ছক্কা নেশায় বিভোর ব্যাট

কাইরেন পোলার্ডের জন্ম ত্রিনিদাদের ছোট্ট দ্বীপ তাকারিগুয়াতে। পোলার্ডের ছোটবেলা কেটেছে নিদারুণ কষ্টে-দারিদ্র্যের মাঝে। তার বাবা ছোটবেলাতেই তাদের ছেড়ে আলাদা হয়ে যান। পোলার্ড তার মা এবং ছোট দুই বোনের সাথে থাকতেন। বেশিরভাগ দিনই তাদের কাছে খাবার কেনার মতো টাকাও থাকতো না।

১.

অ্যান্টিগায় প্রথম টি-টোয়েন্টিতে মুখোমুখি শ্রীলঙ্কা এবং স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজ। শ্রীলঙ্কার দেয়া ১৩২ রানের ছোট লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে তিন ওভারেই ৫২ রান তুলে ফেলেন দুই ওপেনার লেন্ডল সিমন্স আর এভিস লুইস। এমন সময় দৃশ্যপটে আবির্ভাব আকিলা ধনঞ্জয়ার। টানা তিন বলে তুলে নেন এভিন লুইস, ক্রিস গেইল আর নিকোলাস পুরানকে।

পরের ওভারে হাসারাঙ্গা তুলে নেন লেন্ডল সিমন্সকে। হুট করেই যেন ম্যাচে ফিরে আসে শ্রীলঙ্কা। ব্যাটিংয়ে নামেন ক্যারিবিয়ান অধিনায়ক। অপরপক্ষে তখন বল করবেন হ্যাটট্রিক করে আত্নবিশ্বাসের তুঙ্গে থাকা আকিলা ধনঞ্জয়া, একটি উইকেট তুলে নিতে পারলেই ম্যাচ হেলে পড়বে লংকানদের দিকে। কিন্তু ওভারজুড়ে যা হলো তা হয়তো কল্পনা করতে পারেননি কেউই।

ছয়, ছয়, ছয়, ছয়, ছয়, ছয়!

হ্যাঁ, ওভারের ছয়টি বলকেই সীমানার বাইরে পাঠিয়ে ক্যারিবিয়ানদের জয় অনেকটাই নিশ্চিত করলেন তিনি।

সেই অধিনায়ক হচ্ছেন কাইরেন আদ্রিয়ান পোলার্ড।

২.

কাইরেন পোলার্ডের জন্ম ত্রিনিদাদের ছোট্ট দ্বীপ তাকারিগুয়াতে। পোলার্ডের ছোটবেলা কেটেছে নিদারুণ কষ্টে-দারিদ্র্যের মাঝে। তার বাবা ছোটবেলাতেই তাদের ছেড়ে আলাদা হয়ে যান। পোলার্ড তার মা এবং ছোট দুই বোনের সাথে থাকতেন। বেশিরভাগ দিনই তাদের কাছে খাবার কেনার মতো টাকাও থাকতো না।

২০০৫ সালে টিসিএল গ্রুপ ওয়েস্ট ইন্ডিজ অনুর্ধ্ব-১৯ টুর্নামেন্টে ভালো খেলার পর পাকিস্থানগামী ওয়েস্ট ইন্ডিজ অনুর্ধ্ব-১৯ দলে ডাক পান তিনি। সেখানে প্রথম ওডিয়াইতেই করেন ৪৯ বলে ