অস্ট্রেলিয়ার সাবেক গতিদানব জেফ থমসনকে মনে করা হয় ক্রিকেট ইতিহাসের সবচাইতে ভীতিকর ও বিধ্বংসী ফাস্ট বোলারদের একজন। অনেকের চোখে তিনি ছিলেন ক্রিকেট ইতিহাসেরই দ্রুততম বোলার। তাঁর এক্সট্রা লিফট নেয়া ক্ষিপ্র গতিসম্পন্ন একেকটা বাউন্সার ছিল যাকে বলে ‘ব্যাটসম্যান কিলার’! যেগুলো সরাসরি গিয়ে আঘাত হানত ব্যাটসম্যানের পাঁজরে, গলায়, মুখে কিংবা মাথায়। আর ছিল বিষাক্ত ‘টো ক্রাশিং’ ইয়র্কার! দুর্বোধ্য অ্যাকশন, গতির তীব্রতার সাথে ঘটনার আকস্মিকতা ও ‘ফিয়ার ফ্যাক্টর’ মিলিয়ে ব্যাটসম্যানের জন্য সেগুলো হয়ে উঠত লিটারেলি আনপ্লেয়েবল!
আর সে আমলে তো এখনকার মতো ব্যাটসম্যানদের এত সুরক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। হেলমেট, আর্মপ্যাড, চেস্টগার্ড ছাড়া লিলি-থমসনদের মত বিধ্বংসী বোলারদের ‘গোলাবর্ষণের’ মুখোমুখি হওয়াটা যেকোন ব্যাটসম্যানের জন্যই ছিল এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা।
এ ধরনেরই একটা ঘটনা ঘটেছিল ইতিহাসের প্রথম বিশ্বকাপ আসরের গ্রুপ পর্বে অস্ট্রেলিয়া ও শ্রীলঙ্কার মধ্যকার ম্যাচে। সময়কাল ১১ জুন, ১৯৭৫। স্থান দ্য ওভাল, লন্ডন। থমসনের গোলার আঘাতে আহত হয়ে রীতিমতো হাসপাতালে ছুটতে হয়েছিল শ্রীলঙ্কার দুই ব্যাটসম্যান সুনীল ওয়েট্টিমুনি ও দিলীপ মেন্ডিসকে।
টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর বাইরে কেবল শ্রীলঙ্কা আর পূর্ব আফ্রিকাই অংশ নিয়েছিল ১৯৭৫ সালের প্রুডেনশিয়াল বিশ্বকাপে। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে আগে কখনো খেলার অভিজ্ঞতা না থাকায় ডেনিস লিলি-জেফ থমসনদের মারাত্মক গতি কিংবা বিধ্বংসী বোলিং সম্পর্কে তেমন কোন ধারণাই ছিল না লঙ্কানদের।
তার আগে একটু বলে নেয়া ভাল, বিশ্বকাপে লঙ্কানরা গ্রুপ পর্বে নিজেদের প্রথম ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের কাছে হারে ৯ উইকেটে। দ্বিতীয় ম্যাচে দুর্ধর্ষ ক্যারিবিয়ান পেস ব্যাটারির সামনে গুটিয়ে যায় মাত্র ৮৬ রানে। সে ম্যাচেও হারের ব্যবধান ছিল ৯ উইকেট!
অপ্রীতিকর পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকেই কিনা, লন্ডনের ওভালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে নিজেদের তৃতীয় ম্যাচে কিছুতেই আগে ব্যাট করার ‘ঝুঁকি’টা নেয় নি শ্রীলঙ্কা। টসে জিতে প্রথমে ফিল্ডিং নেয়াটাকেই যুক্তিযুক্ত মনে করেছিলেন লঙ্কান অধিনায়ক আনুরা টেনিকুন।
ইএসপিএন ক্রিকইনফোর ম্যাচ রিপোর্ট অনুযায়ী, ‘লঙ্কান অধিনায়ক ম্যাচের শুরুতেই লিলি আর থমসনের সামনে ব্যাটসম্যানদের আসতে দিতে চাননি।’
টেনিকুনের সিদ্ধান্ত কতখানি কাজে এসেছিল সেটা জানতে হলে অপেক্ষা করতে হবে এই লেখার একদম শেষ পর্যন্ত। প্রথম ব্যাট করতে নেমে রিক ম্যাককস্কার ও অ্যালান টার্নারের উদ্বোধনী জুটিতেই আসে ১৮২ রান। শেষ পর্যন্ত টার্নারের অনবদ্য সেঞ্চুরির (১০১) সুবাদে ৬০ ওভারে ৩২৮ রানের বিশাল সংগ্রহ দাঁড় করেছিল অস্ট্রেলিয়া।
