Social Media

Light
Dark

স্টিভেন জেরার্ড, নট ফর সেল!

পেশাদার ফুটবল এখন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এখানে নিখাঁদ ফুটবলের চেয়ে লাভ-ক্ষতির হিসেবটা বেশিই হয়। আর তাই কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থের অর্থের বিনিময়ে ফুটবলারের গায়ের জার্সি বদলে যায়, রাতারাতি পাল্টে যায় ড্রেসিং রুম। তারপরও কিছু ফুটবলার আছেন যারা একই ক্লাবে ২০-৩০ বছর কাটিয়েছেন।

ক্লাবের প্রতি ভালোবাসা, আত্মার টান বিক্রি হয়নি ইউরোর কাছে। এমন খেলোয়াড়দের মাঝে যেমন আছেন এএস রোমার ফ্রাঞ্চেস্কো টট্টি কিংবা এসি মিলানের পাওলো মালদিনি, তেমনি আছেন এক লিভারপুল কিংবদন্তি – তিনি স্টিভেন জর্জ জেরার্ড।

ইংল্যান্ডের মার্সিসাইডের হুইস্টন শহরে ১৯৮০ সালের ৩০মে জন্ম নেন স্টিভেন জেরার্ড। ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি ভালবাসা তৈরি হয় তার। আর ফুটবলের শুরু হুইস্টন জুনিয়র ক্লাবের হয়ে। সেখানেই লিভারপুলের ফুটবল স্কাউটদের নজরে পড়ে জেরার্ডের অনন্য ফুটবলীয় প্রতিভা। ৯ বছর বয়সেই জেরার্ডকে তখন লিভারপুলের যুব একাডেমিতে ভর্তি করানো হয়।

পরবর্তীতে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড সহ আরও কিছু ক্লাবে ট্রায়াল দিয়েছিলেন স্টিভেন জেরার্ড। কিন্তু সুযোগ হয়নি। আর সেটিই আশীর্বাদ হয়ে এসেছে তার জীবনে। ১৯৯৭ সালের ৫ নভেম্বর লিভারপুলের সাথে তার প্রথম পেশাদার চুক্তি সম্পন্ন হয়।

এক বছর পর ২৯ নভেম্বর ১৯৯৮ সালে ব্লাকবার্ন রোভার্সের বিপক্ষে বদলি খেলোয়াড় হিসেবে প্রথমবারের মত মাঠে নামার সুযোগ পান জেরার্ড। অভিষেক মৌসুমে ক্যাপ্টেন হ্যারি রেডন্যাপ এর জায়গায়, সেন্টার মিডফিল্ডার হিসেবে মোট ১৩ টি ম্যাচে মাঠে নামার সুযোগ পান তিনি।

সুযোগ পেয়ে সেটি কাজে লাগানোতে ভুল করেননি ইংলিশ ম্যান। আর তাই পরের মৌসুমে ক্যাপ্টেন হ্যারি রেডন্যাপের পার্টনার হিসেবে সেন্টার মিডফিল্ডে তাকে প্রায়ই সুযোগ দেয়া হতে থাকে । এই মৌসুমেই তিনি প্রথম গোল করতে সক্ষম হন! তবে স্টিভেন জেরার্ড প্রথমবার লাইমলাইটে আসেন ২০০০/০১ মৌসুমে।

এই সময় লিভারপুলের প্রায় সব ম্যাচের শুরুর একাদশে সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। মধ্যমাঠ সামলানো ছাড়াও ১০টি গোল করেছিলেন। সেবার লিভারপুল এফ এ কাপ, লিগ কাপ ও উয়েফা কাপ জেতে যার অনেকটা কৃতিত্ব জেরার্ডের প্রাপ্য। স্বীকৃতি স্বরূপ বর্ষসেরা উদীয়মান খেলোয়াড় হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি।

মাঠে শুধু পারফরম্যান্স দিয়েই নয়, নিজের নেতৃত্বগুণ দিয়েও নজর কাড়েন স্টিভেন জেরার্ড। ২০০৩ সালের অক্টোবরে প্রথমবারের মত লিভারপুলের অধিনায়কত্ব তুলে দেয়া হয় তার হাতে! কিন্তু ২০০৩/০৪ মৌসুমে লিভারপুল কোন ট্রফি জিততে না পারায়, ম্যানেজারের পদত্যাগসহ ক্লাবে বেশ টালমাটাল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। সেবার প্রথম ও শেষবারের মত লিভারপুল ছেড়ে চেলসিতে যেতে চেয়েছিলেন জেরার্ড।

কিন্তু নতুন কোচ রাফায়েল বেনিতেজের অনুরোধে অলরেড শিবিরেই থেকে যান তিন । নতুন কোচের অধীনে শুরুতেই ইনজুরিতে পড়েন জেরার্ড। লম্বা বিরতি শেষে নভেম্বরের চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপ ম্যাচে অলিম্পিয়াকোস-এর বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে আবার মাঠে ফেরেন অলরেড অধিনায়ক। সেদিন ৫ মিনিটের জন্য নেমেই উইনিং গোল করেন। আর এই গোলটিকেই তিনি তার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা গোল মনে করে।

চ্যাম্পিয়নস লিগের সেই আসরের ফাইনালে এসি মিলানের বিপক্ষে অধিনায়ক জেরার্ডের শেষ মুহূর্তের গোলে অবিশ্বাস্য এক কামব্যাকের আখ্যান সৃষ্টি করে ইংলিশ জায়ান্টরা। সেকেন্ড হাফে তার অসাধারণ পারফরমেন্সের কারণে ৩-০ তে পিছিয়ে থাকার পরও দল ৩-৩ এ ম্যাচ ড্র করে লিভারপুল।

