ঝাঁজহীন লঙ্কা ক্রিকেট

সেসব একটা দিন ছিলো বটে। কলম্বোর প্রেমদাসা স্টেডিয়ামে শ্রীলঙ্কার সাথে কারোর একটা দিন রাতের ওয়ান ডে ম্যাচ। বিপক্ষ যদি পরে ব্যাট করে আর শ্রীলঙ্কার হাতে যদি ২৩০ এর বেশি রান থাকে তো কথাই নেই। ভাস, মালিঙ্গারা বিপক্ষের মুড়ো টা ভাঙা শুরু করবেন আর বাকি পেট থেকে ল্যাজা অবধি মুরালি, জয়াসুরিয়া, চন্দনারা চিবিয়ে খাবেন।

আবার বিপক্ষ প্রথমে ব্যাট করে ২৫০’র বেশি রান করলো, তখন আবার জয়সুরিয়া বা জয়সুরিয়ার অবসর নেওয়ার পর দিলশান শুরুতে টর্নেডো ওড়াবেন, আর মাঝের সময়টা টাটকা বাতাস এনে কখনো ডি সিলভা, রানাতুঙ্গারা আবার পরের দিকে কুমার সাঙ্গাকারা বা মাহেলা জয়াবর্ধনারা শেষ করবেন। সেই সব দিন স্মৃতিতে চলে এলে দু:খ পাওয়াটাই বোধহয় এখন দস্তুর, কারণ – ‘সে রাম ও নেই আর সে অযোধ্যা ও নেই’, বা বলা হয়তো একটু ভুলই হলো, বলা যেতে পারে ‘সে লঙ্কাও নেই, আর তার ঝাঁজও আর নেই’। সাঙ্গাকারা, জয়বর্ধনে, দিলশান, মুরা, ভাস, জয়সুরিয়াদের যুগ শেষ হওয়ার সাথে সাথে যেন ‘জয়ের সূর্য ‘ ও শ্রীলঙ্কাকে ছেড়ে বিদায় নিয়েছে।

লঙ্কা ক্রিকেটের পতনের সূত্রপাত ধীরে ধীরে শুরু হয় ২০১৫ থেকে, সে বারে বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে জঘন্য খেলে বিদায় নেওয়ার পর থেকে আর কোনো আইসিসি টুর্নামেন্টে এমনকি এশিয়া কাপেও প্রথম রাউন্ডের গন্ডি টপকাতে পারেনি তারা। অথচ এর বছর খানেক আগেও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন দলের নাম ছিল – শ্রীলঙ্কা, এমনকি বড় টুর্নামেন্টের সেমি ফাইনাল বা ফাইনাল খেলাকে ‘জলভাতে’ পরিণত করে ফেলেছিলো লঙ্কানরা, আজ তাঁদের এমন অবস্থা দেখলে করুণাই জাগে সবচেয়ে বেশি।

এশিয়া কাপেও বরাবরই দুর্দান্ত পারফরমেন্স করে আসা শ্রীলঙ্কা শেষ দুটো এশিয়া কাপে বাংলাদেশ বা আফগানিস্তানের কাছেও নাকানি চোবানি খেয়ে হেরে বিদায় নেয়। যা এশিয়ার মধ্যেও শ্রীলঙ্কার অবস্থাকে আরো পরিষ্কার করে দেয় ইদানিং কালের ক্রিকেটে। মূলত: প্রথমে জয়াবর্ধনে, তারপর সাঙ্গাকারা ২০১৫তে আর তারপরে দিলশান ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে ‘আলবিদা’ বলার পর থেকেই এই অবক্ষয়ের দিন ক্রমশ: ঘনিয়ে আসা শুরু লঙ্কা ক্রিকেটে।

জয়সুরিয়া, মুরালি, ভাসদের বিদায়ের পরেও সাঙ্গা – মাহেলা – মালিঙ্গাদের যুগেও দিব্যি রমরমিয়ে চলছিল লঙ্কারাজ, কিন্তু ভবিষ্যতের দিশারী হিসাবে যাদের ভাবা হয়েছিল সেই চান্দিমাল, থিরিমান্নে, কুশল পেরেরা, কুশল মেন্ডিস, লাকমলরা সময়ে সময়ে ঝলক দেখালেও এতটাই অধারাবাহিক যে তাঁদের ওপর ভরসা রাখাটাই দুরুহ ব্যাপার। আবার এইসব ক্রিকেটার দের পাশাপাশি অন্য নবাগতদের ভরসা রাখার ক্ষেত্রেও শ্রীলঙ্কার নির্বাচকরা কোনো সময়ই বিচক্ষনতার পরিচয় দেননি।

বছর কয়েক ধরেই খেয়াল করলে দেখা যাবে প্রত্যেকটা সিরিজ শুরুর আগে যখন দল ঘোষণা হয়, তিন ফরম্যাটের দলেই দেখা যায় অন্তত ৩-৪ জন নতুন মুখ, আবার কালের নিয়মে কয়েকটি ম্যাচের পরেই তাঁরা ফিরে যান ঘরোয়া ক্রিকেটে। একটা পরিসংখ্যান দেখলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে – ২০১৫ থেকে ২০২১ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার হয়ে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছে ২৮ জনের, একদিনের ক্রিকেটে ৩৯ জনের ও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ৩৪ জনের!

