অধিনায়কদের নায়কোচিত সব ইনিংস

সীমিত ওভারের ক্রিকেটে যাই হোক, সাদা পোশাকে কিন্তু অধিনায়কত্ব করা বেশ কষ্টসাধ্যই। তা এই কষ্টসাধ্য কাজটাই কেউ কেউ করেছেন একেবারে সামনে থেকে দাঁড়িয়ে। ব্যাট হাতে সেই ‘লিডিং ফ্রম দ্য ফ্রন্ট’ নায়কদের গল্পই হবে আজকে।

‘ক্যাপ্টেন লিডিং ফ্রম দ্য ফ্রন্ট’ – ক্রিকেটে বেশ পরিচিত একটি বাক্য। দলকে নেতৃত্ব দানের পাশাপাশি দারুণ কোন ইনিংস খেলে, কিংবা দুর্দান্ত কোন স্পেলে বল করে খেলোয়াড় হিসেবেও সাহায্য করা, ম্যাচ উইনার হওয়া – এটাই সেই অপ্তবাক্যের আসল কারণ। তবে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে যাই হোক, সাদা পোশাকে কিন্তু অধিনায়কত্ব করা বেশ কষ্টসাধ্যই। তা এই কষ্টসাধ্য কাজটাই কেউ কেউ করেছেন একেবারে সামনে থেকে দাঁড়িয়ে। ব্যাট হাতে সেই ‘লিডিং ফ্রম দ্য ফ্রন্ট’ নায়কদের গল্পই হবে আজকে।

  • ডন ব্র্যাডম্যান- ২৭০ বনাম ইংল্যান্ড, ১৯৩৭

স্যার ডন ব্রাডম্যান তখন অস্ট্রেলিয়ার নতুন অধিনায়ক। ১৯৩৬/৩৭ এর অ্যাশেজের প্রথম দুই টেস্টেই যখন ডন ব্রাডম্যান শূন্য রানেই ফিরে গেলেন, চারপাশে সমালোচনা ছেঁকে ধরছিল বেশ। সেসময় আবার ব্র্যাডম্যান বাঁধিয়ে বসলেন ফ্লুজনিত সমস্যা।

তবে নায়কের দরকার যখন হল, ব্র্যাডম্যান তখনই স্বরূপে হাজির হয়ে গেলেন। সিরিজের তৃতীয় টেস্টে ৯৭ রানেই ৫ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর জ্যাক ফিংলেটনকে সাথে নিয়ে ৩৪৬ রানের রেকর্ড জুটি গড়ে ফেললেন। অস্ট্রেলিয়াও সে টেস্ট জিতে নিল ৩৬৫ রানের বিশাল ব্যাবধানে। আর ব্রাডম্যান? ২৭০ করে ফিরে গিয়েছিলেন প্যাভিলিয়নে!

  • ব্রায়ান লারা – ১৫৩* বনাম অস্ট্রেলিয়া, ১৯৯৯

ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ অস্ট্রেলিয়া তো নিয়েই নিয়েছিল, প্রথম ইনিংসেই গড়ে ফেলেছিল ৪৯০ রানের পাহাড়। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাট করতে এসেও যে খুব সুবিধা করতে পারছিল এমনটাও না, ৯৮ রানেই পড়ে গেছিল ৬ উইকেট। কিন্তু তখনই শেরউইন ক্যাম্পবেল আর রিডলি জ্যাকবস দুর্দান্ত এক পার্টনারশিপ গড়ে ম্যাচে কিছুটা হলেও ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ফিরিয়ে আনেন।

শেষবেলায় এ পার্টনারশিপ আরো পয়া হয়ে যায় যখন দ্বিতীয় ইনিংসে অস্ট্রেলিয়া অলআউট হয়ে যায় মাত্র ১৪৬ রানেই। আর এতেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের সামনে লক্ষ্য দাঁড়ায় ৩০৮ রানের। তবে আবারও ব্যাট করতে নামলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ আবারও দ্রুত উইকেট হারিয়ে ফেলে। কিন্তু ব্রায়ান লারা সাথে থাকলে আর ভয় কি? ১৫৩ রান করে ক্রিজে দাঁড়িয়েই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ১ উইকেটে জিতিয়ে ফেরেন তিনি!

