পুলিশম্যান থেকে ক্রিকেটের ‘বন্ড’

পিচ বা কন্ডিশন যেমনই হোক ব্যাটসম্যানের পাঁজর লক্ষ্য করে বল করে তাদের নাভিশ্বাস ওঠানোকে রীতিমতো অভ্যেসে পরিণত করেছিলেন বন্ড, ফর্মের তুঙ্গে থাকা অবস্থাতে একাই যেকোনো ব্যাটিং লাইনআপকে শুইয়ে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল এই পুলিশম্যানের। লড়াকু মানসিকতা দিয়ে বারংবার চোট আঘাতকে জয় করে ফিরে এসেছেন কখনো হ্যামিল্টনের সেডন পার্কে বা ডারবানের কিংসমিডে আগুন ঝরাতে আবার কখনো বা পার্থের জীবন্ত পিচে ক্যাঙ্গারুদের গতির তেজে সেঁকে দিতে।

২০০২ সালের শেষ দিকে সেবার নিউজিল্যান্ড সফরে গেছে ভারত, আর ভারতের জন্য একেবারে ঘাসে ঢাকা পিচ ওয়েলিংটনের বেসিন রিসার্ভে উপহার এলো ব্ল্যাক ক্যাপদের তরফ থেকে, আর তার সাথে ড্যারেল টাফি, জেকব ওরাম আর এক রুপোলি চুলের ফাস্ট বোলারকেও লেলিয়ে দেওয়া হল সঙ্গে। সেই রুপালি চুলের ফাস্ট বোলার যিনি বছর দুয়েক আগেও ছিলেন ক্রাইস্টচার্চের এক থানার পুলিশ কনস্টেবল তিনিই হয়ে গেলেন অধিনায়ক স্টিফেন ফ্লেমিংয়ের তুরুপের সবচেয়ে বড়ো তাস।

সেই তিনি আর কেউ নন, ক্রিকেটের জেমস বন্ড, যাঁর পোশাকি নাম কিনা শেন এডওয়ার্ড বন্ড। রুপালি পর্দার জেমস বন্ডের মারদাঙ্গা সিনেমার মতোই অ্যাকশনে ভরপুর তাঁর ক্যারিয়ার আর সেই অ্যাকশনেই বিপক্ষকে ধরাশায়ী করতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন একসময়ের পুলিশ কনস্টেবল থেকে স্পিডস্টার বনে যাওয়া বন্ড। সেবারের দুই টেস্টের সিরিজেই গতির ঝড় তুলে ভারতের শচীন, সৌরভ, দ্রাবিড়, লক্ষ্মণ, শেবাগ সমৃদ্ধ ব্যাটিং লাইন আপকে দিশেহারা করে ১২ উইকেট নিলেন বছর খানেক আগেই আন্তর্জাতিক ময়দানে পা রাখা শেন বন্ড।

ক্রিকেটটা একটু দেরি করেই শুরু করেছিলেন তিনি, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটটা ২২ বছর বয়সে শুরু করলেও একসময় বুঝতে পারেন জীবনের কঠিন সত্যকে, শুধু ক্রিকেট দিয়ে জীবন অতিবাহিত করা বোধহয় সম্ভব নয়, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের দল ক্যান্টারবেরির হয়ে মাত্র ২০০০ ডলারের বার্ষিক চুক্তি আর ম্যাচ পিছু ৮০০ ডলার পাওয়া থেকে সরে এসে পুলিশের চাকরিতে যোগ দিলেও ক্রিকেটের প্রতি অমোঘ প্রেমটা ছিন্ন হয়নি মোটেই।

