সম্পূর্ণ নতুন এক যাত্রার সাক্ষী হতে যাচ্ছেন সাকিব আল হাসান – ক্রিকেটে তাঁর প্রত্যাবর্তন নিয়ে নিশ্চয়ই অনেক স্বপ্নের জাল বুনে রেখেছেন তিনি। অনেক বিশ্লেষক ও শুভাকাঙ্ক্ষি মনে করছেন, এ যাত্রায় সাকিব থাকবেন আরো পরিণত, পারফর্ম করার জন্য হবেন আরো বেশি ক্ষুধার্ত। তবে বাংলাদেশ দলের প্রধান কোচ রাসেল ডমিঙ্গো আর প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নান্নু মনে করেন ফর্ম ধরে রাখতে সাকিবের জন্য ধৈর্যটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
সাকিবের প্রত্যাবর্তন প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তার শৈশবের কোচ মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন খেলার বাইরে থাকলেও মাঠের খেলায় মানিয়ে নিতে সাকিবের জন্য বাড়তি কোন সময় দরকার হবেনা। সাকিব সবসময়ই খেলার জন্য, মাঠে পারফর্ম করার জন্য মুখিয়ে থাকেন।
আইসিসির নিষেধাজ্ঞা শেষে সাকিব আল হাসানের এই প্রত্যাবর্তন নিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট পাড়ায় বিরাজ করছে রীতিমতো উৎসবের আমেজ। বিসিবি আয়োজিত বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট দিয়েই মাঠের খেলায় ফিরবেন সাকিব। এই প্রসঙ্গে প্রধান নির্বাচক বলেন, ‘আমরা সাকিবকে দলে পেতে মুখিয়ে আছি। কিন্তু এই সময়ে আমরা ওর থেকে অতিমানবিক কিছু আশা করতে পারিনা, ওকে খেলতে দিতে হবে, খেলার সাথে মানিয়ে নিতে কিছুটা সময় দিতে হবে। এই সময়টাতে ওর থেকে কিছু আশা করার ব্যাপারে আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে। সাকিব অত্যন্ত অভিজ্ঞ একজন ক্রিকেটার, আশা করি ও ছন্দে ফিরতে খুব বেশি সময় নিবেনা।’
এই বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের প্রত্যাবর্তন প্রসঙ্গ প্রধান নির্বাচকের সুরে সুর মিলিয়েছেন প্রধান কোচ ডোমিঙ্গোও। তার মতে, এক বছরের দীর্ঘ বিরতি শেষে ক্রিকেটে ফেরা সাকিবের থেকে চমৎকার কিছু পারফরম্যান্স আশা করতে সবার আগে ধৈর্য ধরতে হবে। তিনি বলেন, ‘সাকিব খেলার জন্য মুখিয়ে আছেন, এই বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারার জানেন কিভাবে মাঠের খেলায় নিজের সেরাটা দিতে হয়। তাকে এখানে মানিয়ে নিতে এবং নিজের কনফিডেন্সটাকে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নিয়ে যেতে সময় দিয়ে হবে।;’
কিংবা নান্নু কিংবা ডোমিঙ্গো এদের কেউই সাকিবকে ততটা কাছ থেকে দেখেননি যতটা কাছ থেকে দেখেছেন তার শৈশবের দুই কোচ নাজমুল আবেদিন ফাহিম ও মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন। প্রত্যাবর্তনের আগের অনুশীলনটাও সাকিব শুরু করেছিলেন তাদের তত্বাবধানে, সম্পূর্ণ গণমাধ্যমের নজরদারির বাইরে।
করোনা ভাইরাস মহামারিতে পরিবার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র অবস্থান করা সাকিব প্রথমবার দেশে ফিরেন সেপ্টেম্বরের দুই তারিখে। সেই সময়ে স্থগিত হয়ে যাওয়া শ্রীলঙ্কা সফর সামনে রেখে সাকিব অনুশীলন শুরু করেছিলেন তার শৈশবের ঐ দুই কোচের তত্বাবধানে। ফাহিম-সালাহউদ্দিন ছাড়াও বিকেএসপিতে সাকিবের ওই ব্যক্তিগত প্রত্যাবর্তন অনুশীলনে যুক্ত ছিলেন বিকেএসপির অ্যাথলেটিকস কোচ আব্দুল্লাহ হেল কাফি ও বক্সিং কোচ আব্দুল করিমও। যেখানে কাফি সাকিবের ক্রিকেটীয় ফিটনেস নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি, করিম গুরুত্ব দিয়েছেন সাকিবের কৌশল ও দক্ষতা বৃদ্ধির দিকে। সালাহউদ্দিনের মতে, কঠিন ঐ সেশনের সাথেও সাকিব নিজেকে খুব সহজেই মানিয়ে নিতে পেরেছিলেন।
