পেপ গার্দিওলার সঙ্গে লিওনেল মেসির সম্পর্কটা কারো কাছে গুরু শিষ্য আবার কারো কাছে পিতা-পুত্রের। এলএম টেনের মেসি হয়ে ওঠাটা যে এই স্প্যানিশ কোচের বার্সেলোনায় দায়িত্বে থাকার সময়। এরপর এক মৌসুম আগে যখন আর্জেন্টাইন সুপারস্টারের দলবদলের গুঞ্জন শুরু হয় তখন সবার আগে নাম আসে ম্যানচেস্টার সিটিতে যোগদানের।
ইংলিশ জায়ান্ট ক্লাবটিতে কোচ হিসেবে কয়েকবছর যাবত রয়েছেন গার্দিওলা। কিন্তু গুরু শিষ্যের একই ক্লাবের খেলার সম্ভাবনা মুছে দিয়ে মেসি যোগ দিয়েছেন পিএসজিতে। এবার সাবেক প্রিয় কোচের মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন আর্জেন্টাইন অধিনায়ক। উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের খেলায় ম্যানসিটির মুখোমুখি হতে যাচ্ছে পিএসজি। গুরু গার্দিওলার প্রতিপক্ষ হিসেবে আজ রাতে মেসি থাকছেন প্যারিসে।
এর আগে দলবদলের শেষ মুহুর্তে নানা নাটকের অবতারণা হয়। গত ৫ আগস্ট অ্যাস্টন ভিলা থেকে জ্যাক গ্রেলিশকে দলে ভেড়ানোর ঘোষণা দেয় ম্যানসিটি। একইদিন বার্সেলোনাও জানিয়ে দেয়, লিওনেল মেসিকে এবার আর তারা ধরে রাখতে পারছে না। দুয়ে দুয়ে চার মেলানোর সুযোগ ছিল ইংলিশ ক্লাবটির। কিন্তু গ্রেলিশের পেছনে ১০০ মিলিয়ন পাউন্ড বিনিয়োগ করে ফেলায় সাবেক শিষ্য মেসির দিকে আর হাত বাড়াতে পারেননি সিটি বস পেপ গার্দিওলা।
এরপরই নাটকীয়ভাবে পিএসজিতে যোগ দেন মেসি। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, এবার বার্সেলোনার স্বর্ণযুগের গুরু-শিষ্যের পুনর্মিলন হতে যাচ্ছে প্রতিপক্ষ হিসাবে! চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গ্রুপপর্বের হাইভোল্টেজ ম্যাচে আজ রাত একটায় গার্দিওলার ম্যানসিটিকে আতিথ্য দেবে মেসির পিএসজি। পাঁচ মাস আগে সিটির কাছে হেরেই গত আসরের সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নিয়েছিল নেইমার-এমবাপ্পের পিএসজি।
আজ নিশ্চিতভাবে তার বদলা নিতে চাইবে ফরাসি জায়ান্টরা। হাঁটুর চোটের কারণে লিগ ওয়ানের শেষ দুটি ম্যাচে দলের বাইরে ছিলেন মেসি। চোট কাটিয়ে অনুশীলনে ফেরায় সিটির বিপক্ষে মেসিকে এই ম্যাচে পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী পিএসজি কোচ মারসিও পচেত্তিনো। মেসি নিজেও মাঠে ফিরতে উদগ্রীব হয়ে রয়েছেন। পিএসজির জার্সিতে তিন ম্যাচ খেলে যদিও গোলের দেখা পাননি আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড। লিগের প্রথম ম্যাচে ক্লাব ব্রাগার বিপক্ষে এই প্রথম একসঙ্গে মাঠে নেমেছিলেন মেসি, নেইমার ও এমবাপ্পে।
কিন্তু পিএসজির বিশ্বসেরা আক্রমণভাগের রসায়ন তেমনভাবে জমেনি। অন্যদিকে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে প্রতিশোধের ম্যাচে চেলসিকে হারানোর সুখস্মৃতি নিয়ে প্যারিসে এসেছে ম্যানসিটি। ইতিহাসও তাদের অনুকূলে রয়েছে। ইউরো মঞ্চে আগের চার দেখায় পিএসজির কাছে কখনো হার দেখেনি ইংলিশ চ্যাম্পিয়নরা। একটা সময় গার্দিওলার ‘নয়নমণি’ মেসি আর ‘চোখের বালি’ হিসেবেই মাঠে নামছেন। বার্সেলোনায় ২১ বছরের দীর্ঘতম ক্যারিয়ারে নতুন নতুন রেকর্ড যেন ছিল তার নিত্যসঙ্গী।
এখন পর্যন্ত স্প্যানিশ লিগ লা লিগার সর্বোচ্চ গোলদাতার মালিকও তিনি। ঝুলিতে আরও রয়েছে বার্সেলোনার হয়ে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলা ও ক্লাবটির সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতার রেকর্ডও। বার্সেলোনার সিনিয়র দলে ‘লা পুলগার’ হয়ে ২০০৩ সালে অভিষেকের পরের গল্পটা সবারই জানা। দীর্ঘ ১৭ বছরে ক্লাবটির হয়ে জিতেছেন ৩৫ টি শিরোপা। মেসির পরিসংখ্যান বলছে সবচেয়ে ভাল সময়টা মেসি কাটিয়েছেন ২০০৮ থেকে ২০১২ পর্যন্ত ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করা পেপ গার্দিওলার অধীনেই। লা ব্রাউগ্রানাদের তিনটি লা লিগা ও ২টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগসহ মোট ১৪টি ট্রফি জিতিয়েছেন এই কোচ।
