রবিন ফ্রাইডে, অদেখা ফুটবল বিস্ময়

ক্লাইভ থমাস সাবেক ফুটবল রেফারি। যিনি পেলে, ইয়োহান ক্রুইফ, জর্জ বেস্ট খেলা ফুটবল ম্যাচ পরিচালনা করেছিলেন। ১৯৭৬ সালের মার্চ মাস। অন্যান্য দিনের মতনই ছিল। রিডিং বনাম ট্র‍্যানমেয়ার রোভার্সের ম্যাচ চলছে।

ক্লাইভ থমাস আজকের এই ম্যাচের দায়িত্বে আছেন। রিডিং ৫-০ তে ম্যাচ জিতল। এই ৫ গোলের দ্বিতীয় গোলটি দেখে ক্লাইভ থমাস গোল স্কোরারকে গিয়ে বললেন তিনি পেলে, ইয়োহান ক্রুইফ, বেস্টদের ম্যাচেও ছিলেন, তবে এমন গোল আগে কখনো দেখেননি। এটাই তাঁর দেখা সেরা গোল।

এই প্রশংসার জবাবে গোল স্কোরার বললেন, ‘সত্যি! তাহলে তোমার এখানে আরো আসা উচিৎ।’

কেমন গোল ছিল সেটি আর কে-ই এই গোল স্কোরার প্রশ্ন জাগাটা স্বাভাবিক। এই গোলটির আসলে কোনো ভিডিও নেই, স্টিল ইমেজও পাওয়া যায় না। পেলে সৌভাগ্যবান। পিটার ক্রাউচ স্টোক সিটির হয়ে এই গোলের সাথে কিছুটা মিলে এমন এক গোল করেছিলেন।

সেই ম্যাচে আবার ইয়াইয়া তোরেও করেছিলেন দূরপাল্লার এক দারুণ গোল। গোলটির বর্ণনা দিচ্ছি একটু পরে। কয়েক লাইনেই বলব। যে ফুটবলার গোলটি করেছিলেন তাঁর সম্পর্কে বলা হয় ‘দ্য গ্রেটেস্ট ফুটবলার ইউ নেভার স’। তাঁর নাম রবিন ফ্রাইডে। তিনি ফুটবল ভালবাসতেন। ভালবাসতেন মদ এবং নারীও।

ফুটবল-মদ-নারী, এই তিনেই জীবন ভারি।

প্রতিপক্ষ দলের গোলপোস্ট থেকে ৩০-৩৫ গজ দূরে ভাসমান বল পেলেন রবিন ফ্রাইডে। বলটি যখন পেলেন তখন তিনি নিজ দলের গোলপোস্টের দিকে ছিলেন মানে প্রতিপক্ষের জালের উল্টো। বুক দিয়ে রিসিভ করলেন। এরপর কী করবেন? সতীর্থকে পাস দিবেন? বল পায়ে নিয়ে ঘুরে আক্রমণে যাবেন? দুটোর কথা আমি বললাম।

আপনার অপশনের অভাব নেই। কিন্তু আমরা নিতান্তই সাধারণ মানুষ। চিন্তাভাবনাটাও তেমন। তাই এর চেয়ে বেশি কিছু ভাবতে পারি না। কীভাবে যে স্বপ্ন দেখি একদিন বই-টই লিখবো! যাই হোক রবিন ফ্রাইডে বুক দিয়ে বল রিসিভ করলেন। ওই সেই অবস্থাতেই ভলি করলেন। সবাইকে হতভম্ব করে দিয়ে বল চলে গেল ট্রেনমেয়ার রোভার্সের জালে। সেদিন মনে হয় বলও বোকাপাখি হয়ে গিয়েছিল।

রবিন ফ্রাইডেকে রিডিং ক্লাবের এক সমর্থক সবসময় গালি দিতেন, দেখতেই পারতেন না। কারণ হিশেবে বলত এই শালা তিনজন প্লেয়ারকে ড্রিবলিং করে পাশ কাটিয়ে যেত, গোলের সামনে ফরওয়ার্ড ফাঁকা দাড়িয়ে আছে। এরপরেও পাস না দিয়ে আবার ওই তিনজনকে ড্রিবল করতেন।

