শিক্ষক নেহরা, শিক্ষার্থী ভারতবর্ষ

জীবন হোক কিংবা খেলার মাঠ; একবার হারানো জিনিস ফিরে পাওয়ার চেয়ে কঠিন আর কিছুই নেই। কিন্তু ক্রিকেট বিশ্বে এমনও কিছু খেলোয়াড় আছে যারা কিনা হারিয়ে গিয়েও আবারো কষ্ট আর পরিশ্রম দিয়ে ফিরে এসেছেন।

জীবনে ধাক্কা খেয়ে হারিয়ে গিয়েছিলেন ঠিকই, তবে ধৈর্য্য আর নিজের আত্মবিশ্বাস উপর দেখিয়ে ঠিকই ফিরে এসেছেন কয়েকজন। এদের মধ্যে একজন হলেন সাবেক ভারতীয় পেসার আশিষ নেহরা। হ্যাঁ, সেই আশিষ নেহরা যাকে ‘কামব্যাক কিং’ হিসেবে ডাকতেই পছন্দ করেন লোকেরা।

২৯ এপ্রিল ১৯৭৯; দিল্লীর এক পরিবারে জন্ম হয় আশিষ নেহরার। দিভান সিং নেহরা ও সুমেত্র নেহরার দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে হলেন আশিষ। সালমান পাবলিক স্কুলে পড়ার সময় থেকেই ক্রিকেট খেলতেন আশিষ। স্কুল শিক্ষা শেষে রাজধানী কলেজ থেকে আশিষ গ্র‍্যাজুয়েশন শেষ করেন। এর মধ্যেই আশিষ নেহরা কোচ তারক সিনহার আন্ডারে সনেট ক্রিকেট ক্লাবে অনুশীলন করা শুরু করেন।

ক্লাব ক্রিকেটে খেলার মাধ্যমে নেহরা প্রায়ই তার কোচকে স্টেশনে ট্রেনে উঠিয়ে দিতে যেতেন। সেখানে থাকা রেল লাইনের উপর থেকে পাথর উঠিয়েই বল করা শুরু করতেন তিনি। সে সময়ে বীরেন্দ্র সেওয়াগ আশিষকে স্কুটারে করে বসিয়ে ফিরোজ শাহ কোটলা স্টেডিয়ামে যেতেন অনুশীলনের জন্য।

ধীরে ধীরে নেহরার পরিশ্রম ফলাফলে রূপ নেয়! মাত্র ১৮ বছর বয়সেই নেহরার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হয়। ৬ ফুট লম্বা আশিষ নেহরা উইকেটের দুই পাশেই সহজেই বল স্যুইং করাতে পারতেন। নেহরার কাছে ব্যাটসম্যানের হেলমেটের মারার মতো বাউন্সার আর দূর্দান্ত ইয়োর্কার অস্ত্র ছিলো!

২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯; আশিষ নেহরা শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে কলম্বোতে টেস্ট যাত্রা শুরু করেন। অভিষেক টেস্টে ২৮ ওভার বল করে মাত্র এক উইকেট শিকার করেন তিনি। প্রথম টেস্টেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের চাপটা বেশ ভালোভাবেই পড়ে নেহরার উপর। সেই টেস্টের পরই দল থেকে বাদ পড়েন তিনি। কিন্তু তিনি হার মানেননি! তখন বর্তমান জনপ্রিয় কমেন্টেটর আকাশ চোপড়া বলেন, ‘আশিষ বাদ পড়ার পর এক ঘায়েল সিংহ হয়ে গিয়েছিল।’

সাল ২০০১ – ভারতীয় ক্রিকেটে ফিক্সিং অভিশাপে সবকিছুই প্রায় উলটা পালটা! দলের দায়িত্ব নিয়ে তখন দল গোছাতে শুরু করেছেন অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি। সেবার জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্ট খেলতে জিম্বাবুয়ে সফরে যায় ভারত৷ প্রায় আড়াই বছর পর আবারো জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্টে সুযোগ পান আশিষ! ২ ম্যাচে ১১ উইকেট নিয়ে সেবার নিজেকে প্রমাণ করেন তিনি।

২৪ জুন ২০০১ – হারাতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেক হয় আশিষের! অভিষেকে ১০ ওভারে ৩৫ রানে দুই উইকেট নেন তিনি। জিম্বাবুয়েতে তার দূর্দান্ত পারফরম্যান্স তাকে ওয়ানডে ও টেস্ট দলে নিয়মিত খেলার সুযোগ করে দেয়। পরের দুই বছর তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বেশ চমক দেখান।

এরপর ২০০৩ বিশ্বকাপ – যেই বিশ্বকাপ আশিষ নেহরাকে বড় স্টার হিসেবে বিশ্ব দরবারে পরিচিতি দেয়। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ম্যাচে ১৪৯.৭ গতিতে তিনি বল করেন; যা সবচেয়ে দ্রুততম তম ভারতীয় বোলার হিসেবে রেকর্ড করেন। এরপর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই স্মৃতিময় ম্যাচ!