‘ফুটওয়ার্ক, হ্যান্ড-আই কোঅর্ডিনেশন এবং শক্তির ব্যবহার সহ অনেক ক্রিকেটীয় বিষয় জড়িত বক্সিংয়ের সাথে। ব্যাটিং, বোলিং কিংবা ফিল্ডিংয়ে অনেক বক্সিং পজিশনের মিল রয়েছে। চোখের পলকে নিজের কাঙ্ক্ষিত জায়গাটায় পৌঁছে প্রতিপক্ষকে আঘাত করে পরাভূত করার মতো ব্যাপার ক্রিকেটেও জড়িত’, বলেন সালাহউদ্দিন।
‘খুব সম্ভবত প্রথমবারের মতো আমি ওকে এসব বিষয় নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করে যেতে দেখেছি। কষ্ট করেছে, কিন্তু একবারের জন্যেও ও এখানে হাল ছাড়েনি। কঠোর অনুশীলনের মধ্যেও সাকিবকে বিকেএসপিতে কাটানো ঐ সময়টাতে বেশ অনুশীলনের প্রতি বেশ আগ্রহীই মনে হয়েছে। আমার মনে হয় ঐ চাপটুকু নেয়ার জন্য ও নিজেকে শতভাগ প্রস্তুত করেই এসেছিল।’, যোগ করেন তিনি।
বিকেএসপির ঐ সেশনের কথা বলতে গিয়ে সাকিবের শৈশবের এই কোচ জানান, একদিন বিকেলে আমি করিমকে (বক্সিং কোচ) বললাম, ‘ওকে এবার ছেড়ে দাও, একটু বিশ্রাম নিক। কিন্তু সাকিব নিজেই অনুশীলন ছাড়তে রাজি হননি, উল্টো বলেছিলেন সবটুকু কষ্ট হজম করে নিজেকে প্রস্তুত করার জন্যেই আমি এসেছি, অনুশীলন ছাড়বো কেন।’
সাকিবের সেই অনুশীলন প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন আরো জানান, সাকিবের তীব্র আগ্রহই ছিল অনুশীলনে নিজেকে প্রস্তুত করা। কখনো দেখা গেছে সকাল নয়টায় আমাদের নির্ধারিত সিডিউল থাকলেও সাকিব সেই ভোরেই মাঠে উপস্থিত হয়ে একা একাই রানিং করে শুরু করে দিয়েছে, পরে আমরা উপস্থিত হলে আমাদের সাথে অনুশীলন শেষ করেছে।”
শুধু এবারই নয়, এই বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সর্বদাই তার যেকোনো প্রয়োজনে ছুটে আসেন শৈশবের গুরু সালাহউদ্দিনের কাছে, কিংবা কখনো নিজের কাছে ডেকে নেন প্রিয় শিক্ষককে। এই যেমন ২০১৯ বিশ্বকাপের আগেও আইপিএলে সানরাইজার্স হায়দরাবাদে খেলা অবস্থায় সালাহউদ্দিনকে নিয়ে সেখানে ব্যক্তিগত অনুশীলন করেছিলেন সাকিব। তার ফলাফলটাও বিশ্বকাপে মাঠের খেলায় বেশ দারুণভাবেই দিয়েছিলেন সাকিব।
নিষেধাজ্ঞা শেষে সাকিবের এবারের প্রত্যাবর্তন প্রসঙ্গে সালাউদ্দিনের ভাষ্য, ‘আমি মনে করি ও খুব দারুণভাবেই খেলায় ফিরে আসবে, এই দীর্ঘ বিরতিতেও আমি ওর ক্রিকেটীয় দক্ষতা কিংবা মানসিকতায় কোন পরিবর্তন দেখিনি। ক্ষুরধার ক্রিকেটীয় মস্তিষ্কের অধিকারী সাকিবের দীর্ঘদিন না খেলাতেও পারফরম্যান্সে কোন প্রভাব পড়বেনা।’ তবে দীর্ঘদিন মাঠে না খেলাতে হয়তো ফিটনেসে এর কিছুটা প্রভাব পড়তে পারে কিন্তু, সাকিব তা দ্রুতই পুনরুদ্ধার করে নিতে পারবেন বলে বিশ্বাস সালাহউদ্দিনের।
সাকিবের এই অনাকাঙ্ক্ষিত নিষেধাজ্ঞা ভবিষতে তার পারফরমেন্সে কোন প্রভাব ফেলবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে সালাহউদ্দিন বলেন, ‘আমি ওকে ওর ছোটবেলা থেকেই চিনি। ওর সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গাটা হলো একইসাথে ভালো ও মন্দ দুইটা বিষয়কেই সাকিব সুন্দরভাবে মোকাবিলা করে যেতে পারে।’ সালাহউদ্দিনের ভাষ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত এই ঘটনায় দীর্ঘদিন মাঠের বাইরে থাকায় সাকিবের মধ্যে যে ভালো করার ক্ষুধাটা তৈরি হয়েছে তা ভবিষতে সাকিবকে আরো ভালো খেলতে সহায়তা করবে।
জানিয়ে রাখা ভাল,ভারতীয় জুয়াড়ি দীপক আগারওয়ালের কথোপকথন আইসিসির দুর্নীতি বিরোধী ইউনিট- আকসুকে জানাতে ব্যর্থ হওয়ায় সব ধরনের ক্রিকেট থেকে এক বছরের নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছিল সাকিবকে। সাকিবের নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ হয়েছে এই বছরের ২৯ অক্টোবর। বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট দিয়ে ফের ক্রিকেটে ফিরবেন সাকিব।
_______________
মূল লেখা: “Shakib ready to play at any time”, says childhood coach as his ban ends। অনুবাদক: মাসুদ শান