  • পিটার মে – ২৮৫* বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ১৯৫৭

ইংল্যান্ড তাদের প্রথম ইনিংসে অলআউট হয়ে গেছিল ১৮৬ রানে। ১৪৬ রানে পিছিয়ে থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজও করে ফেলেছিল ৪৭৪ রান। বিশাল ব্যাবধানে পিছিয়ে থেকে ইংল্যান্ড যখন দ্বিতীয় ইনিংসে আবার ব্যাট করতে নামল, দেখা গেল আবারও শুরুতেই দ্রুত উইকেটের পতন ঘটে যাচ্ছে। কিন্তু এবার ত্রাতা হিসেবে এগিয়ে আসলেন অধিনায়ক নিজেই। কলিন কাউড্রে কে সঙ্গে নিয়ে তিনি ক্রিজে ছিলেন ১০ ঘন্টা। ইংল্যান্ডও শেষ অবধি করেছিল ৫৮৩ রানের পাহাড়সহ রান।

তবে পিটার মে’র অপরাজিত ১৫৪ ইংল্যান্ডকে জেতাতে পারেনি, শেষ অব্দি ড্র নিয়েই মাঠ ছাড়ে ইংল্যান্ড।

  • গ্রাহাম গুচ –  ১৫৪* বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ , ১৯৯১

ওয়েস্ট ইন্ডিজের সে দলটার বোলিং লাইনআপে ছিল কার্টলি অ্যামব্রোস, ম্যালকম মার্শাল, কোর্টনি ওয়ালশের মত বোলাররা। ইংলিশ কন্ডিশনের ফায়দা তুলে এরা রীতিমত আগুন ঝরাচ্ছিল সেদিন। দলের কেউই ২৭ রানের বেশি করেতে পারেনি শুধুমাত্র অধিনায়ক ছাড়া। কোন অধিনায়ক? গ্রাহাম গুচ! দলের ষাট ভাগ রান সেদিন তিনি একাই করেছিলেন। গুচের অপরাজিত ১৫৪ তেই সেদিন ম্যাচটা জিতে নিয়েছিল ইংল্যান্ড।

  • গ্রায়েম স্মিথ – ১৫৪* বনাম ইংল্যান্ড, ২০০৮

১৯৬০ সালের পর দক্ষিণ আফ্রিকা ইংল্যান্ডে তাদের প্রথম সিরিজ জয়ের খোঁজে ছিল তখন। কিন্তু ইংল্যান্ডের ২৩১ রানের বিপরীতে ব্যাট করতে নেমে দক্ষিণ আফ্রিকার ৯৩ রানেই ৪ উইকেট পড়ে গেল। তবে শেষ অব্দি দক্ষিণ আফ্রিকা ৩১৪ রান করলেও এই রানের মধ্যে স্মিথের অবদান ছিল মাত্র সাত। কিন্তু নিজের সেরাটা তুলে রেখেছিলেন চতুর্থ ইনিংসের জন্য।

ইংল্যান্ড তাদের তৃতীয় ইনিংসে করেছিল ৩৬৩ রান। রান তাড়া করতে এরপর দৃশ্যপটে গ্রায়েম স্মিথ । টানা পাঁচ ঘন্টা ব্যাট করে ১৫৪ রানে অপরাজিত থেকে দক্ষিণ আফ্রিকাকে জিতিয়েই মাঠ ছাড়েন তিনি।