ব্রাজিলিয়ান সক্রেটিসকে ১৯৮৩ সালে দলে ভেড়াতে চাইলেন ইতালিয়ান দুই জায়ান্ট রোমা আর জুভেন্টাস। দিতে চাইলেন দুই মিলিয়ন পাউন্ডও। কিন্তু সক্রেটিস যোগ দিলেন ফিউরেন্টিনাতে। কারণ রোমা আর জুভের চুক্তিপত্রে ছিল ম্যাচ থাকার তিনদিন আগে কোনো রমনীর সহচার্য কামনা করা যাবে না।

সক্রেটিস ব্যাপারটা মানতেই পারলেন না। কম টাকাতেই খেললেন ফ্লোরেন্সের ক্লাবে। রবিন ফ্রাইডে এইদিকে বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে ছিলেন সক্রেটিস থেকে। ট্রেনিং করতেন না ঠিকঠাক, ব্যস্ত থাকতেন পার্টি আর মদ-নারীতেই। অন্যান্য সতীর্থরা এই নিয়ে কোচের কাছে নিজেদের বিরক্তি-হতাশা প্রকাশ করলেন এবং চাইলেন ফ্রাইডেকে দল থেকে বাদ দিতে।

কোচ বললেন, ‘আচ্ছা ঠিকাছে। আমি ওকে বাদ দিব। এই কারণে তোমরা ম্যাচ হারবে, ম্যাচ হারলে উইনিং বোনাস পাবে না। এটাই কি চাও?’ সবাই কায়মনোবাক্যে রাজি হলেন, ‘নো ফ্রাইডে, নো ম্যাচ।’

রবিন ফ্রাইডে ফুটবল বাদে অনেক পেশায় যুক্ত ছিলেন। প্লাস্টার লাগাতেন, মানে রাজমিস্ত্রী ছিলেন। ভ্যান ড্রাইভার ছিলেন। এই প্লাস্টারের কাজ করতে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে গেলেন একবার। তখন বয়স মাত্র কুড়ি। বড়োসড়ো এক পেরেকে এসে পরলেন।

অল্পের জন্যে ফুসফুসে প্রবেশ করল না। একেবারে মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে আসলেন। এই  মারাত্মক দুর্ঘটনার তিন মাস পরে রবিন ফ্রাইডে আবার ফুটবল খেলতে নামলেন। মাঠে তো ডিফেন্ডারদের বোকা বানাতেন। এবার ডাক্তারদেরও করলেন ডাম্বফাউন্ডেড।

একবার এক ম্যাচের মধ্যেই সাইডলাইনে দায়িত্বে থাকা পুলিশকে চুমু দিয়ে বসলেন। দিগম্বর হয়ে নেচেছিলেন বারে। ১৬-তে বিয়ে করলেন, ২৫-এ বিদায় জানালেন ফুটবলকে আর ৩৮ কে জীবনকেই বাই বললেন। সিনেমা, সঙ্গীত কিংবা সাহিত্য অনুপ্রেরণা খুঁজে পেত রবিন ফ্রাইডের কাছ থেকে। তাঁর একভাগ ফুটবলার আর একভাগ রকস্টার।

৭০-৮০ দশকে লিলি-থম্পসনের মতন অ্যাশেজেও হয়তো ত্রাসের কারণ হতে পারতেন রবিন। ক্রিকেটটাও খেলতেন দুর্দান্ত। বাবা অ্যাল্ফ ফ্রাইডে নিশ্চিত করেই বলেছিল এই ছেলে হতো ফাস্ট বোলার।

লম্বা চুলের রবিন ফ্রাইডে চেলসি, কিউপিআর, রিডিং, কার্ডিফে খেলেছেন। জেলেও থেকেছেন কম বয়সে মদ্যপানের জন্যে। ছোটোখাটো অপরাধের সাথেও তার নাম জুড়ে থাকত। জেলে থাকা অবস্থায় তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল ফুটবল। কয়েদিদের দলের হয়ে তাঁর খেলা দেখেই তাকে দলে আনতে মরিয়া হয়ে গিয়েছিল রিডিং।

রবিন ফ্রাইডে ছিলেন বিশেষ কিছু। তাঁকে আগলে রেখে, স্বাধীনতা দিয়েই তার সেরাটা বের করে আনা সম্ভব। সেটাই করেছিলেন রিডিং বস চার্লি হার্লি। শুরুতেই বলেছিলাম সেই সতীর্থ আর কোচের আলাপ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link