ক্রিকেট প্রতিদ্বন্দ্বীতার অনুপম সৌন্দর্যের অপরূপ নিদর্শন ভারত-পাকিস্থান লড়াই। এই দুই দেশের তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বীতা ক্রিকেটকে করে সমৃদ্ধ এবং দর্শকদের মনে জাগিয়েছে রোমাঞ্চের অনুভূতি। ১৯৯৯ সালে সেবার ইডেন গার্ডেনসে মুখোমুখি চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই দল। শচীন টেন্ডুলকার তখন বিশ্ব ক্রিকেটে বড় নাম। রাহুল দ্রাবিড়, টেন্ডুলকার, লক্ষণ, গাঙ্গুলিদের নিয়ে গড়া ভারতীয় ব্যাটিং লাইনআপ তখন রাজত্ব করছে পুরো বিশ্ব। অন্যদিকে, ওয়াকার ইউনূসকে হারিয়ে পাকিস্থানের বোলিং আক্রমণ হয়ে গিয়েছে কিছুটা দুর্বল। কিন্তু পুরানের প্রস্থানেই আগমন ঘটে নতুনের।
দলের অপেক্ষাকৃত তরুণ এই পেসার বেশ জোরে বল করেন। কিন্তু গতির দিকে মনোযোগ দিতে গিয়ে প্রায়ই হারিয়ে ফেলেন লেংথ। কিন্তু সেবার ড্রেসিংরুমে ঘোষণা দিলেন শচীন আমার। সিনিয়ররা কিছুটা বিরক্ত তাঁর দাম্ভিকতায়। ম্যাচের আগে বেশ একটা ঠোকাঠুকিও হয়ে গেল শচীনের সাথে।
তাঁকে চেনে কিনা জবাবে শচীন ‘না’ বললে তাঁর সটান জবাব খুব দ্রুতই চিনে যাবে। সত্যিই শচীনকে তাকে আর কখনো ভোলেননি সেই ম্যাচের পর থেকে, প্রথম বলেই যে তার মিডল স্ট্যাম্প উড়িয়ে দিয়েছিলেন সেই বোলার। পুরো মাঠ নিশ্চুপ, শোনা যাচ্ছিল শুধুমাত্র বোলারের উল্লাসের আওয়াজ। এক বল আগে একইভাবে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল রাহুল দ্রাবিড়ের স্ট্যাম্পও।
তরুণ সেই বোলারটি ছিলেন শোয়েব আখতার, দ্য রাওয়ালপিন্ডি এক্সপ্রেস।
১৯৭৫ সালে পাঞ্জাবের রাওয়ালপিন্ডি নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন শোয়েব। তার পরিবার ছিল অত্যন্ত গরীব, মাত্র একটি ঘরে গাদাগাদি করে থাকতেন তারা সবাই। ক্রিকেটে আগ্রহ থাকলেও ব্যাট কিংবা বল কিনে দেবার সামর্থ্য ছিল না শোয়েবের বাবার। এজন্য শোয়েব প্রায়ই পাহাড়ে গিয়ে পাথর ছুঁড়ে মারতেন। পৃথিবীর উপর তার সমস্ত রাগ, অভিমান, আক্ষেপ সব যেন প্রকাশ করতেন পাথরের উপর।
এভাবে জোরে পাথর ছুঁড়তে ছুঁড়তেই শোয়েব আয়ত্ত করেন জোরে বু করার এক বিস্ময়কর ক্ষমতা। ক্রিকেটার হবার নেশায় একসময় মাত্র ২৫ রুপি সম্বল করে রাওয়ালপিন্ডি থেকে লাহোরে আসেন। লাহোরে বোলিং ট্রায়ালে নজরে পড়ে যান জহির আব্বাসের। ব্যস এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
বিশ্ব ক্রিকেটে অসাধারণ সব পেসার উপহার দেবার যেন ব্রত করেছিল পাকিস্থান। শোয়েব যে সময়ে খেলা শুরু করেন সে সময়টা পাকিস্থানের পেস বোলিংয়ের স্বর্ণযুগ। ফজল মাহমুদ, সরফরাজ নওয়াজ, ইমরান খানদের পথ ধরে পাকিস্থানে তখন চলছে টু ডব্লিউ রাজত্ব। আকিব জাভেদের মতো পেসার বসে থাকেন মাঠের বাইরে।
সবচেয়ে গতিশীল বোলার হিসেবে আছেন মোহাম্মদ জাহিদ, অভিষেকেই যিনি নিয়েছিলেন ১১ উইকেট। আতাউর রহমান কিংবা শহীদ নাজিররাও খুব বেশি দূরে নন জাতীয় দল থেকে। একারণেই ক্যারিয়ারের তৃতীয় টেস্টেই পাঁচ উইকেট পেলেও দলে জায়গা নিশ্চিত ছিল না। ভালো করছিলেন কিন্তু নিজেকে দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে জানান দিতে পারেননি।
