দলের তারকা ফুটবলারদের ছাঁটাই করে দানি আলভেজ আর কেইটার মতো খ্যাতিহীন তরুণ ফুটবলারদের ভেড়ালেন নিজ দলে। তার এমন পাগলামিতে চিন্তার ভাজ সমর্থকদের কপালে। সেই চিন্তা আরও গুরুতর হলো যখন নিচের সারির এক দলের (নোউমানসিয়া) সাথে লিগের প্রথম ম্যাচেই হেরে বসলেন। কিন্তু এই হারটাই যেন তাঁর জন্য বিশাল এক প্রেরণা।
শুরু হলো কাব্যিক উত্থান; টানা বিশ ম্যাচ অপরাজিত থেকে লীগের শীর্ষস্থানে উঠলো বার্সেলোনা। শুধু তাই নয়, তার অধীনের প্রথম এল ক্লাসিকোতে রিয়াল মাদ্রিদের ঘরের মাঠে ৬-২ গোলে জেতে বার্সেলোনা। সেই মৌসুমেই (২০০৮ সাল) কোপা দেল রে এবং স্যার এলেক্স ফার্গুসনের শিষ্যদের (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড) চ্যাম্পিয়নস লীগে হারিয়ে প্রথমবারের মতন স্প্যানিশ দল হিসেবে ট্রেবল জিতে নেয় বার্সেলোনা। ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ কোচ হিসেবে এই স্বর্ণখচিত নাম নিজের করে নেন পেপ গার্দিওলা। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি বার্সার এই ঘরের ছেলেকে। চমকের পর চমক দিয়ে গেছেন প্রতিনিয়ত।
২০০৯ সালে এক ক্যালেন্ডার ইয়ারে ছয়টি শিরোপা জয় করেন তিনি। ওই সিজনে চ্যাম্পিয়নস লীগের সেমিতে হেরে বিদায় নিলেও রেকর্ড ৯৯ পয়েন্ট (সে সময়ের সর্বোচ্চ) নিয়ে লা লীগা জেতে কাতালানরা। সাফল্যের পাশাপাশি পরিচ্ছন্নতা আর সাবলীলতাকে ফুটবলীয় রূপে ফুটিয়ে তোলা এক শিল্পী বনে যান গার্দিওলা।
২০১০-১১ সিজনে স্প্যানিশ সুপার কাপও নিজেদের দখলে নেয় বার্সা। বার্সার ইতিহাসে প্রথম কোচ হিসেবে রিয়ালকে টানা পাঁচ ম্যাচে হারানোর রেকর্ড গড়েন গার্দিওলা। এরপর কোপা দেল রে’র ফাইনালে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর অতিরিক্ত সময়ের করা গোলে বার্সাকে হারায় রিয়াল মাদ্রিদ। কিন্তু চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে আবারও রিয়াল মাদ্রিদকে হারিয়ে সেই শোধ সুদে-আসলে তুলে নেয় টিম বার্সেলোনা। সে বছরও উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে তিন বছরে দুটি চ্যাম্পিয়নস লীগ জেতার রেকর্ড গড়েন গার্দিওলা। এছাড়াও সে মৌসুমেও জিতেছিলেন লা লিগাও।
২০১১-১২ সিজনে ইউয়েফা সুপার কাপ জিতে সবচেয়ে বেশি শিরোপা জেতা কোচ হবার ইতিহাস গড়েন এই মহানায়ক। ফুটবলে অসামান্য অবদানের জন্য কাতালানদের সর্বোচ্চ সম্মানে (কাতালান পার্লামেন্টস গোল্ড মেডেল) ভূষিত হন পেপ গার্দিওলা। মাত্র তিন বছরে ১২টি শিরোপা জেতেন তিনি।
বার্সার হয়ে ১৬ টুর্নামেন্টে মোট ১৪ শিরোপা জিতেছেন গার্দিওলা। পুরো ফুটবল বিশ্বে যখন তার জয়জয়কার, ঠিক সেই সময়ে ক্লাব ছাড়ার ঘোষণা দেন গার্দিওলা। তার এমন সিদ্ধান্তে সবাই অবাক হলেও নিজ সিদ্ধান্তে অনড় পেপ। শৈশব থেকেই চ্যালেঞ্জ নেয়া মানুষটা চ্যালেঞ্জ ছাড়া যে থাকতেই পারেন না তারই প্রমাণ দিয়েছেন বার্সেলোনা ছেড়ে দিয়ে। ঠিক যেন, রাজ্য ছেড়ে নিরুদ্দেশে যাত্রা।
বার্সা ছেড়ে দিয়ে গার্দিওলা অবশ্য তার যোগ্য উদাহারণও দেখিয়েছেন। বায়ার্ন ও ম্যান সিটিতেও নিজেকে স্বরূপে মেলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন এই মুকুট বিহীন রাজা। বার্সা কর্তৃপক্ষ ইদানীংকালে আবারও তাকে দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করলেও তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, আর ফিরবেন না কাতালান শিবিরে। এটা তার পরিচ্ছন্ন বারতা নাকি তার আড়ালে ভেতরকার কোনো চাপা কষ্ট সেটা এখন অব্দি ভক্তশিবিরে অজানা।
দরিদ্র রাজমিস্ত্রীর ঘরে জন্ম নেয়া পেপ গার্দিওলা ভালোমতোই জানেন সংগ্রাম কি জিনিস, কিভাবে সাফল্য আনতে হয়। ক্লাব ফুটবলে তারই প্রমাণ দেখিয়ে যাচ্ছেন এক যুগেরও বেশি সময় ধরে। তরুণদের হাতে সাফল্য খোঁজা এই মানুষটা বর্তমান ফুটবল বিশ্বে তরুণদের জন্য একটি বড় আদর্শ। গার্দিওলা তার কথা-কাজে এই প্রমাণ দিয়েছেন বহুবার।
পেপ গার্দিওলা বার্সেলোনায় থাকলে এতোদিনে তার রেকর্ডের ঝুড়ি যে কোথাও গিয়ে পৌছাতো তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। স্প্যানিশ ফুটবলকে তিনি শৈল্পিকতার ছোঁয়ায় বুনেছেন নিজ হাতে। এই শিল্পীর হাত ধরে ধৈর্য আর পরিচ্ছন্নতার নতুন ফুটবল উপহার পেয়েছে বিশ্ব।
জয়তু পেপ গার্দিওলা, জয়তু ফুটবল।