নাজমুল হোসেন শান্ত’র ব্যাটিং ঠিক চোখে প্রশান্তি জোগায় না। কিংবা ধরুন, কোনো ব্যাটারের দারুণ সব স্ট্রোক, শট দেখে যেভাবে আমার তাঁর নামের পাশে বাইশ গজের পাবলো পিকাসো বসিয়ে দিই, তেমনটা শান্তর বেলায় স্রেফ অসম্ভব। শান্ত বাইশ গজে তাঁর ব্যাট দিয়ে কখনো রঙ তুলির আঁচড় দেওয়ার মতো আমাদের কল্পনায় ডুবাতে পারেন না। ঐ ‘চলে’ টাইপ ব্যাটিং করেন। তাই প্রশংসার চেয়ে সমালোচনার তীরেই বিদ্ধ হন তিনি। অনেকটা মিডিওকোর ব্যাটার বলতে যা বুঝায় আর কি।
সেই মিডিওকোর, ক্যারিয়ার নিয়ে স্ট্রাগল করে নিত্যদিন পার করা শান্ত এবারের বিপিএল সেরা হয়েছেন। অর্থাৎ টুর্নামেন্ট সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছেন। ৫১৬ রান করে টুর্নামেন্ট সেরা ব্যাটারও তিনিই নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু কোথায় গিয়ে যেন শান্তকে নিয়ে প্রশংসার চেয়ে সমালোচনার সুর বেশি শোনা যাচ্ছে।
১১৬.৭৮ স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করা ব্যাটার কিভাবে বিপিএল সেরা হয়? এমন স্ট্রাইকরেট দিয়ে বিপিএল, পিএসএল কিংবা আদর্শ টি-টোয়েন্টি ম্যাচে টিকে থাকা যায় নাকি? এমন বহু প্রশ্ন অনলাইন পাড়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেকে তো আবার বিপিএলের সেরা একাদশে শান্তকে ঠাঁই-ই দিচ্ছেন না।
যা হোক, শান্ত যে স্ট্রাইক রেটে ব্যাটিং করেছেন তা একেবারেই টি-টোয়েন্টি অনুপযোগী। এ সরল সত্যটা মেনে নিতে কারো বিন্দুমাত্র আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু কোথায় গিয়ে যেন, এক স্ট্রাইকরেট মানদণ্ডে শান্তর ৫১৬ রানের ব্যাপারটাকে আড়ালে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। তাই আপাতত, আলোচনা, বিশ্লেষণে ডুব দিয়ে ভিন্ন কিছু বেরিয়ে আসে কিনা দেখা যাক।
শান্ত এবারের বিপিএলে ৪ টা অর্ধশতক হাঁকিয়েছেন। সেই ৪ টা ফিফটিতে তাঁর স্ট্রাইকরেট ছিল যথাক্রমে ১৪৬.১৫, ১৩৪.৮৪, ১৩৬.৩৬ এবং ১৪২.২২। অর্থাৎ মানেটা দাঁড়াচ্ছে, ৪ ফিফটির দুটিতে ১৪০+ স্ট্রাইকরেট। বাকি দুটো ফিফটি এসেছে ১৩৪+ ব্যাটিং স্ট্রাইক রেটে।
পুরো বিপিএল যিনি স্ট্রাইকরেটে ১২০ পার করতে পারলেন না তিনি তাঁর সেরা ইনিংস গুলোতে ১৩০ এর বেশি স্ট্রাইকরেটে ব্যাটিং করেছেন। এটা একদিক দিয়ে স্বাভাবিকই। কারণ ইনিংস বড় হলে স্ট্রাইকরেটও সমানুপাতিক হারে বাড়ার সম্ভাবনা বেশি। এর অর্থ হল, শান্তর স্ট্রাইকরেট নিয়ে সমালোচনাটা শুধু তাঁর ছোট ইনিংস খেলার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
এখন আসি তাঁর এবারের বিপিএলে ৪০+ রানের ইনিংস গুলো নিয়ে। সব মিলিয়ে এমন তিনটা ইনিংস খেলেছেন শান্ত। সেই তিনটা ইনিংসে একটু নজর দেওয়া যাক।
প্রথম ম্যাচে ৪১ বলে ৪৩ রানের ইনিংস। স্ট্রাইকরেট মাত্র ১০৪.৮৮। আপাত দৃষ্টিতে দলের জন্য বোঝা হওয়ার মত ইনিংস। কিন্তু সে ম্যাচে শান্তর দল কত রানের লক্ষ্যে খেলেছিল জানেন? মাত্র ৯০ রান। এখন ৯০ রানের লক্ষ্যে শান্ত ঝড়ের মত অশান্ত হয়ে উঠবেন? নিরুত্তাপ ম্যাচে ব্যাটিং নিরুত্তাপ হলে মন্দ কী? যদি দল বড় এক ব্যবধানে ম্যাচ জিততে পারে। এমন পাল্টা প্রশ্ন কিন্তু সমালোচকদের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দেওয়াই যায়।
এরপর নিজের দ্বিতীয় ম্যাচেই শান্ত ১২০ স্ট্রাইক রেটে ৪৮ রানের ইনিংস খেললেন। এই ইনিংস নিয়েও সমালোচনা হতে পারে। মাত্র ১২০ স্ট্রাইকরেট। ব্যাপারটা এমন যে, বাংলাদেশের সবচেয়ে কম স্ট্রাইকরেট নিয়ে খেলা ব্যাটারের স্ট্রাইকরেট ১২০!
