ক্রিকেটের মত স্ট্যাটিস্টিকসের প্রাধান্য খুব কম খেলায় আছে। এটা যেমন এক দিক দিয়ে সুবিধের – এর ফলে না দেখা অনেক ক্রিকেটারদের সম্বন্ধে আমরা ধারণা করতে পারি, তেমনই অন্যদিক দিয়ে অসুবিধেরও – শুধুমাত্র সংখ্যার ওপর নির্ভর করে আমরা একজন ক্রিকেটারকে অন্যজনের থেকে ভাল ক্রিকেটারের খেতাব অনায়াসে দিয়ে ফেলি।
কিন্তু, কোন খেলাতেই শুধুমাত্র সংখ্যা খেলোয়াড়ের মান নির্ধারণ করার পক্ষে যথেষ্ট হতে পারে না। ১৯৮৬র বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে দুটি গোল করেন মারাদোনা – একটি তাকে ঐশ্বরিক উচ্চতায় নিয়ে গেছে, অন্যটি, অনেকের মতে, শয়তানের কালো গহ্বরে। অথচ স্কোরবোর্ড দুটি গোলের মধ্যে তফাৎ করে না। স্কোরবোর্ড ‘এন্ডস’ অর্থাৎ ‘ফল’কেই শুধু গুরুত্ব দেয়, সেই ফলের পাওয়ার জন্য সেই খেলোয়াড় কোন পথে হেঁটেছেন (অর্থাৎ ‘মিনস’) সেটা তার বিচার্য নয়।
অথচ একজন খেলোয়াড়ের জনপ্রিয়তা নির্ভর করে মূলত তিনি কী ভাবে খেলতেন তার ওপর। সেই জন্যই যারা ভিভের ব্যাটিং বা লিলির বোলিং দেখেছেন তারা কিছুতেই মানতে চান না গ্রেগ চ্যাপেল ভিভের চেয়ে ব্যাটসম্যান হিসেবে উঁচু স্তরের বা হ্যাডলি বোলার হিসেবে লিলির চেয়ে। কারণ একটাই – ভিভের ধ্বংসাত্বক মেজাজ বা লিলির আগুনে ফাস্ট বোলিঙের মাপকাঠি নিছক রান বা উইকেটের সংখ্যা হতে পারে না। আরও একটা কারণ – কিছু খেলোয়াড় তাঁদের রেকর্ড সম্বন্ধে অত্যন্ত সচেতন।
ম্যাচের পরিস্থিতি বা বিপক্ষের মান যাই হোক না কেন তারা কিছুতেই নিজের উইকেট ছুঁড়ে আসার কথা চিন্তা করতে পারেন না। স্যার ডন ব্র্যাডম্যান বা সুনীল গাভাসকার সেই দলে পড়েন। আবার সেই ব্র্যাডম্যানেরই সতীর্থ কিথ মিলার মাঝে মধ্যেই পরিস্থিতি পছন্দ না হলে উইকেট ছুঁড়ে চলে আসতেন বা বল করতে চাইতেন না (একবার নাকি স্বয়ং ডনকে বল ছুঁড়ে ফেরত দিয়ে দিয়েছিলেন)। ভিক্টর ট্রাম্পারের নিজের উইকেট নতুন বোলারকে ‘উপহার’ দেওয়ারও বেশ কয়েকটা গল্প আছে।
সে যাই হোক, আজকে যাকে নিয়ে লিখতে বসেছি তার স্ট্যাটিস্টিকস দেখে নাক কোঁচকানোর সাহস মনে হয় কারও হবে না। আবার উনি নিজের উইকেট কোনদিন ‘উপহার’ দিয়েছেন এমন গল্পও শোনা যায় না। তবে তিনি যখন ব্যাট হাতে ক্রিজে থাকতেন তখন বুঝতে অসুবিধে হত না মাঠের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ক্রিকেটারটি কে। কখনও তার ব্যাট তরওয়ালের ভয়াবহতায় বোলিং আক্রমণকে ছিন্নভিন্ন করত, কখনও বা জ্যামিতিক নির্ভুলতায় দুজন ফিল্ডারের মধ্যে ফাঁকটুকু খুঁজে বের করে ছুটে যেত সীমানার ওপারে।
এবারে একটা ডিসক্লেমার দিয়ে রাখি। ব্রায়ান লারার খুব বেশি বড় ইনিংস ‘লাইভ’ দেখার সৌভাগ্য আমার হয় নি। একটা কারণ, তিনি কোনো কারণে ভারতের বিরুদ্ধে খুব বেশি রান পেতেন না। দ্বিতীয় কারণ, ওনার শ্রেষ্ঠ সময়ে চাকরী – সংসার নিয়ে ব্যস্ততা। তবুও কিছু দেখেছি। যেমন ২০০৩ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে সেঞ্চুরি।