সুযোগটা এসে যায় এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ম্যাচে। ভারতের বিপক্ষে আট উইকেট নিয়ে দলকে একাই জেতান শোয়েব। এরপর শ্রীলংকার বিপক্ষে ত্রিদেশীয় সিরিজে নিলেন পাঁচ ম্যাচে নয় উইকেট, ইকোনমি মাত্র ৩.৪৭। কেবল উইকেট সংখ্যায় নয় শোয়েব পুরো বিশ্বকে হতবাক করেছেন তার গতি দিয়ে।
১৯৯৯ বিশ্বকাপে শোয়েব ছিলেন চূড়ান্ত ফর্মে। তার গতির সাথে বাউন্সার, ইয়র্কার, রিভার্স সুইংয়ের জবাব ছিল না ব্যাটসম্যানদের কাছে। সব ব্যাটসম্যানই অসহায় আত্নসমর্পণ করে গেছেন তার সামনে। ১০ ম্যাচ খেলে টুর্নামেন্ট সর্বোচ্চ ১৬ উইকেট নেন শোয়েব। কিন্তু ফাইনালে ব্যাটিং ব্যার্থতায় হেরে যায় পাকিস্থান। কিন্তু সে বছরেরই শেষভাগে অস্ট্রেলিয়া সফরে আম্পায়ার পিটার উইলি এবং ড্যারিল হেয়ার অবৈধ বোলিং অ্যাকশনের অভিযোগে নো বল ডাকেন। যদিও ফিরে আসতে খুব বেশিদিন সময় নেননি শোয়েব। তিনি ফিরে এসেছিলেন, নিজের আপন মহিমায়, গতি আরো বাড়িয়ে।
২০০১ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পাঁচ উইকেট নেন শোয়েব যার চারটিই ছিল বোল্ড। ১৪২ রানে পাঁচ উইকেট থেকে কিউইদের অলআউট করেন ১৪৯ রানে। এরপর আম্পায়ার স্টিভ ডান আবারো চাকিংয়ের অভিযোগ আনেন শোয়েবের বিপক্ষে। যদিও অস্ট্রেলিয়ায় আইসিসির ল্যাবে পরীক্ষায় তার অ্যাকশন ক্রুটি-মুক্ত ধরা পড়ে।
ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই ব্রেট লি’র সাথে গতির একটা ঠাণ্ডা লড়াই চলছিল শোয়েবের। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই শোয়েব ইনজুরিতে পড়লেও কখনো গতির সাথে আপোষ করেননি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথমবারের মতো ১০০ মাইলের বেশি গতিতে বল করেন শোয়েব। যদিও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে করা তার এই বলটিকে স্বীকৃতি দেয়নি আইসিসি কারণ সে ম্যাচের বল পরিমাপক যন্ত্রটি মানসম্মত ছিল না।
তবে সবকিছু পেছনে ফেলে ২০০৩ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৬১ কি.মি./ঘন্টার ডেলিভারিটি তাকে এনে দেয় অমরত্ব। ক্রিকেটে ইতিহাসের ১০০ মাইল/ঘন্টায় বল করা প্রথম স্বীকৃত বোলার তিনিই। পরে ব্রেট লি এবং শন টেইট ১০০ মাইলের বেশি গতিতে বল করলেও ছাড়াতে পারেননি শোয়েবকে।
কেবল বল হাতে নয় ব্যাটটাও মোটামুটি ভালোই চালাতে পারতেন শোয়েব। দলের বিপদের সময় বেশ কয়েকবারই তার ঝড়ো ইনিংস বাঁচিয়েছে পাকিস্থানকে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে একবার ১৬ বলে করেন ৪৩ রান। পাকিস্থান ম্যাচটা হারলেও দর্শকরা আনন্দিত হয়েছিলেন শোয়েবের পাঁচ, চার আর তিন ছক্কার বিধ্বংসী ব্যাটিং দেখে। এছাড়াও ভারতের বিপক্ষে ইরফান পাঠানের হ্যাটট্রিকের সেই ম্যাচে ৪৫ রান করে দলকে সম্মানজনক স্কোর এনে দেন শোয়েব।
তবে শোয়েবের সবচেয়ে স্মরণীয় পারফরমেন্স রিকি পন্টিংয়ের সর্বজয়ী অস্ট্রেলিয়া দলের বিপক্ষে। এক শোয়েবের কাঁধে ভর অজি মুলূকেই তাদের হারিয়ে ওয়ানডে সিরিজ জিতেছিল পাকিস্থান। সিরিজের প্রথম ম্যাচটি খেলতে পারেননি। ১৭৭ রানের পুঁজি নিয়ে পাকিস্তান সেই ম্যাচে হারে। দ্বিতীয় ম্যাচে শোয়েব মোটামুটি বোলিং করেন, উইকেট পান দুটি।