পাল্টা যুক্তি খণ্ডন আসতে পারে, বাংলাদেশ কি তবে তিমিরেই রয়ে যাবে? কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে, ৪০ বলে ৪৮ রানের ইনিংসে যদি দলের ক্ষতি না হয় সে ম্যাচে তাহলে তো সমস্যা থাকার কথা নয়। এখন এই ইনিংসটা অন্য কোনো ম্যাচে দাঁড় করে ভাবলেই তো বিপত্তি। সম্ভাবনার বেড়াজালে ‘যদি’ ‘কিন্তু’র চিত্র কল্পনা করে তো লাভ নেই।
আরেকটু খোলাসা করে বলা যেতে পারে, শান্তর ইনিংসে দলের ক্ষতি যদি না হয়, দল যদি জেতে, সেক্ষেত্রে আদৌ কি সমস্যা আছে? হ্যাঁ। তখনই থাকবে, যখন আপনি ঐ ইনিংসটাকে আইপিএলের এক ম্যাচে প্রতিস্থাপন করবেন। ঐ ভাবনায় নিলে, বিচ্ছিরি এক ইনিংসেই শান্তকে আপনি বারবার কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন।
যাহোক, ৪ ফিফটি বাদে শান্ত আরেকটি ৪০ রানের ইনিংস খেলেছিলেন কোয়ালিফায়ার ম্যাচে। রংপুর রাইডার্সের বিপক্ষে ৩০ বলে ৪০ রানের ইনিংস। স্ট্রাইক রেট ১৩৩.৩৩। এ ইনিংস নিয়ে মৃদু সমালোচনা আপনি করতেই পারেন। কিন্তু সে ম্যাচে সিলেটের ব্যাটারদের মধ্যে ঐ ইনিংসটাই সেরা ছিল। ম্যাচ পরিস্থিতি কিংবা দলের জয়ে এ ম্যাচে আপনি শান্তকে প্রশংসার চূড়ায় নাইবা তুললেন, কিন্তু সমালোচনায় ডোবাবেন কি?