মনে পড়ছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ম্যাচের ঠিক আগে দক্ষিণ আফ্রিকার দলগত শক্তি নিয়ে ধারাভাষ্যকারদের মধ্যে আলোচনা। বেশিরভাগেরই মত ছিল, ওয়েস্ট ইন্দিজকে স্রেফ উড়িয়ে দেবে দক্ষিণ আফ্রিকা। দলগত শক্তি বিচার করলে সেটাই স্বাভাবিক ছিল। শুধু একজন বলেছিলেন, কে সেটা আজ আর মনে নেই, রিমেম্বার, লারা ইজ ফলিং ডিউ। অনেকদিন বড় রানের ইনিংস খেলেন নি লারা, সময় হয়ে এসেছে।
সেই ইনিংস! ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম দুটো উইকেট পড়ে যায় মাত্র ৭ রানে। ডোনাল্ড, পোলক, এন্তিনি, ক্যালিস, ক্লুস্নার, বোজে সম্মিলিত দুরন্ত বোলিং আক্রমণ। ফিল্ডিঙে জন্টি রোডস আর হার্শাল গিবসের নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা তখন সন্দেহাতীত ভাবেই বিশ্বশ্রেষ্ঠ। তবু সেদিন থামানো যায় নি লারাকে। তার ১১৬ রানে ভর করেই সেদিন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচটি জিতে নেয় ৩ রানে।
কিন্তু নিছক রান নয়, সেদিন বিস্ফারিত চোখে দেখেছিলাম লারার ব্যাট করার ধরন। বল খেলার ঠিক আগের মুহূর্তে ছোট্ট সাফল করে অফের দিকে চলে আসতেন। ব্যাট নেমে আসতো মাথারও ওপর থেকে। অন্য গ্রেট ব্যাটসম্যানদের দেখেছি কভার বা অফ ড্রাইভ খেলার সময় কবজি স্থির থাকে। লারার ক্ষেত্রে শেষ মুহূর্তে কব্জির ট্যুইস্ট থাকত। এর ফলে শটের ওপর নিয়ন্ত্রন কমে যাওয়ার কথা কিন্তু লারা উল্টে এটা ব্যবহার করতেন বল প্লেস করার কাজে। স্কয়ার কাট মারার পর মাথার ওপর চক্রাকারে একবার ঘুরত তাঁর ব্যাট।
এ বস্তু পরে এবি ডি ভেলিয়ারসের ব্যাটিঙেও দেখেছি। ফ্লিক খেলার পরও মাথার ওপর ব্যাট দিয়ে বলকে যেন ‘গুড বাই’ জানাতেন লারা। বলে বাউন্স বেশি থাকলে প্রায়ই হুক বা কাট খেলার সময় দুটো পাই শুন্যে থাকত। আর স্পিনারদের লিফট করার সময় ব্যাটের আর্ক হত ৩৬০ ডিগ্রিরও বেশি – মাথার ওপর থেকে আরম্ভ করে নিজের পিঠের পেছন অব্দি। সেই সঙ্গে অসাধারণ ফুটওয়ার্ক – অফ স্ট্যাম্পের এক গজ বাইরে পিচ হওয়া বলকে মিড উইকেট আর মিড অনের মধ্যে দিয়ে এমন ভাবে ড্রাইভ করতেন যেন এর চেয়ে সহজ শট হয় না।
এর কোনোটাই ক্রিকেট কোচিং ম্যানুয়ালে খুঁজে পাবেন না। আর এই কারনেই লারার ব্যাটিং দেখার অভিজ্ঞতা অনন্য। যেমন উল্লিখিত সেঞ্চুরিটা। অথচ প্রথম বলেই আউট হওয়ার ক্ষীণ সম্ভাবনা ছিল। এন্তিনির বলে অফ স্ট্যাম্পের বাইরে লারার স্ল্যাশ উড়ন্ত ক্যালিসের আঙ্গুলের পাশ দিয়ে বাউণ্ডারির ওপারে চলে যায়।
কথায় বলে চ্যাম্পিয়নস লাক! ঠিকই। এরপর আরম্ভ হোল শিল্প প্রদর্শনী। ডোনাল্ডের মাথার ওপর দিয়ে ছয়। উইকেটের দুপাশে চোখ জোড়ান ড্রাইভ। ক্লুস্নারের ওভারপিচ বলে কব্জির ছোট্ট মোচড়ের সঙ্গে খেলা ফ্লিক – না, চার নয়, ছক্কা। বোজের স্পিন বলের বিরুদ্ধে বেরিয়ে এসে অন সাইডে পুশ। ধারাভাষ্যকার জানাচ্ছেন, সম্ভবত দুই রান হবে – না, না, দুরন্ত টাইমিঙ্গের ফলে চার রান। শুধুই টাইমিং?