যে হিসেব টেস্ট খেলিয়ে সমস্ত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। অর্থাৎ এর থেকে একটা জিনিসই বোঝা যায় নির্বাচকরা খেলোয়াড়দের ওপর মোটেই আস্থা রাখতে পারেন না লম্বা সময়ের জন্য, আবার ক্রিকেটাররাও স্বল্প সুযোগে তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো পারফরমেন্স করে দেখাতে পারেননা।

শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটে অধিনায়কত্বের মিউজিক্যাল চেয়ার নিয়েও আরেকটা পরিসংখ্যান দেখা যাক, এই ২০১৫ থেকে ধরলে এখনও পর্যন্ত আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে শ্রীলঙ্কার অধিনায়কত্ব করেছেন ৭ জন! একদিনের ক্রিকেটে অধিনায়কত্ব করেছেন এই সময়ে ৯ জন! চোখ কপালে তোলার মতোই। টেস্ট ক্রিকেটে সংখ্যাটা দাঁড়াচ্ছে যদিও ‘মাত্র’ ৫ জন, কারণ হিসেবে বলা যায় – সাদা বলের তুলনায় লাল বলের ক্রিকেটে এই ৬ বছরে সাফল্যের হার তুলনায় বেশি, দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে প্রথম এশিয়ান দেশ হিসেবে টেস্ট সিরিজ জয়ের কৃতিত্ব বা ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়াকে হোয়াইটওয়াশ করার কৃতিত্বও রয়েছে।

কিন্তু যে সাদা বলের ক্রিকেটে গোটা নয়ের দশকের থেকে ২০১৪ পর্যন্ত আধিপত্য বজায় রেখে গেছে দেশটা, সেখানে ক্রিকেটের ছোট দুই ফরম্যাটে শ্রীলঙ্কার অবস্থা সঙিন বললেও কম বলা হয়। ঘরের মাঠে জিম্বাবোয়ের কাছে সিরিজ হার এই ছয় বছরে সঙ্গী হয়েছে, বেসরকারি একদিনের ম্যাচে হারতে হয়েছে স্কটল্যান্ডের কাছেও। বড় দলগুলোর বিরুদ্ধে লঙ্কানদের একদিনের ক্রিকেটে শেষ কয়েকবছরের পারফরমেন্স তো কহতব্য নয়, এতই হতশ্রী।

শেষ ৬ বছরে শ্রীলঙ্কার একদিনের সিরিজ জেতার সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াচ্ছে মাত্র সাতটিতে, তার সব গুলোই বাংলাদেশ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আয়ারল্যান্ড বা জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে। একদিনের ক্রিকেটে ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কার নির্বাচকরা যে একটা নির্দিষ্ট সেট আপ তৈরি করতে পারলেন না ২০১৫ থেকে গত ২০১৯ বিশ্বকাপ অবধি, সেটা একটা ব্যাপার দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে, যখন টেস্টে মোটামুটি ভালো সাফল্য দেওয়া অধিনায়ক দিমুথ করুনারত্নে হঠাৎ করেই কোথা থেকে উদয় হন একেবারে বিশ্বকাপেই অধিনায়ক হয়ে, যিনি কিনা তার আগে চার বছর কোনো একদিনের ম্যাচই খেলেননি, আর সেই বিশ্বকাপের আগে খেলেছিলেন সাকুল্যে ১৭টি ম্যাচ, একজন ওপেনার হিসেবে ১৫ গড় নিয়ে, ভাবা যায়!

আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতেও লঙ্কানদের শেষ কয়েক বছরের অবস্থা তথৈবচ, ২০১৪র টি২০ বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়নদের ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মূলপর্বে খেলতে হবে প্রিলিমিনারি রাউন্ডে নামিবিয়া, নেদারল্যান্ডসদের বাঁধা সামলে। এর থেকে খারাপ আর কঠিন সময় একটা বিশ্বকাপজয়ী এবং নিয়মিত এতো মহাতারকার জন্ম দেওয়া দেশের জন্য যে আসতে পারে এটা একপ্রকার অভাবনীয়। ‘শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট একটা ট্রানসিশন পিরিয়ডের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে’ – এ নিয়ে একসময় অনেক কথা হয়েছে, কিন্তু একটা বিশ্বকাপজয়ী দলের ট্রানসিশন পিরিয়ড যদি ৬ বছরের ওপর ধরে চলে তাহলে ‘গোড়ায় গন্ডগোল’ এর কথাই সবার আগে মাথায় আসে।