১৯৯৯ সালে পুলিশের চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর ছুটি জমিয়ে ক্রিকেটটা চলছিলই, সারারাত ডিউটি করে তারপর ভোর ছয়টায় ট্রেনিং, সেটাতেও ফাঁকি দেননি কখনো। আসলে ছোট থেকেই মনের কোণে পুষে রাখা ছিল এক বিরাট স্বপ্ন, স্যার রিচার্ড হ্যাডলির মত ফাস্ট বোলার হতে হবে আর গতির আগুনে এরপর ছিন্নভিন্ন করে দিতে হবে বিপক্ষ ব্যাটিং লাইন আপকে। বল হাতে দুরন্তপনা শুরু করার আগে ছোটবেলাতেও ছিলেন মারাত্মক দুরন্ত, সে জন্য ক্রাইস্টচার্চের হেরউড প্লেসেন্টার থেকেও বহিস্কৃত হতে হয়, জায়গা হয়নি ক্রাইস্টচার্চের বিখ্যাত সেন্ট বেডস কলেজেও, ভর্তি হতে হয় পাপানুই হাই স্কুলে, ক্রিকেটের হাতে খড়িটাও সেখানেই বন্ডের।

আর সেই ছোট্ট থেকেই দুরন্ত বন্ড ধীরে ধীরে ক্রিকেটের প্রতি তীব্র ভালোবাসায় বল হাতেও হয়ে উঠলেন দুরন্ত। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট থেকে পুলিশের চাকরিতে যাওয়ার পর বেশিদিন স্থায়ী থাকতে পারেননি, বুঝতে পারেন ক্রিকেট থেকে দূরে থাকা সম্ভব নয়, ক্রিকেট যে তার হৃদ-স্পন্দনে গেঁথে আছে।

এরপরেই তো শুরু হল আসল গল্প, শুরু হলো ক্রিকেটকে নিজের প্রেমিকা বানিয়ে অন্তহীন পরিশ্রম এবং আবারো প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তন। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে আবারো ফিরে আসার পর আর বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি, নিউজিল্যান্ড ‘এ’ দলের হয়ে দুরন্ত পারফরমেন্স এর পরেই সেই কাঙ্খিত সুযোগ এসে যায় পড়শী অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ২০০১ এর টেস্ট সিরিজে, ক্রিস মার্টিনের জায়গায় তাঁকে দলে নেওয়া হয়, কিন্তু অভিষেক সিরিজ মোটেই ভালো যায়নি।

এরপর বন্ডের ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট হয়ে দাঁড়ায় ২০০২ এ অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ত্রিদেশীয় ভিবি সিরিজ। সেখানে কিউইদের কালো জার্সিটা কাঁধে চাপানোর পর সেই সিরিজেই ২১ উইকেট নিয়ে ধ্বংসাত্মক বোলিং করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পাদপ্রদীপের আলোয় আগমন। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি, প্রতিবেশি অস্ট্রেলিয়াকেই নিজের ‘প্ৰিয় খাদ্য’ বানিয়ে ফেলেন।

মাত্র ১৭ টি একদিনের ম্যাচে ১৫.৭৯ গড়ে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধেই সংগ্রহ করে ফেলেন ৪৪ টি উইকেট, এর মধ্যে রয়েছে তিন তিন বার অসিদের বিরুদ্ধে ৫উইকেট নেওয়ার কৃতিত্ব, এমনকি ক্যারিয়ারের একমাত্র হ্যাটট্রিকটাও সেরে ফেলেন সেই অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধেই হোবার্টে ২০০৭ সালে। পন্টিংদের দেখলেই বোধহয় আলাদা রকম তেতে উঠতেন বন্ড, আর অসি অধিনায়ক পন্টিংকে টানা ছয়টি ম্যাচে আউট করার এক বিরল কৃতিত্ব ও স্থাপন করে ফেলেন তিনি।