  • ব্রেন্ডন ম্যাককালাম – ২২৪ বনাম ভারত, ২০১৪

ব্রেন্ডন ম্যাককালাম নাম শুনলে আমাদের মাথাতে অবশ্য স্থিতধী টেস্টের চাইতে ধুন্ধুমার টি-টোয়েন্টিই বেশি মাথায় আসে। তা আসলে কি হবে, টেস্ট ক্রিকেটের আধুনিক যুগের অন্যতম সেরা অধিনায়কদের একজন ছিলেন ব্রেন্ডন ম্যাককালাম। অকল্যান্ডের সে ম্যাচেও তিনি এ প্রমাণ দিয়েছিলেন আরেকবার। এমনিতেই তো ভারতের ঘরের বাইরের রেকর্ড ভাল ছিল না, এর মধ্যে ম্যাককালামের ২২৪ ভারতকে সে ম্যাচে একেবারেই ছিটকে দিয়েছিল।

  • গ্রেগ চ্যাপেল – ১২৩ ও ১০৯* বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ১৯৭৫

এটা ছিল গ্রেগ চ্যাপেলের অধিনায়কত্বের প্রথম ম্যাচ। আর সে ম্যাচেই জোড়া সেঞ্চুরি করে রেকর্ডবুকে নিজের নাম তুলে ফেলেছিলেন তিনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ এমনিতেই ম্যাচে ছিল না কখনও, চ্যাপেলের এই দুর্দান্ত ইনিংসের পর অস্ট্রেলিয়ার আট উইকেটের জয় পেতে তাই কোন সমস্যাই হয়নি।

  • মহেন্দ্র সিং ধোনি – ২২৪ বনাম অস্ট্রেলিয়া, ২০১৩

২০১৩ তে সেই ম্যাচে প্রথমে ব্যাট করে অস্ট্রেলিয়া প্রথমে ব্যাট করে স্কোরবোর্ডে তুলে ফেলে ৩৮০ রান। জবাব দিতে নেমে চেতেশ্বর পূজারা আর শচীন টেন্ডুলকার ফিরে গেলে চাপে পড়ে যায় ভারত। আর তখনই মহেন্দ্র সিং ধোনি ব্যাট হাতে নেমে পড়েন। ২৬৫ বলে ২২৪ রান করে ভারতকে ৫৭২ রানের বড় সংগ্রহ এনে দেন তিনি। দ্বিতীয় ইনিংসেও ২৪১ রানের বেশি করতে পারেনি অস্ট্রেলিয়া, আর এতেই ভারত জিতে যায় আট উইকেটের বিশাল ব্যাবধানে।

  • ওয়াসিম আকরাম – ২৫৭* বনাম জিম্বাবুয়ে, ১৯৯৬

টসে জিতে ব্যাট করতে নেমে জিম্বাবুয়ে করতে পারে মাত্র ৩৭৫ রান। জবাব দিতে নেমে টপ অর্ডার ভাল করলেও এরপরই তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ে পাকিস্তানের ব্যাটিং অর্ডার। ১৮৬ রানে ৬ উইকেট পড়ে গেলে ওয়াসিম আকরাম ব্যাট হাতে ২৫৭ রানের অনবদ্য ইনিংস খেলেন। সেসময় ২২.৬৪ গড়ের কারো জন্যে এটা সাংঘাতিকই বটে।

  • গ্রায়েম স্মিথ – ‘ব্রোকেন হ্যান্ড ইনসিডেন্ট’

এটা কোন ইনিংস নয়, কিন্তু ‘লিডিং ফ্রম দ্য ফ্রন্ট’ নিয়ে লিখতে বসলে এটা বাদ দিয়ে কোনভাবেই লেখা যাবে না। সে বিকালে আর আট ওভার টিকতে পারলেই দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচটা ড্র করে ফেলত। কিন্তু অধিনায়ক স্মিথ হাত ভেঙে ড্রেসিং রুমে ছিলেন। এদিকে দ্রুত পড়ে গেছিল নয় উইকেট। আর তখনই ভাঙা হাত নিয়ে নেমে পড়েন স্মিথ। যদিও তিনি ১৭ বলের বেশি টিকতে পারেননি। কিন্তু সেটাই হয়ে গেছে ইতিহাস।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...