চুইংগাম চিবোতে চিবোতে দৃপ্ত ভঙ্গিতে বোলারদের সংহার করা? নাহ, ওসবে তিনি নেই। নিজেকে ‘ইউনিভার্স বস’ বলা? নাহ, এটার বান্দা ও তিনি নন। দীর্ঘকালের সতীর্থ ব্রায়ান চার্লস লারার মতো বাইশ গজে শৌর্য ও দ্যুতি ছড়ানো? নাহ, সেটাও ঠিক তাঁর জন্য নয়।
তিনি শিবনারায়ণ চন্দরপল, তাহলে তিনি ঠিক কী? চন্দরপল মানে ওয়েস্ট ইন্ডিজের তৃতীয় উইকেটের পতন ঘটলে শান্ত ভাবে ক্রিজে পৌঁছানোর পরে উইকেটের বেলটা ক্রিজে ব্যাট দিয়ে ঠুকে ঠুকে স্টান্স নেওয়ার পরে ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে স্টান্স নিয়ে দাঁড়ানো, আর তারপর? সংগ্রাম সংগ্রাম আর সংগ্রাম। রিচি রিচার্ডসন, জিমি অ্যাড্যামস, ব্রায়ান লারা, কার্ল হুপার পেরিয়ে মারলন স্যামুয়েলস অনেক সতীর্থ এসেছেন ও চলে গিয়েছেন কিন্তু চন্দরপলের সংগ্রাম চলতেই থেকেছে।
ক্রিস গেইলের মতো ধ্বংসলীলায় তিনি মাতেন না বা ব্রায়ান লারার ফ্ল্যামবয়েন্স তাঁর নেই, কিন্তু তিনি যে মধ্যবিত্তের ফিক্সড ডিপোজিট, ওসব বিলাসিতা তো তাঁকে মানায় না। লারা, রিচার্ডসদের ব্যাটিং দেখার জন্য লোকে যেভাবে মাঠ ভরাবে তাঁর জন্য কোনোদিন তা হয়নি, তাঁর কভার ড্রাইভ দেখে কেউ কোনোদিন বলে ওঠেনি এই কবিতা লেখা ড্রাইভ দেখার জন্য হাজার মাইল হাঁটা যায়, কিন্তু সংগ্রামী সব ইনিংস শেষে ক্যারিবিয়ানরা ম্যাচ জেতার পরে লোকে উল্লাসে মেতেছে, চন্দরপলকে নিয়ে মাতেনি কেউ।
ম্যাচের সেরার পুরস্কার নিয়ে গিয়েছেন লারা, গেইল, হুপার, ওয়ালশ, আম্ব্রোসরা কিন্তু চন্দ্রপলের দামি সব ইনিংস গুলো চাপা পড়ে গেছে যেন কালের নিয়মে। নাহ এ নিয়ে কোনো অভিযোগ তিনি করেননি, যেমন শচীন টেন্ডুলকরের বিদায়ী টেস্টের হইচইতে চাপা পড়ে যায় তাঁরও দেড়শোতম টেস্ট ম্যাচ। সেখানেও তাঁর গলায় নেই অভিযোগ, উল্টে ছোট্ট মন্তব্য যে তিনি ‘ভাগ্যবান’।
টেস্ট ক্রিকেটে শুরুর প্রথম সাত বছর তাঁর প্রতি অভিযোগ ছিল ভালো শুরু করেও শতরান বা বড় ইনিংসে পরিণত করতে পারেননা, কিন্তু সেই তিনিই ক্যারিয়ার শেষে ৩০টা টেস্ট সেঞ্চুরির মালিক, লারার অবসরের পরে ক্ষয়িষ্ণু ব্যাটিং লাইনআপের প্রধান ভরসা হয়ে থেকে গিয়েছেন বছরের পর বছর।
নেতৃত্বের ভার পেলেও ভালো ফল না পাওয়ায় সেনাপতির গুরু দায়িত্ব ত্যাগের পরেও দলের ব্যাটিং লাইন আপকে নীরবে নেতৃত্ব দিয়ে গিয়েছেন। একদিনের ক্রিকেটেও ওপেনিং থেকে ৭ নম্বর পর্যন্ত সমস্ত পজিশনে ব্যাট করে গিয়েছেন দলের স্বার্থে এবং চল্লিশের ওপর গড় রেখে শেষ করেছেন একদিনের ক্রিকেটটাও।
আর টেস্ট ক্রিকেটে এগারো হাজার রানের এভারেস্টেও উঠেছেন চন্দ্রপল তাঁর ২১ বছরের টেস্ট ক্যারিয়ারে বিখ্যাত হয়ে থাকা ওই ‘কাঁকড়া রুপী’ ব্যাটিং স্টান্স দিয়ে। বোর্ডের সাথে টাকা পয়সা নিয়ে গণ্ডগোলে সেরা ক্রিকেটাররা দলে নেই, আন্দোলন করছেন, কিন্তু চন্দরপল অনুপস্থিত সেই আন্দোলনের দলে, তিনি? যথারীতি টেস্টের দলে। আসলে আন্দোলন – টান্দোলন, সেটাও ঠিক তাঁর জন্য নয়।
আসলে চন্দরপল হলেন এমন এক বিরল সভ্যতার মূর্ত প্রতীক যিনি শুধু দলের জন্য নিজের কাজটা করে চলেন নীরব সৈনিকের মতো, যেখানে পায়ে অসহ্য যন্ত্রনা নিয়ে সেঞ্চুরি করে দলকে জেতান অস্ট্রেলিয়ার গণগনে বোলিং লাইন আপের বিরুদ্ধে ৪১৮ রান তাড়া করে আবার কখনো ‘বড়ে মিয়া’ খ্যাত জাভেদ মিয়াঁদাদের ঢঙে শেষ বলে ছক্কা মেরে জেতান ওয়ান ডে ম্যাচে।
শিবনারায়ণ চন্দরপল হলেন ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের ধূসর হতে থাকা সেই মেরুণ খাতাটার শেষ উপন্যাসটা। জীবনের জলছবি হয়ে থেকে যাওয়া এক একটা ইনিংসের মতো চন্দরপলরা তাই বোধহয় সংগ্রামী হয়েই থেকে যান আর ফ্ল্যামবয়েন্স গুলো তোলা থাকে সব ব্রায়ান লারাদের জন্যই।