বারবার ঘুরে ফিরে ইনিংসের সাথে দলের প্রভাব নিয়ে কেন বলছি? কারণটা অতি সাধারণ। একটু ফ্লাশব্যাকে যাওয়া যাক, ২০১৬ সালের এশিয়া কাপে পাকিস্তানের দেওয়া ৮৪ রানের টার্গেটে ৫১ বলে ৪৯ রানের ইনিংস খেলেছিলেন কোহলি। ম্যাচসেরার পুরস্কার কার হাতে উঠেছিল জানেন? কোহলি।
১০০ স্ট্রাইক রেটেরও কম। এমন ইনিংস টি-টোয়েন্টির মানদণ্ডে বিবেচনা করলে পাত্তাই পাবে না। কিন্তু ঐ ম্যাচ পরিস্থিতিতে কোহলির ইনিংসটা কী দুর্দান্ত ছিল তা ম্যাচের চিত্র ঘেঁটে দেখলেই বোঝা যায়। ফিফটি না পাওয়া ইনিংস, কিন্তু অনেক ক্রিকেট বিশ্লেষকই বিরাটের সেই ইনিংসটাকে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে তাঁর একমাত্র সেঞ্চুরি থেকেও উপরে রাখেন।
শান্ত আর বিরাট, এক নন। শান্তর সামর্থ্যই হয়তো এতটুকু। বিরাট বিধ্বংসী হয়ে উঠতে পারেন যেকোনো সময়। কিন্তু উদাহরণটা আনা হল ম্যাচ ইম্প্যাক্টের ধরন কেমন হতে পারে, তা বুঝানোর জন্য। দিন শেষে, দলের জয় মুখ্য। একজন ব্যাটারের ৬০ বলে ৮০ রানের ইনিংস অনেক সময় জয়ে ভূমিকা রাখতে পারে। আবার অনেক সময় ৬০ বলে ১০০ রানের ইনিংসও দলের পরাজয় এনে দিতে পারে। সব কিছুই ম্যাচ পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। শান্ত’র ১১৬ স্ট্রাইক রেটে সে সফল হয়েছে, দলও সফল হয়েছে। তাই এই চিত্রটায় বিপিএল ও তাঁর দলের সাথে মিলিয়েই আলোচনাটা হওয়া উচিৎ।
শান্তর এই স্ট্রাইক রেটে আইপিএলের কোনো ক্রিকেটার খেলে না কিংবা বিশ্ব ক্রিকেট এভাবে চলে না, শত প্রশ্নের জটে শান্তর এই পারফর্মেন্সকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়। কিন্তু একই কথা পুনরাবৃত্তি করে বলা যায়, সমালোচনাটা তখনই করা শ্রেয়, যখন শান্তর দৃষ্টিকটু, শ্রী হীন ব্যাটিংয়ের সাথে দলের দুরবস্থা একই সাথে দোল খাবে।
এবার আসি, শান্তর বাকি ইনিংস গুলো নিয়ে। এবারের বিপিএলে তিনবার এক অঙ্কের ঘরে আউট হয়েছে। ৯ বলে ৯, ১২ বলে ৬, আর ৫ বলে ৩। বুঝাই যাচ্ছে, ইনিংসের শুরুতেই বোলারের কাছে ধরাশয়ী হয়েছেন। আর এটাও আরেকটা চিত্র একে দেয় যে, কেন তাঁর সামগ্রিক স্ট্রাইক রেট নিচে নেমে গেল।
বাকি রইল ৫ টা ইনিংস। এখানেই চিত্রটা দুর্বল। ৫ ম্যাচের ৪ ইনিংসই ১০০ এর নিচে স্ট্রাইক রেটে শেষ হয়েছে। ব্যাট হাতে শান্তর দুর্দান্ত বিপিএলের উল্টো চিত্র ফুটে ওঠে এখানেই। এই ইনিংসগুলো দলের জন্য বোঝা হওয়ার সম্ভাবনা অনেক খানি। কিন্তু, হয়নি।
আবারো বলছি, শান্তর পাশ থেকে দলটা সরিয়ে নিলে এই বিপিএলের অর্ধেক ইনিংসই বাজে বলেই গণ্য হবে। কিন্তু শান্ত না হয় টিমম্যানই হলেন। ইনডিভিজুয়াল ব্রিলিয়ান্স না হয় দেখা গেলোই না। কিন্তু দলের সফলতাতে ছিলেন। ব্যর্থতার কারণ তো হননি।
শান্তর বিপিএল যাত্রা নিয়ে খেরোখাতা অনেক হল। অনেকেই তাঁকে টুর্নামেন্ট সেরা হিসেবে মেনে নিতেই পারছেন না। সমালোচনার সূত্রপাতও বোধহয় বিপিএল সেরার স্বীকৃতি নিয়ে।