আর প্লেসিং-এর কথা কে বলবে, স্যার? এরপর ছিল স্কয়ার কাট। স্পিন এবং ফাস্ট – দুই ধরনের বোলিংয়ের বিরুদ্ধেই। খুব ভালো ইনিংস দেখে অনেকেই সাহিত্য করে বলেন, ব্যাট ঝলসে উঠল। ক্রিকেট মাঠে ব্যাট ঝলসে ওঠা যদি আক্ষরিক অর্থে দেখতে গেলে লারার স্কয়ার কাট দেখতে হবে।
বাঁ পা অফ স্ট্যাম্পের বাইরে নিয়ে গিয়ে অলস ভঙ্গীতে ব্যাট মাথার ওপর তেরছা ভাবে নিয়ে গিয়ে আচমকা অস্বাভাবিক খিপ্রতায় তা নেমে নামিয়ে আনতেন বলের ওপর। সেই সঙ্গে কব্জির মোচড়ে বলকে প্লেস করতেন কভার থেকে ডিপ থার্ড ম্যানের মধ্যে নিজের পছন্দমত জায়গায়। সব শেষে শট খেলার পর মাথার ওপর ব্যাট ঘুরিয়ে আস্ফালন।
তবে স্ট্যাটিস্টিকস দিয়েও লারার বিশেষত্ব কিছুটা বোঝা সম্ভব। ধরুন টেস্ট ক্রিকেটে তার স্ট্রাইক রেট – ৬০.৫। সচিনের সেটা ৫৪র কাছাকাছি। পন্টিং, সাঙ্গাকারা, এবি ডি ভেলিয়ারস, বিরাট – কারোর ক্ষেত্রেই এই সংখ্যা ৬০ ছোঁয় নি। অথচ টেস্টে দ্রুত রান তোলার প্রয়োজন নেই, বিশেষ করে সে সময়ের ওয়েস্ট ইন্ডিজের মত দলের ক্ষেত্রে। এইখানেই লারার ব্যাটিঙের আকর্ষণ।
এই আকর্ষণের গুরুত্ব সম্ভবত সানি বা রাহুল বুঝতে পারবেন না, পারবেন ভিভ, শেবাগ বা বোথাম। বা ইদানিং কালের ঋসভ পন্থ। হার জিতের চেয়েও তাঁদের কাছে মাঠের মধ্যে আধিপত্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বা দর্শকদের উচ্ছ্বাসের। গ্যালারীতে বল উড়িয়ে দেওয়ার মুল্য স্কোর কার্ডের কাছে মাত্র ছয় রান, কিন্তু দর্শকদের বা খেলোয়াড়দের কাছে বহু-বহুগুন বেশি। বা মাটি থেকে মিডল স্ট্যাম্প উপড়ে দেওয়ার মুল্য। বিশেষ করে সেই স্ট্যাম্প যদি বয়কটের মতো ব্যাটসম্যানের হয়।
লারার টেস্টের সবচেয়ে বড় দশটি ইনিংসের ওপর নজর রাখুন। অন্তত পাঁচটি ইনিংস এমন বোলিং আক্রমনের বিরুদ্ধে খেলা যেটি নয় সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ (ম্যাকগ্রা, ওয়ার্ন, ম্যাকগিল, লি বা গিলেস্পি), নয় অসাধারণ (মুরলী, ভাস; পোলক, এন্তিনি, ক্যালিস, নেল)। তুলনায় শচীনের টপ টেনের মধ্যে শুধুমাত্র সিডনিতে খেলা ২৪১ (লি, গিলেস্পি, ম্যাকগিল) বা নাগপুরের ১৭৯ (ওয়ালস, বেঞ্জামিন) ভালো বোলিঙের বিরুদ্ধে।
এই দশটি ইনিংসের সম্মিলিত স্ট্রাইক রেট লারার ৬৯, সচিনের ৫৯। অর্থাৎ ক্রিজে সেটল হয়ে যাওয়ার পর বোলিং কে ছিঁড়ে ফেলতেন লারা। তুলনায় বড় ইনিংসেও শচীনের স্ট্রাইক রেট খুব একটা বাড়ত না। এরপর উইজডেনের সেরা ইনিংসের লিস্টে লারার প্রাধান্য থাকলে কার কি বলার থাকতে পারে?
তবে লারা বনাম শচীন এই লেখার বিষয় নয়। সে যুগের অপর শ্রেষ্ঠ ব্যাট শচীনের তুলনায় একটা বিশেষ ক্ষেত্রে লারার অবস্থান তুলে ধরলাম মাত্র। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যানের আলোচনায় শুধু স্কোর নয়, কীভাবে, কতটা প্রাধান্যের সঙ্গে সেই স্কোর করা হয়েছে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। অন্তত আমার কাছে। আরও আছে – প্রতিপক্ষের শক্তি, ম্যাচের পরিস্থিতি, ক্রিজের অন্য প্রান্তের সাপোর্ট, দর্শনীয়তা।
আমাদের কপাল ভালো যে ব্রায়ান লারার কয়েকটি এমন ইনিংস ইউ টিউবে রয়েছে যা সর্বকালের সেরার মধ্যে পড়ে। যেটার উল্লেখ করলাম তা ছাড়াও রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ২৭৭, ২২৬ বা ১৫৩। নিশ্চই আগেই দেখেছেন তবু আবার দেখলেও ক্ষতি কি? বিরাট কোহলি – সৌরভ গাঙ্গুলি থেকে অন্তত কিছুক্ষণের মনটা অন্যদিকে যাবে।