মেলবোর্নের ফাইনালে পাকিস্তানের জয়টা শেষমেশ আসেনি। শিরোপা জয়ের আনন্দে ভেসেছে ইংল্যান্ড। ১২ বছর পর আবারও ক্রিকেটের ছোট ফরম্যাটে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ইংলিশরা।
অন্যদিকে, ২০০৯ এর পর আবারও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের সুযোগ ছিল পাকিস্তানের। কিন্তু ইংল্যান্ডের কাছে হেরে সে অপেক্ষাটা আরও বাড়ল। তবে শিরোপার এত কাছে এসেও পাকিস্তান কেন ব্যর্থ হল তা নিয়ে আলোচনা, বিশ্লেষণ হতেই পারে।
এবারের বিশ্বকাপে পাকিস্তানের মূল শক্তির জায়গা ছিল বোলিং। পুরো টুর্নামেন্টে তাদের একজন বোলারও নেই যার ইকোনমি রেট ৭.৫০ ছাড়িয়েছে। পাকিস্তানের বোলিং লাইন আপ কেমন শক্তিশালী তার কিছুটা চিত্র ফাইনালেও পাওয়া গিয়েছে। পাকিস্তানের দেওয়া ১৩৮ রানের সহজ লক্ষ্যে ইংল্যান্ড ব্যাট করলেও তা টপকাতে বেশ কাঠখড়ই পোড়াতে হয়েছে তাদের। অমন সংগ্রহ নিয়েও ইংল্যান্ড ব্যাটারদের চেপে ধরেছিল শাহীন, রউফ, নাসিম শাহরা।
পাকিস্তানের যেমন বোলিং লাইন আপ তাতে অবস্থা দৃষ্টে ব্যাটিংয়ে ১৬০ রানই যথেষ্ট মনে হয়। এরপরেও ইংল্যান্ড অধিনায়ক জশ বাটলার টসে জিতে প্রথমে বোলিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। পাকিস্তানের এমন বোলিং লাইনের বিপক্ষে গিয়ে রান চেজ করাটা বেশ কঠিন।
তারপরও বাটলারের এমন সিদ্ধান্তের কারণ ছিল, তাদের ব্যাটিং গভীরতা। ব্যাটিং লাইন আপে ১১ নম্বরে থাকা আদিল রশিদেরও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১০ টি সেঞ্চুরি রয়েছে। তাই পরে ব্যাট করার সিদ্ধান্তটা এসব কিছু ভেবেই নেওয়া হয়েছিল।
তাছাড়া সেমির ম্যাচেই তারা মেলবোর্নের মাটিতে সর্বোচ্চ রান চেজ করে জিতেছিল। তাও আবার কোনো উইকেট না হারিয়েই! সব কিছু মিলিয়ে ইংল্যান্ড তাদের ব্যাটিং লাইন আপ নিয়ে বেশ আত্মবিশ্বাসী ছিল। আর ঐ আত্মবিশ্বাসী মনোভাবই তাদের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথটা সহজ করে দিয়েছে।
তবে এবারের বিশ্বকাপে ম্যাচের ফল নির্ধারণে পাওয়ার প্লে একটা গতিপথ তৈরি করে দিয়েছে। যেমন প্রথম সেমিতে নিউজিল্যান্ড ৬ ওভারে তুলেছিল ৩৮ রান আর ১০ ওভার শেষে তাদের স্কোর ছিল ৫৯/৩। নিউজিল্যান্ড মূলত ম্যাচ থেকে ছিটকে গিয়েছে ওখানেই। টপ অর্ডার ব্যর্থ হয়েছে। একই সাথে তারা রানও তুলতে পারেনি।
পাওয়া প্লেতে এমন নেতিবাচক ট্যাক্টিকসে দিনশেষে আসলে দলেরই ক্ষতি হয়। একই দশা, দ্বিতীয় সেমিতেও। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ভারত প্রথমে ব্যাট করতে নেমে পাওয়ার প্লে শেষে তোলে ৩৮। আর ১০ ওভার শেষে গিয়ে রান দাঁড়ায় ৬২ তে। হার্দিক পান্ডিয়ার শেষের ঝড়ে ১৬৮ রানের পুঁজি ভারত পেয়েছিল বটে। কিন্তু প্রথম ১০ ওভারে মন্থর ব্যাটিংয়ে সেটি শেষ পর্যন্ত মেলবোর্নের পার স্কোরই স্পর্শ করেছে শুধু।
দুই সেমি ফাইনালের মত ফাইনালেও পাকিস্তানের শুরুটা হয়েছিল এমন। ৬ ওভারে ৩৯, ১০ ওভার শেষে ৬৮। পাকিস্তান টিম ম্যানেজমেন্ট সম্ভবত ভুলটা এখানেই করে ফেলে। ৭.১ ওভারে মোহাম্মদ হারিস যখন আউট হয়ে গেল তখন তারা উইকেটে আনে শান মাসুদকে, যে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে অ্যাংকর রোলই প্লে করে থাকে। ১২০ এর উপরে স্ট্রাইক রেট রেখে খেলেছেন খুবই কম ম্যাচ। অথচ ব্যাটিং লাইন আপে ১৬৯ স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করা শাদাব খান কিংবা টুর্নামেন্টে দুটি ফিফটি করা ইফতিখার ছিলেন।
