স্মার্টেস্ট ক্রিকেটার এভার

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ঢাকা টেস্টের একদিন আগের কথা।

সংবাদ সম্মেলনে নানারকম প্রশ্ন সামলাচ্ছেন সাকিব। সাধারণত যে মুডি সাকিবকে সংবাদ সম্মেলনে দেখা যায়, সেদিন তাকে সেরকম দেখাচ্ছিল না। একটু ফুরফুরে মেজাজে ছিলেন। সুযোগ বুঝে প্রশ্নটা করে ফেললাম, ‘সাকিব এই টেস্টে কোনো ইনিংসে ৫ উইকেট নিলে তো একটা রেকর্ড হবে। মনে আছে?’

সাকিবের মুখে শিশুসুলভ একটা হাসি খেলে গেলো। তারপর একটু চোখ টিপে বললেন, ‘খুব ভালো করে মনে আছে। দেখা যাক। দুটো ইনিংস আছে তো। কী করা যায়।’

কথায় পরিষ্কার যে, দুই ইনিংসের এক ইনিংসে তিনি পাঁচ উইকেট নেবেনই।

একেবারে বলে কয়ে মাঠে নামলেন। যেকোনো এক ইনিংস নয়, দুই ইনিংসেই পাঁচ উইকেট করে তুলে নিলেন। সাথে সাথে গড়ে ফেললেন সবগুলো টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিপক্ষে কমপক্ষে একবার করে ৫ উইকেট নেওয়ার বিরল রেকর্ড।

এই হচ্ছেন আমাদের সাকিব আল হাসান।

যিনি যেকোনো কিছু বলে কয়ে করে ফেলতে পারেন। আমরা প্রায়শ মজা করে বলি, সাকিব চায় না বলে অনেক কিছু করে না। কিন্তু চাইলে সে আসলেই যেকোনো কিছু করার ক্ষমতা রাখে। এই কথাটা হয়তো রসিকতা। কিন্তু এটাই বলে দেয়, সাকিব আসলে কী!

আসলে তিনি সাধারণ একজন সেরা ক্রিকেটার নন, আসলে তিনি কেবল একজন সেরা বোলার নন, তিনি কেবল একজন সেরা ব্যাটসম্যান নন; তিনি এই সময়ের সবচেয়ে স্মার্ট ক্রিকেটার। স্মার্টেস্ট ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান।

সাকিবের গল্পটা শুরু থেকে শুনলে আপনিও মানতে বাধ্য হবেন যে, এই ছেলেটি জন্ম থেকেই সবচেয়ে স্মার্ট।

প্রথম জীবনে ক্রিকেট খুব একটা খেলতেন না। বাবা ও ফুফাতো ভাইয়ের মতো ফুটবলের প্রতি ছিলো অমোঘ টান। এখনও ফুটবলটা খুব পছন্দ করেন। সেই শৈশবে তাকে ধরে বেঁধে নামানো হয়েছিলো এক প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে। ক্যারিয়ারের প্রথম ডেলিভারিতে উইকেট নিয়েছিলেন; সরাসরি বোল্ড। ওই ম্যাচে ৩টি উইকেট নিয়েছিলেন। তিনটিই ছিলো বোল্ড।

সাকিবের এই স্কিল নিয়ে একবার সাকলায়েন মুশতাকের সাথে কথা বলেছিলাম। সাকলায়েন অল্প কিছুদিন হলেও সাকিবের কোচ ছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলছিলেন, `সাকিব তো এমনিতেই খুব প্রতিভাধর ক্রিকেটার। নিজের স্কিল অনেক ভালো। ব্যাটিং-বোলিংয়ে অনেক ধারাবাহিক। তাই ওকে কোচিং করানোটা খুব আনন্দের একটা ব্যাপার। ওর ক্রিকেট মস্তিষ্ক খুবই ভালো। খেলাটা খুব ভালো বোঝে, ম্যাচের পরিস্থিতি বোঝার ক্ষমতা অসাধারণ। ওর আত্মবিশ্বাস, নিজের যোগ্যতার প্রতি বিশ্বাসটা অসাধারণ। সবচেয়ে বড় কথা, ক্রিকেটের প্রতি ওর প্যাশনটা মারাত্মক। ও দেশের হয়ে ভালো খেলার জন্য যে চেষ্টাটা করে, সেটা আমাকেও খুব অবাক করেছে। আমার দেখা অন্যতম স্মার্ট ক্রিকেটার সাকিব।’