১০ ওভারে মাত্র ২৩ রানে ৬ উইকেট শিকার করেন আশিষ! এর মাত্র তিন দিন আগেই নামিবিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে চোট পান তিনি, যার দরুণ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ খেলাও অনিশ্চিত ছিলো তার। কিন্তু নিজেকে প্রস্তুত করে খানিকটা ইনজুরি নিয়েই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলতে নামেন তিনি৷ ইনজুরি নিয়ে খেলতে নেমে সেদিন ভারতীয় সহ ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে জায়গা করে নেন নেহরা! সেই বিশ্বকাপে ৯ ম্যাচে ৪.১৭ গড়ে ১৫ উইকেট শিকার করেন নেহরা!

সাল ২০০৫ – ১৭ ওয়ানডে ম্যাচে ২৯ উইকেট শিকার করেন তিনি। এর মধ্যে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৫৯ রানের বিনিময়ে ৬ উইকেট শিকার করেন! ভারতের হয়ে ওয়ানডেতে দুইবার ৬ উইকেট শিকার করা একমাত্র বোলার হলেন আশিষ নেহরা। কিন্তু একই বছর এক ইনজুরি কাল হয়ে দাঁড়ায় তার ক্যারিয়ারে। পায়ের চোট থেকে সেরে উঠে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরতে আরো চার বছর লাগে তার!

চোট কাটিয়ে ফিরে নেহরা ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) ও ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলা চালু রাখেন। যেখানে ৩৬ বছর বয়সে এসে অনেকেই ক্রিকেট ছেড়ে বল, ব্যাট, প্যাড উঠিয়ে রাখেন সেখানে নেহরা লড়াই করে চলেছিলেন আবারো জাতীয় দলে ফিরতে।

কথায় বলে, পরিশ্রম আর ধৈর্য্যর ফল মিঠা হয়! সবকিছু পাশ কাটিয়ে ২০১৬ এশিয়া কাপ আর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আবারো সুযোগ পান আশিষ নেহরা। যেই বিরাট কোহলিকে ছোট বেলায় নিজ হাতে পুরষ্কার তুলে দিয়েছিলেন, সেই বিরাটের অধিনায়কত্বেই আবার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরেন নেহরা।

২০১৬ ও ১৭ দুই বছর লিড বোলার হিসেবে টি-টোয়েন্টিতে ভারতের হয়ে খেলেন আশিষ নেহরা। নতুনদের সুযোগ করে দিতে ১ নভেম্বর ২০১৭ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে ক্রিকেটকে বিদায় জানান নেহরা। সেই ফিরোজ শাহ কোটলাতেই তিনি ক্রিকেটকে বিদায় জানান যেখান থেকে তিনি ক্রিকেটের শুরু করেছিলেন।

আশিষ নেহরা ১৬৪ আন্তর্জাতিক ওয়ানডেতে ২৩৫ উইকেট শিকার করেন তিনি। এর মধ্যে টেস্টে ৪২, ওয়ানডেতে ১৫৭ ও টি-টোয়েন্টিতে শিকার করেন ৩৪ উইকেট। ২০০৮ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত আশিষ নেহরা আইপিএলে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স, দিল্লি ক্যাপিটালস, পুনে ওয়ারিয়র্স, চেন্নাই সুপার কিংস ও সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদের হয়ে খেলেছেন৷ নেহরা ৮৮ আইপিএল ম্যাচে ১০৬ উইকেট শিকার করেন।

আশিষ নেহরা প্রসঙ্গে যুবরাজ সিং বলেন, ‘নেহরা শুয়ে থাকলেও ইনজুরিতে পড়তে পারে!’

চোট প্রসঙ্গে নেহরা বলেন, ক্রিকেট ক্যারিয়ারে তিনি চোটের মুখে মোট ১২ টি সার্জারি করান। কিন্তু দেশের হয়ে খেলার জন্য তিনি কখনোই এসবে দমে যাননি। তার দুঃসময়ে তার পাশে সবসময়ই ছিলেন তার স্ত্রী রুস্মা নেহরাই দিয়েছিলেন। ক্রিকেট ছাড়ার পর আশিষ বেশিরভাগ সময়ই তার ছেলে ও মেয়ের সাথেই কাটাতে পছন্দ করেন। ২০১৮-১৯ সালে বোলিং কোচ হিসেবে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরুর সাথে কাজ করেন নেহরা।

১২টি অস্ত্রোপচারের পরেও ক্রিকেট চালিয়ে গিয়েছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটের এই গতির যোদ্ধা। ৩৬ বছর বয়সেও বয়স আর শরীরে বুড়ো হারকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে পরিশ্রম দিয়ে নিজের জায়গা করে নিয়েছিলেন জাতীয় দলে। বার বার ইনজুরি থেকে ফিরে এসে পারফরম্যান্স দিয়ে আবার নিজেকে জাতীয় দলে প্রমাণ করেছেন সেই সাথে ক্রিকেট ইতিহাসের কামব্যাক কিং হিসেবে নিজেকে করেছেন সেরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link