৩২৯ রানের বিশাল টার্গেটের জবাবটা বেশ শক্ত হাতেই দিচ্ছিল লঙ্কানরা। প্রথম দুই ম্যাচের মতো এবার আর হুড়মুড়িয়ে ভেঙ্গে পড়ে নি তাদের ভঙ্গুর ব্যাটিং লাইনআপ। দলীয় ৩০ রানের মাথায় প্রথম উইকেট হারায় শ্রীলঙ্কা। থমসনের বলে বোল্ড হবার আগে ৪ বাউন্ডারিতে ১৮ বলে ২২ রান তুলে দলকে উড়ন্ত সুচনা এনে দিয়েছিলেন ডানহাতি ওপেনার রণজিৎ ফার্নান্ডো। ওভালের ব্যাটিং সহায়ক ফ্ল্যাট উইকেটে অজি ফাস্ট বোলাররাও সেদিন তেমন একটা সুবিধা করতে পারছিলেন না।
লিলি-থমসন-ম্যালেটদের গতির সামনে সেদিন বুক চিতিয়ে লড়েছিলেন ওয়েট্টিমুনি-ওয়ার্নাপুরা-মেন্ডিসরা। তবে আলাদা করে বলতেই হয় ওপেনার সুনীল ওয়েট্টিমুনির কথা। বান্দুলা ওয়ার্নাপুরাকে নিয়ে দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে তিনি যোগ করেন ৫৪ রান। অ্যাশলি ম্যালেটের শিকার হয়ে ওয়ার্নাপুরা (৩১) ফিরে গেলেও একপ্রান্ত আগলে ছিলেন ওয়েট্টিমুনি। তাঁকে সঙ্গ দিতে ক্রিজে এলেন দিলীপ মেন্ডিস। দু’জনেই সেদিন চমৎকার খেলছিলেন। তাঁদের অবিচ্ছিন্ন তৃতীয় উইকেট জুটির দৃঢ়তায় একসময় শ্রীলঙ্কার সংগ্রহ দাঁড়ায় ৩২ ওভারে ১৫০/২! অবিশ্বাস্য এক জয়ের স্বপ্নও ধীরে ধীরে উঁকি দিতে লাগছিল।
ক্রিকইনফোর ম্যাচ রিপোর্ট অনুযায়ী, ‘মেন্ডিস ও ওয়েট্টিমুনি দু’জনই সাহস আর আত্মবিশ্বাসের সাথে যুদ্ধটা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তাতে ইয়ান চ্যাপেলের মাথাব্যাথা বাড়ছিল।’
কিন্তু, তারপর হঠাৎ এক দমকা ঝড়ো হাওয়া এসে বদলে দিল ম্যাচের দৃশ্যপট। দ্বিতীয় স্পেলে ফিরে এসে বল হাতে ভয়ঙ্কর অগ্নিমুর্তি ধারণ করলেন জেফ থমসন! ফ্ল্যাট উইকেটে তুললেন গতির তুমুল ঝড়! একের পর এক শরীর তাক করা ‘মিসাইলরূপী’ বাউন্সারে নাকাল করে ছাড়লেন ব্যাটসম্যানদের!
অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক ইয়ান চ্যাপেল সেই ঘটনার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘দুই লঙ্কান পিচ্চি (দিলীপ মেন্ডিস ও সুনীল ওয়েট্টিমুনি) বুম বুম বুম চালাচ্ছিলেন, আমি থম্মোকে বললাম, দেখো ওরা ফ্রন্ট ফুটে দারুণ খেলতে পারে, বোঝাই যাচ্ছে। দেখো এবার ওরা ব্যাক ফুটে কতটা ভাল।’
ব্যক্তিগত ৩২ রানের মাথায় থমসনের এক ‘প্রাণসংহারী’ বাউন্সারের আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন দিলীপ মেন্ডিস। গুড লেন্থে পড়ে আচমকা লাফিয়ে ওঠা একটা ডেলিভারি সোজা গিয়ে লেগেছিল মেন্ডিসের মাথায়। ব্যস, মাথা ফেটে তৎক্ষণাৎ রক্ত ঝরতে আরম্ভ করে দেয়। রক্তপাত যেন কিছুতেই থামছিল না। শেষ পর্যন্ত উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে নিতে হয়েছিল হাসপাতালে।
চোখের সামনে এমন দৃশ্য দেখার পর অন্যপ্রান্তে থাকা ওপেনার সুনীল ওয়েট্টিমুনির মানসিক অবস্থাটা একবার অনুমান করুন তো!