সাকিবের এই স্মার্টনেস নিয়ে আমরা কথা বলেছিলাম বিসিবির মিডিয়া ম্যানেজার এবং অভিজ্ঞ সাংবাদিক রাবিদ ইমামের সাথে। রাবিদ লম্বা সময় ধরে সাকিবের খেলা ও মিডিয়ার সাথে তার সম্পর্ক কাছ থেকে দেখেছেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলছিলেন, ‘আমি বলব যে, ও বাংলাদেশের স্মার্টেস্ট ক্রিকেটার। ও খেলাটা খুব ভালো বোঝে। মানুষ কেউ তো আর সুপারম্যান হয় না। সবারই একটা লিমিটেশন থাকে। সবারই একটা দুর্বলতা থাকে। এই দুর্বলতাগুলো ও লিমিটেশনগুলো এবং নিজেকে জানাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই নিজেকে বোঝার ব্যাপারে আমার মনে হয় যে সমসাময়িক অনেকের চাইতে সাকিব এগিয়ে। খেলোয়াড়দের খারাপ সময় যায়। সাকিবেরও যায়। কিন্তু ওর মতো দ্রুত আর খুব কম ক্রিকেটার আবার নিজেকে ফিরে পায়। অর্থাৎ দুইটা বা তিনটা ইনিংস খারাপ করলে পরের ইনিংসে আপনি জানেন যে ও কিছু একটা করবে। তার কারণটাই হচ্ছে যে সে নিজেকে খুব ভালো বোঝে।’

এই কথাটাই আমরা বলতে চাচ্ছি।

সাকিবের স্মার্টনেসের পরিচয় পাবেন তার সংবাদ সম্মেলনে। এখানে তিনি রীতিমতো একধরনের খেলা করেন। এই খেলায় তাকে অনেক সময় ভুল বোঝা হয়। যেমন একবার দল খুব বাজে করলো, দ্রুত অলআউট হয়ে গেলো। সাকিবকে প্রশ্ন করা হলো, কেন এমন হলো?

সাকিব একটা ডার্ক হিউমার করলেন, ‘সম্ভবত লাঞ্চটা খুব ভালো ছিলো। তাই সবাই দ্রুত ফিরে এসেছে।’

এই হিউমারটা দেশের অধিকাংশ মানুষ নিতে পারেনি। তারা হিউমার ধরতে না পেরে সরাসরি অর্থ ধরে সাকিবকে খুব আক্রমণ করলো। সাকিবও বিভিন্ন সময় সুযোগ পেলেই এসব আক্রমণের জবাব দিয়েছেন আরও সূক্ষ্ম সব কথাবার্তা বলে।

সাকিবের এই মিডিয়ার সাথে খেলাটা অনেককাল ধরে অনুসরণ করেন দ্য ক্রিকেটার পত্রিকার সম্পাদক অ্যান্ড্রু মিলার। তিনি একবার বলেছিলেন, তার দেখা দুনিয়ায় সবচেয়ে ভালো মিডিয়া গেম খেলা ক্রিকেটার হলো সাকিব। তিনি বলছিলেন,‘আমি বলি, সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে খেলোয়াড়দের এই ব্যাপারটা একটা খেলা-মিডিয়া গেম। আমি আমার ক্যারিয়ারে যত খেলোয়াড়ের মুখোমুখি হয়েছি, এই মিডিয়া গেমটা প্রায় সবার চেয়ে সাকিব ভালো সামলাতে পারে। দেখুন শেষ পর্যন্ত ক্রিকেটটা একটা খেলা, জীবন-মরণের কোনো ব্যাপার নয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্রিকেটার এত সিরিয়াস হয়ে পড়ে যে, তাদের আবেগটা চেপে বসে। সাকিবের ক্ষেত্রে তা কখনো হয়েছে বলে দেখিনি।’