আর শেষপর্যন্ত পেনাল্টি শুটআউটে জিতে ২০ বছর পর লিভারপুল চ্যাম্পিয়নস লিগ নিজেদের করে নেয়। স্টিভেন জেরার্ড হয়েছিলেন ম্যান অফ দ্যা ফাইনাল, আর একই বছর ‘উয়েফা ক্লাব ফুটবলার অফ দ্য ইয়ার’ ট্রফিও নিজের করে নেন তিনি।

এরপর একে একে কেটে গিয়েছে আরো এক যুগ। লিভারপুলের লাল জার্সি গায়ে জড়িয়ে ফুটবল মাঠে লড়াইটা করে গিয়েছেন এই মিডফিল্ডার। সেই ১৯৮৯ সালে যে লিভারপুলের একাডেমিতে ভর্তি হয়েছিলেন, ২০১৫ সাল পর্যন্ত সেই দলের হয়েই খেলেছেন জেরার্ড। এর মধ্যে ক্লাবটির মূল দলেই খেলেছেন সতেরো বছর।

এই লাল জার্সিতেই হয়েছেন বিশ্বসেরাদের একজন। চ্যাম্পিয়ন্স লিগসহ জিতেছেন দশটি শিরোপা। ইউরোপের এমন কোনো বড় ক্লাব নেই, যারা এই মিডফিল্ডারকে দলে ভেড়াতে চায়নি। কিন্তু জেরার্ড ছিলেন শুধুই লিভারপুলের। এই সময়টাতে কত কিছু বদলে গেছে, শুধু বদলায়নি জেরার্ডের অলরেডদের প্রতি ভালবাসা, এই নি:স্বার্থ ভালবাসার কোন ব্যাখ্যা নেই।

সতের বছর অ্যানফিল্ডে কাটানোর পর, সেই মাঠ থেকেই ২০১৫ সালে বিদায় নেন অলরেড কিংবদন্তি। তৎকালীন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কিংবা চেলসি থেকে অনেকটাই পিছিয়ে ছিল লিভারপুল তবু দলটির জন্য যেভাবে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন জেরার্ড তাতে তার কাছে আজীবনই ঋণী থাকবে লিভারপুল ম্যানেজম্যান্ট। জেরার্ডকে যোগ্য সম্মান দিতে কার্পণ্য করেনি ক্লাব কর্তৃপক্ষ। কান্না লুকাতে চেয়েও পারেননি জেরার্ড নিজেও।

সে-বছরই লস অ্যাঞ্জেলস ক্লাবে যোগ দেন তিনি। সেখানে দুই বছর খেলার পর ২০১৭ সালে অবসরের ঘোষণা দেন এই মিডফিল্ডার। বর্তমানে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দল অ্যাস্টন ভিলার কোচের ভূমিকায় আছেন জেরার্ড।

চাঁদেরও কলঙ্ক আছে, কলঙ্ক আছে স্টিভেন জেরার্ডেরও। নিজের প্রজন্মের সেরা ইংলিশ খেলোয়াড় হওয়া সত্ত্বেও কখনো লিগ শিরোপা ছুঁয়ে দেখতে পারেননি তিনি। বিশেষ করে চেলসি’র বিপক্ষে মাঠে পিছলে পড়েছিলেন জেরার্ড আর সেখান থেকেই ২০১৩/১৪ মৌসুমের লিগ শিরোপাও পিছলে যায় অলরেডদের হাত থেকে। কাকে দোষ দিবেন তিনি? নিজের ভাগ্যকে নাকি অ্যানফিল্ডের ঘাসকে?

এছাড়া সদ্য সমাপ্ত মৌসুমেও আরেকবার সুযোগ পেয়েছিলেন সাবেক ক্লাবকে উদযাপনের উপলক্ষ এনে দিতে। বর্তমান ক্লাব অ্যাস্টন ভিলা, যদি ম্যানচেস্টার সিটিকে আটকাতে পারতো তাহলেই শিরোপা জিততো লিভারপুল। কিন্তু ২-০ গোলে এগিয়ে থাকা ম্যাচেও শেষদিকের ঝড়ে ৩-২ গোলে হেরে যেতে হয় জেরার্ড শিষ্যদের। খেলোয়াড়ী জীবনের মত কোচিং ক্যারিয়ারেও অলরেডদের শিরোপা জেতাতে গিয়ে হোঁচট খেতে হয়েছে জেরার্ডকে। বড্ড দুর্ভাগা কিংবদন্তি বটে।

সব হিসেব শেষে, স্টিভেন জেরার্ড অলরেড ভক্তদের কাছে নায়ক। কিন্তু লিগ জিততে না পারা, নিজের বিদায় ম্যাচে ক্রিস্টাল প্যালেসের বিপক্ষে পরাজয় আর কোচিং ক্যারিয়ারে লিভারপুলকে শিরোপা জেতানোর সুযোগ কাজে লাগাতে গিয়েও ব্যর্থ হওয়া – সবমিলিয়ে জেরার্ড হয়তো ট্র্যাজিক হিরো। তবে ট্র্যাজিক হিরো’রা স্মৃতিতে উজ্জ্বল থাকেন বেশিই, আর তাই স্টিভেন জর্জ জেরার্ডও হয়তো ফুটবল ইতিহাসে অমর হয়েই থাকবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link