গার্দিওলার অধীনেই ২১৯ খেলায় ২১১ গোল করেছেন সর্বকালের অন্যতম সেরা মেসি। কাতালানদের ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ কোচ গার্দিওলার অধীনে মেসির পারফরম্যান্স ছিল বেশ ঈর্ষনীয়। তার অধীনে ৪৭টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ম্যাচে ৪৩ গোল করেছেন এই ক্ষুদে জাদুকর। ২০১২ সালে বার্সেলোনার দায়িত্ব ছাড়ার পর গার্দিওলা জার্মান ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখের কোচ হিসেবে যোগ দেন পরের বছর। ২০১৬ সালে বায়ার্ন ছেড়ে ইংলিশ ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটিতে নতুন মিশন নিয়ে দায়িত্ব নেন।
গার্দিওলা দায়িত্বে থাকাকালীন বায়ার্ন ও সিটির বিপক্ষে দুটি করে ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন মেসি। ২০১৪-১৫ মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ সেমিফাইনালে দুই গোল করে গার্দিওলার বায়ার্নকে প্রতিযোগিতা থেকে বিদায় করার নেপথ্যের অন্যতম নায়ক ছিলেন এই মেসিই। ২০১৬-১৭ মৌসুমে আবারও ইউরোপ সেরার মঞ্চে দেখা হয় গুরু-শিষ্যের। এবার পেপ ছিলেন সিটির হেড কোচের দায়িত্বে।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গ্রুপ পর্বের দুই খেলায় একটি হ্যাটট্রিকসহ মোট চার গোল করে আবারও সাবেক গুরুর দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছেন মেসি। এবারের চলতি মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ড্রতে একই গ্রুপে পড়েছে পিএসজি ও ম্যানচেস্টার সিটি। মেসিকে যদি মূল স্কোয়াডে রাখেন পিএসজি কোচ পচেত্তিনো তবে আবারও দেখা হয়ে যাবে পুরোনো গুরু-শিষ্যের।
বিশ্বের ফুটবলে একটি কথা সমধিক প্রচলিত যে, মেসির আকাশচুম্বী সফলতার পেছনে গার্দিওলার অবদান নেহায়েত কম নয়। পাশাপাশি নিজের কোচিং ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সফল সময়টা তিনি কাটিয়েছেন মেসিকে দলে নিয়েই। মেসিকে ছাড়া এখন পর্যন্ত একটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপাও জিততে পারেননি এই কোচ। আজকের ম্যাচে মেসি খেলার সুযোগ পেলে গোল করবেন এমনটাই চাওয়া ভক্তদের।
এদিকে মেসি-নেইমার-এমবাপ্পে জুটিতে মোকাবেলার কৌশল খুজছেন সিটি কোচ পেপ গার্দিওলা। এখনকার ফুটবল যে শুধুই কাগজে-কলমে হয় না, হয় মাঠেও সেটার জলজ্যান্ত প্রমাণ দেখা গেল পিএসজির চ্যাম্পিয়নস লিগের ম্যাচে। ইউরোপ শ্রেষ্ঠত্বের আসরে দুর্বল বেলজিয়ান ক্লাব ব্রুগের বিপক্ষে প্রথমবারের মতো মাঠে নেমেছিলো সময়ের সেরা আক্রমণভাগ লিওনেল মেসি, নেইমার ও কিলিয়ান এমবাপ্পে।
সবাই ধরে নিয়েছিলো, এমন খতরনাক ত্রিফলা আক্রমণে খড়কুটোর মতো উড়িয়ে লুকাকুর দেশের ক্লাবটিকে।কিন্তু কিসের কী! মাঠের লড়াইয়ে মেসি-নেইমার-এমবাপ্পে ত্রয়ী একটা গোলও পেলেন না। স্প্যানিশ মিডফিল্ডার আন্দের এরেরা ম্যাচে ত্রাতার ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়ে গোল করে শেষমেশ বহুল প্রত্যাশিত ম্যাচটি ১-১ গোলের ড্র করান।
পিএসজির বিপক্ষে মাঠে নামার আগে সিটি কোচ ত্রিফলা আক্রমণ নিয়ে বলেন, ‘পিএসজি আক্রমণভাগকে আমার দল কীভাবে সামলাব তা জানি না। আমি জানি না, কীভাবে তাদের থামাবো, কারণ তারা খুব ভালো খেলোয়াড়। বল ছাড়া ভালোভাবে ডিফেন্ড করতে হবে এবং যখন বল আমাদের দখলে থাকবে তখন তাদের দৌড়াতে বাধ্য করতে হবে আমাদের। তারা ব্যতিক্রমী খেলোয়াড় বিধায় লড়াইটা কঠিনই হবে। আমি চাইব পিএসজির মাঠে এই তিনজনকে নিক্রিয় করে জয় নিয়ে ঘরে ফেরা।’