থম্মোর ‘লাইটনিং পেস’ ও ‘ফিউরিয়াস বাউন্সের’ সামনে তখনও পর্যন্ত বেশ ভালোই লড়ে যাচ্ছিলেন ওয়েট্টিমুনি। বেশ কয়েকবার থম্মোর ‘গোলা’ তাঁর শরীরে আঘাত হানলেও দমে যান নি তিনি; সকল ব্যথা সহ্য করেছেন মুখ বুঁজে। হঠাৎ থমসনের একটা বুলেটগতির ‘টো ক্রাশিং’ ইয়র্কার সোজা গিয়ে আঘাত হানে ওয়েট্টিমুনির বুটে। দুঃসহ যন্ত্রণা ও তীব্র ব্যথায় কুঁকড়ে ওঠেন তিনি। থমসনের অবশ্য বিন্দুমাত্র সমবেদনা ছিল না ব্যাটসম্যানের প্রতি। তিনি উল্টো আরও ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন স্লেজিং নিয়ে।
ওয়েট্টিমুনিকে উদ্দেশ্য করে বলছিলেন, ‘দেখো, ওটা ওটা এখনো ভাঙেনি। তবে, আগামী ওভারেও থাকলে ভেঙে যাবে।’
ওয়েট্টিমুনিও এত সহজে হাল ছেড়ে দেয়ার পাত্র নন। কিছুক্ষণ সেবা শুশ্রুষার পর আবারও উঠে দাঁড়ালেন ব্যাট হাতে। এটা দেখেই কিনা বলের গতি আর তীব্রতা আরো বাড়িয়ে দিলেন থমসন! ফলে এবারে আর শেষরক্ষা করতে পারলেন না তিনি! ঠিক এর পরের ওভারেই প্রায় একই ধরনের আরও একটি ‘টো ক্রাশারের’ আঘাতে তাঁর পায়ের হাড় ফ্র্যাকচারড হয়েছিল মারাত্মকভাবে।
হত মেন্ডিসের পিছু পিছু এই লঙ্কান ওপেনারটিকেও তাই শেষমেশ ছুটতে হয়েছিল হাসপাতালে! অবশ্য এর আগেই তিনি পূর্ণ করে ফেলেন তাঁর ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম হাফ সেঞ্চুরি। ওয়েট্টিমুনির আঘাতটা এতই গুরুতর ছিল যে বেশ কিছুদিন তাঁকে ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটতে হয়েছিল। আর মেন্ডিসকে সইতে হয়েছিল তীব্র মাথার যন্ত্রণা।
শারীরিক আঘাতজনিত কারণে দুই ‘সেট’ ব্যাটসম্যানকে হারালেও ম্যাচের একদম শেষপর্যন্ত ফাইটব্যাক চালিয়ে গিয়েছিল শ্রীলঙ্কা। অধিনায়ক টেনিকুন (৪৮) ও মাইকেল টিসেরার (৫২) চতুর্থ উইকেট জুটিতে এসেছিল ৮২ রান। পুরো ৬০ ওভার ব্যাট করে মাত্র ৪ উইকেট হারিয়ে লংকানরা তুলেছিল ২৭৬ রান; হেরেছিল ৫২ রানে। অস্ট্রেলিয়ার মত শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যা মোটেই চাট্টিখানি ব্যাপার ছিল না।
সেই ম্যাচে ১২ ওভার বল করে ৫ মেডেনসহ মাত্র ২২ রান দিয়ে ১ উইকেট নিয়েছিলেন থমসন। তাঁর উইকেট কলামে মাত্র ‘১’ লেখা থাকলেও কার্যত তিনি আরো দুজন ব্যাটসম্যানকে ফেরত পাঠিয়েছিলেন সাজঘরে (পড়ুন হাসপাতালে)।
পরবর্তীতে এক সাক্ষাৎকারে থমসনের সেই আগুনঝরা স্পেলটার কথা স্মরণ করতে গিয়ে দিলীপ মেন্ডিস বলেছিলেন, ‘এত আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে ঝড়ো ফাস্ট বোলিং ছিল। এটা খুবই ফাস্ট ছিল, আর ওই সময় আমাদের তেমন প্রোটেকশনই ছিল না। বলটা আমরা ঠিক মত বুঝতেও পারছিলাম না তার অ্যাকশ থেকে, ১০০ মাইলের গতিতে ডেলিভারিগুলো আসছিল আগুনের গোলা হয়ে।’
আর সুনীল ওয়েট্টিমুনির বক্তব্যটা ছিল এরকম, ‘এটা ছিল আলোর ঝলকের মত, আমি বলটাই দেখতে পাচ্ছিলাম না।’
জেফ থমসন অবশ্য তাঁর ‘বাউন্সার’গুলোকে ‘সত্যিকারের বাউন্সার’ বলতে নারাজ। তাঁর মতে তিনি কিছুটা ‘ব্যাক অব আ লেন্থ’ থেকে স্বাভাবিক নিয়মেই বল ওঠাচ্ছিলেন! শ্রীলঙ্কান ব্যাটসম্যানদের গড় উচ্চতা অনেক কম বলেই নাকি এক্সট্রা লিফট নেওয়া ডেলিভারিগুলোকে দৃশ্যত ‘বাউন্সার’ বলে মনে হয়েছিল! থমসনের ভাষায়, ‘ওরা (শ্রীলঙ্কানরা) তো ক্ষুদে মানব, তাই ওগুলোকে ঠিক বাউন্সার বলা যায় না!’
হ্যাঁ, হতে পারে লঙ্কানরা শারীরিক গঠনে দুর্বল, আকৃতিতে খর্বকায়; কিন্তু তাই বলে তাদের মনের জোর ও সাহসিকতায় একবিন্দুও খামতি ছিল না সেদিন।