সাকিব আল হাসান দলের আক্রমণাত্বক অ্যাপ্রোচ বদলাতে চান না। খেলে যেতে চান ভয়ডরহীন ক্রিকেট। আইরিশদের বিপক্ষে শেষ ম্যাচ হারের পর দলের অধিনায়ক সাকিব অকপটেই নিজেদের লক্ষ্যে অবিচল থাকার কথা বলেছেন। বড় দল হয়ে উঠতে চাইলে যে এভাবেই খেলতে হয় সেই বাস্তবতাটা তুলে ধরেছেন।
সাকিবের মতো কোচ চান্দিকা হাতুরুসিংহেরও সম্ভবত একই ভাবনা। সেটির কিছুটা প্রমাণ মেলে, শেষ ম্যাচে ব্যাটিং বিপর্যয়ের সময়েও সাইডলাইনে হাতুরুর নির্ভার আর উৎফুল্ল থাকার দৃশ্যে। ব্যাপারটা এমন, আক্রমণাত্বক ক্রিকেটের দর্শনে পথ ধরলে বাজে দিন আসতেই পারে।
সাকিব-হাতুরুর চিন্তাভাবনার সাদৃশ্যতা দিনশেষে দলের জন্য স্বস্তির। কোচ অধিনায়কের মতাদর্শের ভিন্নতা দলের জন্য কতটা ব্যর্থতা বয়ে আনতে পারে তার অসংখ্য নজির রয়েছে। বাংলাদেশ দল এখন অন্তত সেই পথে নেই।
সাকিব-হাতুরুর এমন মতাদর্শ মনে করিয়ে দিচ্ছে ইংল্যান্ড ক্রিকেটের দিন বদলের নেপথ্যে থাকা ইয়ন মরগ্যান-ট্রেভর বেলিস যুগলবন্দীর কথা। ২০১৫ বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বের গণ্ডি পেরোতে ব্যর্থ হয়েছিল ইংল্যান্ড। এরপরেই নড়েচড়ে বসে ইংলিশ ক্রিকেট। কোচ ট্রেভর বেলিস আর অধিনায়ক ইয়ন মরগ্যান দলের মধ্যে আক্রমণাত্বক ক্রিকেটের একটা বীজ বপন করে দিলেন। আর তার ফসল হিসেবেই এই ৮ বছরে একবার করে ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছে ইংল্যান্ড।
সাদা বলের ক্রিকেটে ইংল্যান্ড মানেই যেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক দল। একই পথ ধরে, টেস্ট ক্রিকেটের সংজ্ঞাটাও পাল্টে দিয়েছে এই ইংলিশরাই। এমন আক্রমণাত্বক ক্রিকেটে ইংল্যান্ড যে অপরাজেয় হয়ে উঠেছে, ব্যাপারটি এমন নয়। ইংল্যান্ড ম্যাচ হারে, চরমতম বাজে দিনের সাক্ষীও তারা হয়।
কিন্তু ক্রমাগত আক্রমণাত্বক ক্রিকেটে দলটা হয়ে উঠেছে আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ এক দল। এই অ্যাপ্রোচটাই তাদের ক্রিকেটারদের মানসিক আরো দৃঢ় করে তুলেছে। আর সেটিই তাদের সাফল্যের শিখরে পৌঁছাতে সাহায্য করেছে। সেটার প্রমাণ মিলে শেষ এক যুগের সফলতার ঊর্ধগামী গ্রাফের দিকে তাকালেই। ইংল্যান্ডের সমৃদ্ধ ক্রিকেট ইতিহাসে ২০১২ এর আগে কোনো আইসিসি শিরোপা ছিল না। কিন্তু শেষ ১১ বছরে ইংল্যান্ড তাদের ট্রফির ক্যাবিনেট ভারী করেছে একটি ওয়ানডে বিশ্বকাপ আর দুটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা জিতে।