টুর্নামেন্ট সেরার দৌড়ে কারা ছিল, চলুন আগে দেখে নেওয়া যাক। সাকিব, নাসির, তৌহিদ হৃদয়। প্রথমে সাকিবকে টেনে নিয়ে আসা যাক। ৩৭৫ রান, ১০ টা উইকেট। এমন পারফরম্যান্সে বিপিএল সেরার স্বীকৃতি দিয়ে দিলে বিতর্ক হত না বললেই চলে।
কিন্তু একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখ যাবে, এবারের বিপিএলে নিজের সেরা ৮৯ রানের ইনিংস খেলার পরে ৮ ম্যাচ মিলিয়ে ২০ গড়েও রান করতে পারেননি। ৭ ইনিংসের মধ্যে মাত্র দুটি ম্যাচে ৩০+ ইনিংস খেলতে পেরেছেন। একে তো দল চতুর্থ হয়ে বিপিএল শেষ করেছে। তার উপর টুর্নামেন্টের অর্ধেকের পরে আর ব্যাট হাসেনি। আর বল হাতে সাকিব উইকেট প্রাপ্তিতে পুরো বিপিএলে যে অধারাবাহিক ছিলেন সেটা ভেঙ্গে না বললেও হচ্ছে।
একই যুক্তি প্রযোজ্য নাসিরের ক্ষেত্রেও। ব্যাটিংয়ের শুরুর ছন্দ পরে আর দেখা যায়নি। বল হাতে দুর্দান্ত ছিলেন। কিন্তু দিন শেষে দলের তেমন কোনো কাজে আসেনি।
তৌহিদ হৃদয় দারুণ বিপিএল কাটিয়েছেন। স্ট্রাইকরেট, রান, সর্বোচ্চ ফিফটি, সব মিলিয়ে তিনি হতে পারতেন বিপিএল সেরা। কিন্তু তিনি শান্তর কাছে দৌড়ে হেরে গিয়েছে প্লে-অফের ম্যাচ গুলোতে। প্লে-অফে খেলা তিন ম্যাচের দুটোতেই ফিরেছেন শুন্য রানে। অন্য ম্যাচটিতে ২৫ বলে ২৫।
আর এখানে, তোহিদ হৃদয় যতটা পিছিয়েছেন শান্ত ততটাই এগিয়েছেন। ৩ ম্যাচে করেছেন ১৪২ রান। সম্ভবত এখানেই নিজেকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন শান্ত।
হ্যাঁ। টুর্নামেন্ট সেরা নিয়ে বিতর্ক আরো হতে পারে। কিন্তু শান্ত না পেয়ে অন্য কেউ পেলেও সমালোচনার জায়গাটা আসত। পরিসংখ্যান অন্তত সেটাই বলে। হয়তো শান্ত সেরা হওয়া যেভাবে সবাই তেড়েফুঁড়ে নির্বিঘ্নে সমালোচনা করছে, তেমনটা অন্যদের বেলায় হত না। বাংলাদেশ ক্রিকেটে সম্ভবত শান্তর নামের সাথে সমস্যা। শান্তকে হয়তো এখনও অনেকে হজম করতে পারেন না৷ কারণে কিংবা অকারণে। যুক্তিতে কিংবা একপেশে যুক্তিতে।
তবে শান্ত নিজের কাজটা অন্তত করছেন। শত সমালোচনার মাঝেও শান্ত থেকে পারফর্ম করছেন। হ্যাঁ। সেই পারফর্মেন্স নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। কিন্তু এক মানদণ্ডে শান্তকে যেমন ধর্তব্য রাখা যায় না, তেমন আরো অনেক মানদণ্ডে শান্তকে এ বারের বিপিএলে দলের সেরা সম্পদও প্রমাণ করা যায়। শেষ কোন বিপিএলেই বা কোনো দেশি ব্যাটার ৫০০ রান করেছেন। দেশি বাদ দিন, বিপিএল ইতিহাসেই তো কেউ করেননি৷
কিন্তু তারপরও সেটা আড়ালে থেকে যাচ্ছে। স্ট্রাইকরেট নামক এক মানদণ্ডে কিংবা ভিন্ন ম্যাচে পরিস্থিতি এসব ইনিংস দাঁড় করিয়ে একটা বিচিত্র চিত্র দাঁড় করানো হচ্ছে। নামটা ‘শান্ত’ বলেই কিনা! তবে ইতিবাচক দিকও আছে এর মধ্যে। এমন সমালোচনার স্রোতে ডুব দিতে শান্তকে আরো ভাল সাঁতারু হতে হবে। এই ভাবনায় শান্ত অনেক দৃঢ় হতে পারেন। নিজেকে নিয়ে আরো উন্নতির পথে চোখ রাখতে পারেন। এমন কিছু হলে দিনশেষে লাভটা বাংলাদেশেরই। দারুণ কিছু করার পরও নিজের মধ্যে তৃষ্ণা থাকা জরুরি।
শান্ত নিশ্চয়ই তৃপ্ত না। অতৃপ্ত শান্ত না হয় আমাদের তৃপ্ততা জেগানের লক্ষ্যেই খেলে যাক। কে জানে, এই শান্তই হয়তো একদিন উঠে যেতে পারে শিখরে।