সবাই তাঁর লেগ গ্ল্যান্সের কথা মনে রেখেছে। ক্রিকেটের একনিষ্ঠ ভক্তরা হয়তো ইয়র্কশায়ারের বিরুদ্ধে তাঁর আর সিবি ফ্রাইয়ের পার্টনারশিপ মনে রেখেছে। বা ইংল্যান্ডের হয়ে অভিষেকেই ৬২ ও ১৫৪। কিন্তু কজন আর মনে রেখেছেন, যখন অ্যান্থনি ডি মেলো ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সূচনা করছেন, এবং তাঁর কাছে সাহায্য ভিক্ষা করতে গেছেন তখন তাঁর হিমশীতল উত্তর?
‘না হে। আমি আর দুলীপ ইংরেজ ক্রিকেটার। তোমাদের সাহায্য করতে পারবো না। রাস্তা দেখো।’ তিনি কুমার শ্রী রণজিৎসিংজি। জন্মেছিলেন ১৮৭২ সালের ১০ সেপ্টেম্বর। কাথিয়ারের সরোদার গ্রামে।
ব্রিটিশদের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র ছিলেন রঞ্জি। এবং ব্রিটিশদের মন জয় করার পিছনে অন্যতম ভূমিকা ছিল ক্রিকেটের। ইংরেজদের খেলায়, ইংরেজদেরই এককাঠি ওপরে। তাও আবার এক ‘কালা’ আদমি। সত্যজিৎই বোধহয় তাঁকে নিয়ে লিখেছিলেন, ‘সাহেবদের চোখ টেরিয়ে যেত কালা আদমির খেলা দেখে।’
মাত্র ১৬ বছর বয়সে নোয়ানগরের গদি পাবার কোনো আশা নেই দেখে, রঞ্জি পারি দিলেন বিলেতে। এর আগে ক্রিকেট খেলা বলতে রাজকোটের রাজকুমার কলেজে। ১৮৯৩ সালে হয়ে দাঁড়ান কেমব্রিজের ব্লু। রঞ্জির জীবনীকাররা লিখেই গেছেন, রঞ্জি ইংল্যান্ডে একরকম ভারতে আরেক রকম।
ইংল্যান্ডে তিনি নিতান্তই এক অসাধারণ ক্রিকেটার ও এক নেটিভ স্টেটের কুমার। বিলেতেই জীবনযাপনে বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন রঞ্জি। সেখানে তাঁর জীবনযাপন ছিল যাকে বলে, ‘কিং সাইজ’। সে কারণে ধার-দেনাও হয়েছিল বিস্তর। কিন্তু ইংরেজদের মনে জায়গা পাকা করতে সেটা তো জরুরি ছিলই। ভারতে তিনি রাজাধিরাজ। ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা করতেই চাইতেন না। বজায় রাখতেন গাম্ভীর্য্য।
তবে ক্রিকেটকে যে কূটনীতির অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা যায়, এ বোধহয় রঞ্জিই দেখিয়েছিলেন। নোয়ানগর এস্টেটের রাজা হতে ইংরেজদের সাথে তাঁর সখ্য দারুণ কাজে আসে। জন্মসূত্রে তিনি কোনোভাবেই নোয়ানগরের রাজ পরিবারের সদস্য নন। এস্টেটের এক অফিসারের কর্মচারির নাতি মাত্র। অথচ ১৯০৭ সালের ১০ মার্চ তিনি এস্টেটের রাজা হয়ে বসলেন।
ব্রিটিশদের সাথে দারুন সখ্য ছাড়াও অবশ্য তৎকালীন রাজার টাইফয়েডে আকস্মিক মৃত্যু রঞ্জির পথ পরিষ্কার করে। ৫৬২ নেটিভ স্টেটের মধ্যে মাত্র ৪০ টি স্টেটের ব্রিটিশ রাজের সাথে সরাসরি যোগাযোগ ছিল। এর অর্থ ছিল এইসব স্টেট ব্রিটিশ রাজের অনুগত।নোয়ানগরের মতো ছোট এস্টেটের পক্ষে এই যোগাযোগ স্থাপন করা খুবই কঠিন ছিল। রঞ্জিই ১৯২০ সালে এডুইন মন্টেগু কে ধরে-টরে সেই স্টেটাস লাভ করেন। সেই খাতিরে নোয়ানগরে মন্টেগুর মূর্তিও বসানো হয়। তবে রাজা হিসাবে রঞ্জি বেশ জনপ্রিয় ছিলেন।
এতক্ষণ রাজা ও রাজকুমার রঞ্জিকে নিয়ে বললাম। এবার একটু ক্রিকেটার রঞ্জিকে নিয়ে বলি। বিখ্যাত ক্রিকেট লেখক মিহির বোসের মতে, রঞ্জিই প্রথম ক্রিকেটার যিনি ভারতকে দেখিয়েছেন, যে ইংরেজের খেলায় আমরাও ইংরেজকে হারাতে পারি।
তৎকালীন গড়পড়তা ব্যাটসম্যানের তুলনায় রঞ্জি ছিলেন অনেক বেশি উদ্ভাবনী ক্ষমতাসম্পন্ন ক্রিকেটার। সাসেক্স কাউন্টি তাঁর এতই প্রিয় ছিল, যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ১৯২০ সালে বিলেত যান সাসেক্সে খেলতে। যদিও ততদিনে একটি দুর্ঘটনায় একটি চোখ হারিয়ে তিনি আর আগের রঞ্জি নেই। তাছাড়া বয়সও ও হয়েছে ৪৮।
১৯২০ সালে তিন ম্যাচে ৪০ মতো রান করে ফিরে আসেন। এক চোখ দিয়ে ব্যাটিং করার ওপরে একটা বই লিখতে চেয়েছিলেন তিনি। সেটাও একটা কারণ হতে পারে সাসেক্সে ফিরে যাবার। রঞ্জি সম্পর্কে গিলবার্ট জেসপ লিখেছেন, ‘ক্রিকেটের স্বর্ণযুগের সব চেয়ে উজ্জ্বল তারা রঞ্জি।’
ভারতের সেরা (এখন অবশ্য আর নয়, আইপিএল এসে গেছে যে!) ঘরোয়া প্রতিযোগিতা যাঁর নামে, তিনি ভারতীয় ক্রিকেটের জন্যে কিছু বিরাট অবদান রেখেছেন বলে ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি না। সি.কে. নাইডু ট্রফি বা বিজয় মার্চেন্ট ট্রফি না হয়েও তাঁর নামেই এই ট্রফি থেকে যাওয়া বোধহয় আমাদের তৎকালীন বোর্ডকর্তাদের চূড়ান্ত কলোনিয়াল হ্যাংওভার ও বর্তমান কর্তাদের চূড়ান্ত ইতিহাসবিমুখতারই প্রতীক। তবে, ক্রিকেটার হিসাবে রঞ্জির মাহাত্ম্য কখোনই অস্বীকার করা যায় না।