ম্যাচটিও জেতে পাকিস্তান। শোয়েব মূল খেলাটা দেখান সিরিজ নির্ধারণী তৃতীয় ম্যাচে। অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বসেরা ব্যাটিং লাইনআপকে গুঁড়িয়ে দেন একাই। মার্টিন লেহম্যান, রিকি পন্টিং, ড্যামিয়েন মার্টিন, মাইকেল বেভান কেউই প্রতিরোধ গড়তে পারেননি শোয়েবের গতির সামনে। আট ওভার বল করেন শিকার করেন পাঁচ উইকেট। ম্যান সেরার পাশাপাশি সিরিজ সেরা পুরস্কারও পান শোয়েব।
কেবল গতি নয় বল করার সময় মাথা খাটিয়ে উইকেট তুলতেন তিনি। একবার ম্যাথু হেইডেনকে টানা কয়েকটি শর্ট বল করে অপ্রস্তুত করেন। এরপর যখন হেইডেন শর্ট বল খেলার জন্য প্রস্তুত হন তখন দারুণ এক ইয়র্কারে স্ট্যাম্প উড়িয়ে দেন শোয়েব। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন তিনি সব সময় দুজন ফিল্ডার ব্যাটসম্যানদের কাছে রাখতেন যাদের কাজ ছিল ব্যাটসম্যানের ফুটওয়ার্ক মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করা এবং তার কাছে রিপোর্ট করা।
গতির সাথে আপোষ না করার শোয়েবের ক্যারিয়ার বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে ইনজুরিতে। হাঁটুর ব্যথাটা ভুগিয়েছে পুরো ক্যারিয়ারজুড়ে। ১৮ বছর বয়সের পর থেকে এমন কোনো দিন যায়নি যেদিন শোয়েব হাঁটুর ব্যথায় কষ্ট পাননি। মাঝেমাঝে তো মাঠের বাইরে হামাগুঁড়ি দিয়ে হাঁটতেন। কিন্তু কখনোই গতি কমানোর কথা চিন্তাও করেননি শোয়েব। মাঠ এবং মাঠের বাইরে বর্ণিল এক চরিত্র ছিলেন তিনি।
ঠোঁট কাটা স্বভাবের শোয়েব বারবার আলোচনায় এসেছেন পিসিবির সাথে বচসায় জড়িয়ে। একবার বোর্ডের বিপক্ষে নেতিবাচক মন্তব্য করে নিষিদ্ধ হয়েছিলেন পাঁচ বছরের জন্য। যদিও পরে সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। তবে সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছিলেন ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মাঝপথে। তাকে নিয়ে কৌতুক করার সতীর্থ মোহাম্মদ আসিফকে ব্যাট দিয়ে আঘাত করেন শোয়েব। ফলশ্রুতিতে টুর্নামেন্টের মাঝপথেই দেশে ফিরে আসতে হয় তাকে।
২০১১ বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটাই হয়ে আছে শোয়েবের ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ। সে ম্যাচে ৯ ওভারে ৭০ রান দেওয়ায় আর কখনো দলে সুযোগ পাননি তিনি। আগেই অবসর নিয়েছিলেন টেস্ট এবং টি-টোয়েন্টি থেকে। ৪৬ টেস্ট খেলে মাত্র ২৫.৬৯ গড়ে ১৭৮ উইকেট শিকার করেন তিনি। কমপক্ষে ১৫০ উইকেট নিয়েছেন এমন বোলারদের মধ্যে তার বোলিং গড় পঞ্চম সেরা।
এছাড়া ১৬৩ একদিনের ম্যাচে তার সংগ্রহ ২৪৭ উইকেট। মূলত ইনজুরির কারণে এক যুগের বেশি সময়ের ক্যারিয়ার হলেও খুব বেশি ম্যাচ খেলতে পারেননি তিনি। তার উইকেট সংখ্যা কিংবা মাঠের বাইরের ঘটনা কিছুই মনে রাখেনি ইতিহাস। ক্রিকেট ইতিহাসের পাতায় শোয়েব অমর হয়ে আছেন সর্বকালের অন্যতম সেরা গতিদানব হিসেবে।