নিজের সেরা পারফরমেন্স বরাবরই বন্ড জমিয়ে রাখতেন বড় দলের বিরুদ্ধে, ২০০৩ বিশ্বকাপে মাত্র ৮ ম্যাচ খেলে দখল করেন ১৭ উইকেট আবার পরের বিশ্বকাপেও চোখ ঝলসানো বোলিং করেন আট ম্যাচে ১৩ উইকেট নিয়ে। ভারতের বিরুদ্ধে ২০০৫ সালে জিম্বাবোয়ের বুলাওয়েতে ত্রিদেশীয় সিরিজে সৌরভ, দ্রাবিড়, শেহবাগ সমৃদ্ধ ব্যাটিং লাইন আপকে বেলাইন করে দেন মাত্র ১৯রানে ৬ উইকেট নিয়ে। বন্ডের গোলাগুলিতে ভারতের একসময় স্কোর দাঁড়িয়েছিল আট উইকেটে ৪৪। নিয়মিত ১৪৫-১৫০ কিমি গতিতে বোলিং করে ব্যাটসম্যানের নাভিশ্বাস তোলায় সিদ্ধহস্ত বন্ড ক্যারিয়ারের সবচেয়ে দ্রুতগতির ডেলিভারিটি করেন ২০০৩ বিশ্বকাপে ভারতের বিরুদ্ধে ১৫৬.৪ কিমি গতিবেগে সেঞ্চুরিয়নে!

সেই বিশ্বকাপেই পোর্ট এলিজাবেথে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচে ২৩ রানে ছয় উইকেট নেওয়ার পথে অস্ট্রেলিয়া ব্যাটসম্যানদের প্রায় কাঁদিয়ে ছেড়েছিলেন তিনি। টেস্ট ক্রিকেটেও সমান ভাবেই উজ্জ্বল ছিলেন বন্ড, ৯ বছরের ক্যারিয়ারে মাত্র ১৮ টি টেস্ট খেললেও তুলে নিয়েছিলেন ৮৭ টি উইকেট। এমনকি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জীবনের শেষ টেস্ট সিরিজেও এক ম্যাচে পাঁচ উইকেট সহ একটি ম্যাচের সেরার খেতাব দখল করেন।

অন্তত ২৫০০ টি বল করেছেন টেস্ট ক্রিকেটে এরকম বোলারদের মধ্যে তাঁর স্ট্রাইক রেট ছিল জর্জ লোম্যানের পরেই দ্বিতীয় সেরা। একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও মাত্র ৮২টি ম্যাচে তুলে নিয়েছিলেন ১৪৭টি উইকেট। নিউজিল্যান্ড এর হয়ে একদিনের ক্রিকেটে দ্রুততম ১০০ উইকেট নেওয়ার কৃতিত্বটাও তাঁরই দখলে, মাত্র ৫৪ম্যাচে এই নজির গড়েন তিনি।

ফাস্ট, ফিউরিয়াস, অ্যাগ্রেসিভ ও ড্যাশিং এই চারটি শব্দেই হয়তো শ্যেন বন্ডকে বর্ণনা করা যেত, হতে পারতেন তিনি বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম সেরা ফাস্ট বোলার, কিন্তু পঞ্চম আরেকটি শব্দ তাঁর ক্যারিয়ারের সঙ্গে প্রায় সমার্থক হয়ে গিয়েছিলো- ‘ইনজুরি’। মারাত্মক পরিমাণে চোটপ্রবণ হওয়ার কারণে মাত্র সাড়ে আট বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার ১৮ টি টেস্ট, ৮২ টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ আর ২০ টি টি-টোয়েন্টি আন্তর্জাতিক ম্যাচেই সীমাবদ্ধ থেকে গেল।

ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই বারংবার চোট আঘাতে জর্জরিত হওয়া তাঁর খেলোয়াড় জীবনকে সংক্ষিপ্ত করে দেয়। কিন্তু এই সংক্ষিপ্ত খেলোয়াড়ি জীবন তো তাঁর হওয়ার কথা ছিল না, বন্ড ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই একজন বিশ্বমানের ফাস্ট বোলার, এক নিয়মিত উইকেট শিকারী। শেন বন্ড মানেই ঐ লাল বা সাদা বলটা নিয়ে মসৃন রানআপে ছুটে আসা এমন এক বোলার যাঁকে দেখে ব্যাটসম্যানের শিরদাঁড়া দিয়ে রক্তের শীতল স্রোত বয়ে যাওয়া।

