দ্রুত, দাদা! দ্রুত বেরিয়ে এসো!

সেটা সম্ভবত ১৯৯৬ সালের কথা।

আনন্দমেলা বা দেশ পত্রিকায় সমরেশ মজুমদারের একটা উপন্যাস ছাপা হয়েছিলো-মনের মতো মন। নায়কের নাম ছিলো স্নেহাশিষ বা স্বপ্নশিষ।

একেবারে পাড়ার ক্রিকেট থেকে উঠে এসে বাংলা দল হয়ে ভারতীয় জার্সি। স্বপ্নের মতো অভিযান। একেবারে সিনেমাটিক সব ইনিংস। এর মধ্যে আবার প্রেম; ছক্কা মেরে কাঁচ ভাঙা। মানে, ওই বয়সে প্রেমে পড়তে যা যা লাগে সবকিছুর এক ‘বিপুল সমাহার’ এক উপন্যাসে।

ব্যস, প্রেমে পড়ে গেলাম স্বপ্নাশিষের।

মজাটা হলো, কিছুদিন পর এক বন্ধু বললো, এটা কিন্তু বানানো কাহিনী না। এটা হলো ভারতের উঠতি তারকা সৌরভ গাঙ্গুলির কাহিনী!

কোথায় সৌরভ। খোজ খোজ খোজ। খুজে পেতে জানা গেলো, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় নামে এক মাত্র কৈশোর পার হওয়া ছেলে ভারতীয় দলে ঢুকে পড়েছে। অভিষেকের থেকে টানা দু ম্যাচে সেঞ্চুরি করে হইচইও ফেলে দিয়েছে। কিন্তু বিদ্যুৎ, টিভিহীন; সভ্যতা থেকে দূরে থাকা আমাদের বাড়িতে তখনও সৌরভের নামটা পৌছায়নি। রেডিওতে শুনে বাবা হয়তো চিনে থাকবেন।

আমাকেও সেদিন থেকে চিনতে হলো। সেদিন থেকে আমি সৌরভের খুব ভক্ত হয়ে গেলাম। কারণ, আমি তো তার গল্পটা জানি।

কিন্তু হায়!

মানুষ বড় হলে কত গল্প ভেঙে যায়। বড় হওয়ার সাথে সাথে জানতে পারলাম, সৌরভ মোটেও অমন দারিদ্রের সাথে লড়াই করেনি, সৌরভ মোটেও জেলায় জেলায় খ্যাপ খেলে উঠে আসেনি এবং সৌরভের মোটেও আহিরের মতো একটা বৌ নেই। অবশ্য সৌরভের ডোনা নামে আরও সুন্দর একটা বৌ আছে।

সে ডোনা থাকলে থাক; আমার উপন্যাসের জগতটা মাঠে মারা গেলো।

তারপরও সৌরভের প্রতি প্রেমটা কমল না। বিশেষ করে বাঙ্গালী বলে একটা আলাদা রক্তগরম করা ব্যাপারস্যাপার হতো সৌরভকে দেখলে। লর্ডসের ব্যালকনিতে জার্সি খুলে ফেলাটা তো একটা মিথলজিক্যাল ব্যাপারে পরিণত হলো।

তখন আমি খুব ইংরেজ বিদ্বেষী। তাই তাদেরই ব্যালকনির সম্মান এরকম ধুলোয় মিটিয়ে দিতে পারাটা একটা বিশাল ব্যাপার ছিলো।

সৌরভ কালক্রমে ভারতীয় ক্রিকেটের বা ক্রিকেট দুনিয়ার একটা মহীরূহে পরিণত হলো। একটু একটু করে সৌরভ নিজেই একটা সিনেমার চরিত্র পরিণত হলো। ২০০৩ বিশ্বকাপের ফাইনালে তুললো দলকে, শেবাগ, জহির খান, হরভজনের মতো একটা ঝাক তৈরী করলো তাকে কেন্দ্র করে।

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ভালো করার জন্য দৃশ্যপটে আনলো কোচ গ্রেগ চ্যাপেলকে। এরপর অনেকটা জেদ করে চ্যাপেলকে কোচ করে আনলো। সেই চ্যাপেল ক্ষমতা পেয়ে প্রথমেই সৌরভের ডানা ছেটে দিলেন। চ্যাপেল বাদ দিলো। তিনি আবার ভয়াবহ পারফরম করে ফিরে এসেই বড় ইনিংস খেললেন। একেবারে লেখা চিত্রনাট্য যেনো!

সৌরভকে সামনাসামনি প্রথম দেখি সম্ভবত ২০০৪ সালে। এরপর থেকে বহুবার কাছ থেকে দেখেছি, প্রেস কনফারেন্স কাভার করেছি। দু বার সাক্ষাতকারও নিয়েছি।

২০১০ সালে বাংলাদেশে এসেছিলো বিশ্বকাপ কাউন্ট ডাউন উদ্বোধন করতে। সেদিন বিমানবন্দরে ধরেছিলাম। দিনটা ছিলো ১০ নভেম্বর। ছেলেমানুষের মতো প্রথম প্রশ্ন করেছিলাম, ‘একটা গুগলি করি?’

বিমানবন্দরের রেস্ট রুমে বসে বিখ্যাত মুচকি হাসি হেসে বলেছিলো, ‘বল। দেখি পারি কি না।’

‘বলো তো ১০ বছর আগে এই দিনটা কোথায় ছিলে?’

অনেকক্ষন ভাবলো; অনেকক্ষন। হাতড়ে টাতড়ে বললো, ‘১০ বছর আগে মানে ২০০০। সে বছর… সে বছর তো আমার ক্যাপ্টেন্সির শুরু। ১০ নভেম্বর কী ছিলো বল তো?’

‘তোমার ক্যাপ্টেনসির প্রথম ম্যাচ এবং বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম ম্যাচ।’

কথাটা বলতেই দারুন শিশুসূলভ একটা হাসি দেখেছিলাম তার মুখে, ‘বলিস কী! ঠিক দশ বছর পর আবার ঢাকায়। এটা ভালো তো।’

তবে তার সাথে আমার সব স্মৃতি এমন মধুর না। মাঝে একবার একটা সাক্ষাতকারের জন্য খুব ঘুরিয়েও দেয়নি। সে যাক। সাংবাদিকের কাজই ঘোরা।

ভাবতে অবাক লাগে, মাঠে দারুন বিপ্লব করা লোকটা কূটনীতিও দারুন শিখে গেছে। দুই গ্রুপের মিলিঝুলি বোর্ডে সভাপতি হয়ে গেছে ভারতের। কার্যত এখন ক্রিকেট বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর লোক। তবে এর মাঝেও বলছিলাম, ক্ষমতা পেয়েও প্রতিশোধপরায়ন হয়নি। তা হলে রবি শাস্ত্রীর চাকরি থাকতো না।

তবে সৌরভের কাছে আমার অনেক কিছু জানার আছে। আমি প্রায়ই বলি, তাকে নিয়ে এক ডজন প্রশ্ন আছে। সেগুলো সামনাসামনি করতে চাই। একটা বার তার সাক্ষাতকার চাই।

সে জন্য আমাদের সুস্থ থাকতে হবে।

দাদা, দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠো। কলকাতা বা ঢাকা; যেখানেই হোক, তোমার একটা এপয়নমেন্ট চাই। হাসপাতালের বিছানা তোমার জন্য নয়। তুমি থাকবে বাইশ গজে, তুমি থাকবে সিংহাসনে। তুমি লড়বে চোখে চোখ রেখে।

দ্রুত, দাদা; দ্রুত বেরিয়ে এসো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link