ইংল্যান্ডের এমন আক্রমণাত্বক ক্রিকেটের শুরুটা ২০১৫ বিশ্বকাপের পর থেকেই। এ ক্ষেত্রে কিউদের বিপক্ষে সাউদাম্পটনের একটা ম্যাচের কথা টানা যেতে পারে। ইংল্যান্ড সে ম্যাচে প্রথমে ব্যাট করে নির্ধারিত ৫০ ওভারের ৪ ওভার আগেই অলআউট হয়ে যায়। কিন্তু স্কোরবোর্ডে ঐ ৪৬ ওভারেই তারা তুলেছিল ৩০২ রান।
ইংল্যান্ড সেদিন ম্যাচটা হেরে গিয়েছিল। কিন্তু ম্যাচশেষে তখনকার অধিনায়ক ইয়ন মরগ্যান বলেছিলেন, ‘আমি আমার ক্রিকেটারদের নিয়ে গর্বিত। তারা যেভাবে খেলেছে, এমনটাই আমরা চেয়েছি। এই ইতিবাচক মানসিকতা আমাদের অনেক দূর পৌঁছে দিবে।’
মরগ্যানের সেদিনের কথা মতো ইংল্যান্ড ওয়ানডে ক্রিকেটে সত্যিই অনেক দূর পৌঁছে গিয়েছিল। মরগ্যানের অধিনাকত্ব ২০১৯ বিশ্বকাপ জিতেছিল ইংলিশরা। এ ছাড়া ২০১৫ থেকে ২০১৯- এ সময়কালে ওয়ানডে ক্রিকেটের একটা বিবর্তন ঘটিয়েছিল মরগ্যানের সেই দলটা। তাদের ঐ আক্রমণাত্বক ক্রিকেটের রেশেই এখন কোনো দলের জন্য সাড়ে তিনশো রানের সংগ্রহও নিরাপদ নয়। পাহাড়সম সংগ্রহ গড়েও তাকিয়ে থাকতে হয় বোলারদের দিকে। সময়ের ব্যবধানে ইংল্যান্ডের বদৌলেতে পাল্টে গিয়েছে ক্রিকেটের ধরন।
এই ধরনটা রপ্ত করতেই কিছুটা বিলম্ব হয়েছে বাংলাদেশের। তাই নিয়মিত সাফল্যের ঘুড়িটাও উড়তো না, মাঝে মধ্যে ছিড়ে যেত। কিন্তু কিছুটা দেরি করে হলেও বাংলাদেশ সেই পথে হেটেছে। ব্যাটারদের ফ্রি লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে। সেই ধারাবাহিকতায় সবাই আক্রমণাত্বক ক্রিকেট খেলার চেষ্টা করছেন। এতেই মিলেছে সফলতা। টানা দুই টি-টোয়েন্টি সিরিজে দাপুটে জয়।
হ্যাঁ। আইরিশদের বিপক্ষে শেষটা ভাল হয়নি। বাংলাদেশ ম্যাচটা হেরেছে বাঝে ভাবে। আক্রমণাত্বক ক্রিকেটের ঝুঁকিটাই এখানে। বাজে দিন আসতেই পারে। তবে গুরুত্বপূর্ণ ও স্বস্তির ব্যাপারটা হলো, এমন হারেও সাকিব কিংবা হাতুরুর বোধোদয়ে তেমন কোনো চিন্তার পরিবর্তন ঘটেনি। বরং সাকিব তো অকপটেই বলেছেন, যেভাবে তারা ক্রিকেট খেলছেন, সেটিই ধরে রাখবে দলের ক্রিকেটাররা।
সাকিব-হাতুরুর এমন ভাবনায় বাংলাদেশ কতদূর এগোবে তা সময়ই বলে দিবে। তবে এমন ক্রিকেটেই যে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড নাস্তানাবুদ হয়েছে, সেটি ভুলে গেলে চলবে না। আক্রমণাত্বক ক্রিকেটের সুতোয় বেঁধে এমন বাংলাদেশকেই তো দেখতে চেয়েছিল সবাই। তাই বৃহত্তর সাফল্যের ভাবনায় সাময়িক ধাক্কা সামলানোর সক্ষমতাও থাকতে হবে সবার। এমন সব সাময়িক ধাক্কার বিপরীতে বাংলাদেশের পথচলা হোক সমৃদ্ধ। সাফল্যের সিঁড়ি বেঁয়ে চলতে থাকুক নতুন এ যাত্রা।