শচীন-অধ্যবসায় ও ২৪১

বছরের শুরুর দিনে নতুন সংকল্প নেন না এরকম মানুষ খুব কমই আছেন। তবে ২০০৪ সালের শুরু দিন শচীন রমেশ টেন্ডুলকার কি সংকল্প নিয়ে ছিলেন সেটা জানা না থাকলেও আন্দাজও পাওয়াই যায়। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিটা একবার ভাবুন!

ততক্ষণে চলতি সিরিজে বীরেন্দ্র শেবাগ, রাহুল দ্রাবিড়, সৌরভ গাঙ্গুলি, ভিভিএস লক্ষণ প্রত্যেকে একাধিকবার বড় রান করে ফেলেছেন। সেখানে তাঁর অবদান বলতে অ্যাডিলেডে দ্বিতীয় ইনিংসে গুরুত্বপূর্ন দুটি উইকেট। তার উপর মেলবোর্নের দ্বিতীয় ইনিংসে দিনের শেষে নতুন বলের সামনে তাকে গার্ড করে সৌরভ নিজে চলে গেলেন ব্যাট করতে।

কোনো নৈশপ্রহরী নামলে আলাদা কথা ছিল, কিন্তু দুই উইকেট পরার পরে ফর্ম বা পরিস্থিতির কারণে তার আগে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠিত ব্যাটসম্যান ব্যাট করতে গেছেন এটা তার ব্যাটসম্যানশিপের গর্বে আঘাত করার জন্য যথেষ্ট।

অজিত আগারকারের পরিবারের সঙ্গে সিডনির একই রেস্টুরেন্টের একই টেবিলে বসে একই ডিশ অর্ডার করে পরপর তিনদিন ডিনার করাটা আপেক্ষিক ভাবে কুসংস্কার হলেও এর মধ্যেও লুকিয়ে ছিল এক অদম্য জেদ, সংকল্প আর অধ্যবসায়। যা তাঁকে ৪৩৬ তা ডেলিভারির ভেতর একটাও কভার ড্রাইভ মারতে প্রলুব্ধ করেনি।

ক্রিকেটের ভীষ্ম, যার প্রতিজ্ঞার কাছে গুনে গুনে ৪৩৬ বার হার মেনেছে অস্ট্রেলীয় বোলিং। ১৯৯ টা টেস্টে মানুষ দেখেছে তার প্রতিভার ঝলকানি আর এই একটা টেস্টে সংকল্পের। ৩৩টা বাউন্ডারির মাত্র তিনটা অফ সাইডে, ২৪১ এর মধ্যে ১৮৬ রান অন সাইডে। এটাও সম্ভব!

অনেক ব্যাটসম্যানকে দেখেছি ব্যাড প্যাচ চলাকালীন নিজের পছন্দের শট, যেটা খেলে বারবার আউট হচ্ছেন সেটা ইনিংসের শুরুতে না খেলতে। তারপর আস্তে আস্তে সেট হয়ে যাওয়ার পরে সেই শট খেলতে। আর এখানে তিনি আড়াই দিনে একবারও অস্ত্রটা বের করলেন না!

গ্লেন ম্যাকগ্রা সম্পর্কে বলা হয় যে, তাঁর এতটাই নিয়ন্ত্রণ যে সারাদিন এক জায়গায় বল ফেলে যেতে পারেন। আর ইনি তো আড়াই দিন ধরে একবার ও নিজের অন্যতম প্রিয় শটটা খেললেনই না। শুধুমাত্র উইকেটের একদিকে শট খেলে টেস্ট ক্রিকেটের মত আঙিনায় প্রবলতম প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দ্বিশতরান করে গেলেন! এটা কি বাস্তব!

সেই ইনিংসের ওয়াগন হুইল

পার্থে করা ১১৪-এর মধ্যে ছিল বালকের যুবক হয়ে ওঠার কাহিনী, মেলবোর্নের ১১৬ দেখিয়েছিল তার পরিনতবোধ। কিন্ত সিডনির এই ২৪১ দেখিয়েছিল ইচ্ছাশক্তির পরাক্রম। এই ইনিংসটা ছিল যেন জীবনের কঠিনতম সময়ে সমস্ত বাঁধন ছিঁড়ে স্ব-মহিমায় ফিরে আসার গল্প।

সমস্ত হেরে যাওয়া মানুষকে দেখিয়ে দেওয়া যে শুধু জেদ আর ইচ্ছাশক্তির উপর ভর করে কিভাবে মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা যায়। জীবনের শেষ ইনিংসে গাভাস্কারের করা ৯৬ যদি হয়ে থাকে স্পিন বোলিং খেলার আবশ্যিক পাঠ্য তবে এই ইনিংসটা হয়ে থাকুক প্রয়োজনে স্বাভাবিক প্রতিভাকে সরিয়ে শুধু ইচ্ছাশক্তির জোরে নিজের জায়গা ফিরে পাওয়ার জ্বলন্ত উদাহরণ।

ন্যাশনাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে (এনসিএ) পৃথ্বী শ-দের ডেকে ইনিংসটা ডেকে ইনিংসটা দেখানোর ব্যবস্থা করা হোক। বুঝিয়ে দেওয়া হোক, একটা ছোট্ট জিনিস থাকা আর না থাকার পার্থক্যটা বিনোদ কাম্বলি আর শচীন টেন্ডুলকারের পার্থক্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link