সাকিবের মিডিয়া গেম নিয়ে কথা হয়েছিলো প্রথম আলোর ক্রীড়া সম্পাদক উৎপল শুভ্রর সাথেও। তিনিও তার এই খেলাটা বিভিন্ন সময় দারুণ উপভোগ করেছেন। তার কাছে সাকিব হলো কথা বলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে সৎ মানুষ। যে মানুষটি কিছুই লুকাতে চায় না। উৎপল শুভ্র বলেছেন,‘যখন সে অধিনায়ক ছিল, তখন সে প্রেস কনফারেন্স এ প্রতিদিনই এসে কিছু না কিছু বলত যেটা আমরা ঠিক নিতে অভ্যস্ত না। যে জিনিসগুলো আমরা জানি ঠিক, কিন্তু বলা উচিত না। সে যখন এসে বলল, যে আজকে যে টিমটা খেলেছে, ওই টিমটা আমার না বা আমার ফিল্ডিং সাইডটা খুব খারাপ ছিল কারণ, আমাদের সেরা দুটা ফিল্ডার বাইরে বসে আছে। কথাটা সত্যি তুইও জানিস, আমিও জানি। অন্য কেউ হলে হয়তো কূটনৈতিক উত্তর দিতো। সে তা করেনি; সে সৎ থেকেছে। যদি আমি বুঝতাম যে ও নিজের স্বার্থের জন্য এসব করেছে, তাহলে মন্দ বলতাম। বহু সংবাদ সম্মেলনে ওর নিজের পারফরম্যান্স নিয়ে যখন প্রশ্ন করা হয়েছে, ও বলেছে আমি জঘন্য শট খেলেছি; আমার এই শর্ট খেলাটা ঠিক হয়নি। সে নিজের বেলায় একরকম, অন্যদের বেলায় আরেক রকম; তা তো করেনি। ও জানে এটা করলে তার ক্যাপ্টেন্সিও চলে যেতে পারে। তারপরও তো সে আপোষ করেনি।’

এখন কথা হলো, সাকিব কী বোঝেন না যে তার এই সোজাসাপ্টা কথা কিংবা মিডিয়া গেম তাকে একধরনের শত্রুতে পরিণত করে ফেলেছে বা তাকে বিতর্কিত একটা চরিত্রে পরিণত করে ফেলেছে?

সাকিব খুব ভালো বোঝেন এটা। যে কারো চেয়ে ভালো বোঝেন। সাকিব বলেন, তিনি চাইলেই এটা বদলে ফেলতে পারেন। এক একান্ত আলাপে বলেছিলেন, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তিনি সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্রিকেটারে পরিণত হতে পারেন। তিনি জানেন, মানুষ, বিশেষ করে সাংবাদিকরা কী বললে খুশী হবেন। তিনি একটা দিন সবাইকে খুশী করে চললে পরিস্থিতি বদলে যাবে।

কিন্তু সাকিব সেটা করবেন না।

সাকিব আগের মতোই থাকবেন। তিনি মাঠে প্রতিবাদ করবেন, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে প্রয়োজনে দলকে মাঠ থেকে ডেকে পাঠাবেন, সত্যি কথাটা মুখের ওপর বলবেন; তাতে কে কী মনে করলো, তার কিচ্ছু যায় আসে না। সাকিব নিজেকে বদলাবেন না। স্মার্ট লোকেরা নিজে বদলায় না; অন্যকে বদলে দেয়।

এ জন্যই তিনি স্মার্টেস্ট ক্রিকেটার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link