এই হাড়হিম করা বোলিংয়ের সঙ্গে বন্ডের আক্রমণাত্মক শরীরী ভাষা ও লড়াকু মানসিকতা তাঁকে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এক অন্য স্তরে নিয়ে যায়। মসৃন অ্যাকশনে যেকোনো উইকেটেই ব্যাটসম্যানের সামনে গতির ঝড় তুলে কাঁপন ধরিয়ে দেওয়া ছিল তাঁর কাছে ‘জলভাত’, বারবার চোট আঘাতে পড়া সত্ত্বেও গতির সাথে কস্মিনকালেও আপস করেননি এই ‘পুলিশম্যান’ স্পিডস্টার।

দুরন্ত গতির সাথে বন্ড যোগ করেছিলেন ম্যাকগ্রার মত একিউরেসি ও কন্ট্রোল, ক্রমাগত একই লাইন ও লেংন্থ এ বোলিং করে যেতেন আগুনে গতি দিয়ে, এর ফলে সব ধরণের উইকেটেই ছিলেন সমান সফল। এর পাশাপাশি ছিল উইকেটের দুপাশেই সুইং করানো ও পুরোনো বলে রিভার্স সুইং করানোর বিরল ক্ষমতা। তাঁর ঐ ১৫০ কিমি এক্সপ্রেস গতির সাথে যখন লেট্ সুইংটা যুক্ত হতো তা হয়ে দাঁড়াতো একেবারে ‘আনপ্লেয়েবেল’।

যেকোনো উইকেটেই বলকে অতিরিক্ত লিফট করানোর মত সহজাত ক্ষমতা ছিল তাঁর। আর বন্ডের বোলিংয়ের সেরা দৃশ্য ছিল বোধহয় ‘টো ক্রাশিং’ ইয়র্কারে স্ট্যাম্প ছিটকে দেওয়ার মুহূর্ত গুলো, ম্যাথিউ হেডেনের মত ধ্বংসাত্মক ব্যাটসম্যান ও বন্ডকে সামলানোর জন্য ‘টো গার্ড’ পড়ে মাঠে নামতে বাধ্য হতেন, এতই মারাত্মক ছিল বন্ডের ইনসুইং ইয়র্কারের সেই মারণাস্ত্র।

পিচ বা কন্ডিশন যেমনই হোক ব্যাটসম্যানের পাঁজর লক্ষ্য করে বল করে তাদের নাভিশ্বাস ওঠানোকে রীতিমতো অভ্যেসে পরিণত করেছিলেন বন্ড, ফর্মের তুঙ্গে থাকা অবস্থাতে একাই যেকোনো ব্যাটিং লাইনআপকে শুইয়ে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল এই পুলিশম্যানের। লড়াকু মানসিকতা দিয়ে বারংবার চোট আঘাতকে জয় করে ফিরে এসেছেন কখনো হ্যামিল্টনের সেডন পার্কে বা ডারবানের কিংসমিডে আগুন ঝরাতে আবার কখনো বা পার্থের জীবন্ত পিচে ক্যাঙ্গারুদের গতির তেজে সেঁকে দিতে।

এত কিছুর পরেও চোট আঘাতে জর্জরিত ক্রিকেট জীবন ও নিষিদ্ধ আইসিএলের জন্য দেড় বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বাইরে থেকেও শ্যেন বন্ড কিউয়ি ক্রিকেটের সর্বকালের অন্যতম সেরা ফাস্ট বোলার হিসাবেই গণ্য হয়ে থাকবেন আর ক্রিকেট রোম্যান্টিকরা বোধহয় তাঁর অপূর্ণ ক্যারিয়ারের আক্ষেপ নিয়ে ওই ‘টো ক্রাশিং’ ইয়র্কার গুলো বা ব্যাটসম্যানের দিকে হিমশীতল চাউনিগুলোকে মনের মনিকোঠায় রেখেই নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের এই চিরন্তন প্রেমিককে হৃদয়ে ঠাঁই দেবেন।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...