হ্যাঁ, আসলে এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের গণ্ডগোলটা ঐ শিকড়েই ঢুকে আছে। শ্রীলঙ্কার ঘরোয়া ক্রিকেটে ২৪টা দল খেলে, আন্তর্জাতিক নাম করা ক্রিকেটাররা অনেক সময়ই গরহাজির থাকেন বা থাকলেও যে ধরণের উইকেটে বছরের পর বছর ধরে সেই ঘরোয়া টুর্নামেন্ট গুলো হয়ে চলে এবং যে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে খেলেন, তারপর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসে সবার পক্ষে মানিয়ে নেওয়া বেশ কঠিন ব্যাপার হয়ে যায়। এখন প্রশ্ন হলো তাহলে এই দেশ থেকেই সাঙ্গা, মাহেলা, মুরালি, ভাস, মালিঙ্গা, ডি সিলভা, রানাতুঙ্গারা বেরোলেন কি করে?

তাঁদের অবশ্যই স্রষ্টা প্রদত্ত প্রতিভা ছিলো, এর সাথে সেই প্রতিভাকে মাজা ঘষা করে, নিজেদের প্রতিনিয়ত কঠিন প্র্যাক্টিস ও ফিটনেস ট্রেনিং করে এমন এক জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন সেখান থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের কঠিনতম রগড়ানি পেয়ে আরো পোক্ত হয়ে উঠেছিলেন যত দিন গেছে। তার সাথে নিজেদের পারফরমেন্স দিয়ে দেশকে একটা দারুন জায়গায় নিয়ে যাওয়ার তাড়না তাঁদের কিংবদন্তীতে পরিণত করেছিল।

এ প্রসঙ্গে আজকের শ্রীলঙ্কা দলের দিকে একটু তাকানো যাক, টেস্ট ক্রিকেটে বিদেশের মাটিতে ২০ উইকেট নেওয়ার মতো বোলার? নাহ, লাকমল বা দুশমন্থ চামিরা চলনসই, কিন্তু অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডে সিরিজ জিতিয়ে আনার ক্ষমতা তাঁদের নেই। ঘরের মাঠে খেলা হলে হেরাথ এর মতো বটবৃক্ষ অবসর নেওয়ার শূন্যতা ঢাকতে বল হাতে এম্বুলদেনিয়া এখন সবচেয়ে বড় ভরসা, কিন্তু দেশ বিদেশে ব্যাটিং এ ভরসা দেবেন কে?

দ্বিমুথ করুনারত্নে আর ম্যাথিউস ছাড়া বাকিদের ওপর চোখ বন্ধ করে ভরসা করা অসম্ভব। এর মধ্যে অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউস বহু সময়ই চোটের কবলে দলের বাইরে থাকেন। একদিনের ক্রিকেটে ইনিংস গড়ে তোলা বা স্লগ ওভারে ঝড় তোলার লোক? সেখানেও লঙ্কা ক্রিকেট এখন হতদরিদ্র, থিসারা পেরেরা অবসর নেওয়ায় ঝড় তোলার বদলে ডেথ ওভারে এখন শ্রীলঙ্কা ব্যাটিংয়ের ডেথ সার্টিফিকেট লেখা হয়ে যায়।

বিদেশের মাটিতে তো দূরের কথা, দেশের মাঠেও একটা সিরিজ এখন শ্রীলঙ্কা জিতবেই এটা গ্যারান্টি দিয়ে বলবেন, এরকম অতি বড় লঙ্কান সমর্থক ও এখন নেই। হয়তো সত্যি বলতে এখনকার লঙ্কান ক্রিকেটারদের প্রতিভা নিয়ে কারোর কোনো প্রশ্ন থাকার কথা নয়, কিন্তু তফাৎ টা হয়ে যায় ঐ কঠিন পরিশ্রম, ফিটনেস ঠিক রাখার মন্ত্রে পিছিয়ে পড়া এবং ঘরোয়া ক্রিকেটের বেহাল দশায়।

না হলে আজকের নব্য বাঁ-হাতি স্পিনার লাসিথ এম্বুলদেনিয়া বা অলরাউন্ডার দাসুন শানাকা বা ওয়ানিন্দু হাসারঙ্গা কিংবা ব্যাটিংয়ে ওশাদা ফার্নান্দো, ধনঞ্জয় ডি সিলভা, কুশল মেন্ডিসরা প্রতিভার বিচারে কম জাননা মোটেই, কিন্তু সেই হাড়ভাঙা পরিশ্রম ও তার সাথে ফিটনেস, ফিল্ডিং এর উন্নতি না করলে অদূর ভবিষ্যতেও লঙ্কান ক্রিকেটের আরো তলানিতে চলে যাওয়াটা রোখা সম্ভব নয়, তা সে যতই প্রতিভা থাকুক। তখন ঐ ‘প্রতিভার অপচয়’ কথাটাও বহু ব্যবহারে ক্লিশে হয়ে যাবে, যেতে বাধ্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link