এখানে একটা তর্ক হতে পারে যে, পাকিস্তান ইনিংসটাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য শান মাসুদকে পাঠিয়েছিল। কিন্তু এখানেই ডিফেন্সিভ মানসিকতা চলে আসে। কারণ ইনিংসে রানের গতির চেয়ে যদি সর্ব সাকুল্যে ১৫০ এর দিকে চোখ থাকে তাহলে ম্যাচটা ওখানেই শেষ হয়ে যায়। হয়েছেও তাই। ইনফর্ম শাদাব খান ব্যাট হাতে সুযোগ পেয়েছেন ১৩ নম্বর ওভারে।
আর যখন তিনি ব্যাটিং করতে আসলেন তখন অপর প্রান্তে সঙ্গ দেওয়ার মত কেউ নেই। শান মাসুদ ছিলেন যদিও, কিন্তু তিনি আউট হয়ে ফিরে যান কিছুক্ষণ বাদেই। পাকিস্তান তাদের ব্যাটিং ইনিংসে কোনো সাহসী সিদ্ধান্ত নেয় নি। অনেক বেশি সেফ খেলতে গিয়ে বরং তারা তাদের বিপদটাই ডেকে এনেছে। দিন শেষে তারা তুলতে পারে ১৩৭ রান।
পাকিস্তানের এমন ব্যাটিংয়ের সময় জশ বাটলারও তাই কৌশলী একটা ট্যাক্টিসে এগিয়ে ছিলেন। এমনিতে খাতা কলমে ইংল্যান্ডের বোলিং লাইন আপ তেমন শক্তিশালী না। কারণ টুর্নামেন্টে ছিটকে গিয়েছেন রিস টপলি, আর ফাইনালে ছিলেন না মার্ক উড। সব মিলিয়ে ৪ ওভার বোলিং করার মত ছিলেন স্যাম কারেন, ক্রিস জর্ডান, ক্রিস ওকস আর আদিল রশিদ। ফাইনালের মত ম্যাচে বাকি ৪ ওভারের জন্য দরকার ছিল বিকল্প বোলার।
বিকল্প বোলার বলতে আছেন স্টোকস আর লিভিংস্টোন। স্টোকস নিয়মিত বল করেন কিন্তু ৪ ওভারে কোটা পূরণ করতে সাধারণত দেখা যায় না। এর উপর মন্থর গতিতে চলা পাকিস্তানের ইনিংসে ওকস একাই তিন ওভারে দিয়ে দিলেন ২৬ রান। আগের ম্যাচে ডেথ ওভারে বাজে বোলিং করেছিলেন ক্রিস ওকস। তাই সেই ঝুঁকির পথে এগোলেন না বাটলার।
যখন দেখলেন মিডল ওভারগুলোতে পাকিস্তানের ব্যাটাররা তেমন রানের গতি বাড়াচ্ছে না, তার মধ্যেই শেষ করে ফেললেন স্টোকসের ৪ ওভারের কোটা। ডেথ ওভারের জন্য রেখে দিলেন স্যাম কারেন আর ক্রিস জর্ডানকে। এর মাঝে ওকসের থাকা একটি ওভার করালেন লিভিংস্টোনকে দিয়ে।
যদিও সে ওভারে ১৬ রান হজম করেছিলেন লিভিংস্টোন। তারপর বাটলার তাঁর পরিকল্পনায় দিন শেষে সফল ছিলেন। ডেথ ওভারে কারেন আর জর্ডানকে নিয়ে যে পরিকল্পনা তিনি সাজিয়েছিলেন তাতে পুরোপুরি তিনি সফল ছিলেন। কারণ পাকিস্তানের ব্যাটাররা শেষ ৪ ওভারে তুলতে পেরেছিল মাত্র ১৭ রান।
জশ বাটলার যেমন তাঁর পরিকল্পনায় সফল ছিলেন, ঠিক তাঁর উল্টোটা ছিলেন বাবর আজম। ম্যাচে যখন ইংল্যান্ডের ২৯ বলে ৪১ রানের সমীকরণ ঠিক তখনই ইনজুরির কারণে মাঠের বাইরে চলে গেলেন শাহীন আফ্রিদি। এখন বাকি এই ৫ টি বল করবে কে?
বাবর আজম বল তুলে দিলেন ইফতিখার আহমেদের হাতে। আর ঐ ৫ বলেই ম্যাচ থেকে ছিটকে যায় পাকিস্তান। কারণ ঐ ওভার থেকে আসে ১৩ রান। এখন মঈন আর স্টোকস দুজই বাঁ-হাতি ছিলেন বলেই বোধহয় ডানহাতি ইফতিখারকে বল তুলে দিয়েছিলেন। তখন অমন গুরুত্বপুর্ণ সময়ে পার্ট টাইম বোলারকে ব্যবহার করার যুক্তিতে প্রশ্ন নিঃসন্দেহেই আসে।
কারণ তাঁর হাতে যে তখন অপশন ছিল না তাও নয়। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে নওয়াজের ৪৭ টি উইকেট আছে। অথচ বাবর আজম ঐ রকম সময়ে নওয়াজকে ব্যবহার করেননি। নওয়াজ আসলেই ম্যাচের ফল পাল্টে যেত বিষয়টি এমন নয়। তবে ম্যাচের পরিস্থিতিতে সঠিক সময়ে বাবর আজমের বিকল্প বোলার ব্যবহার করার ভাবনা মাথায় থাকা উচিত ছিল।
কারণ আপনার দলের ৪ পেসারের মধ্যে একজন পেসার নির্দিষ্ট দিনে ব্যর্থ হতেই পারে। সেই ঘাটতিটা মাঠে পূরণ করার দায়িত্বটাও অধিনায়কের। জশ বাটলার যেমন পুরো দস্তুর ৫ জন বোলার নিয়ে খেলেননি। তারপরও তিনি সবাইকে ব্যবহার করেছেন ঠিকঠাক ভাবে। দিন শেষে তাই দলগত পরাজয়ের পাশাপাশি কৌশলগত দিক দিয়েও বাটলারের কাছে হেরে গিয়েছেন বাবর।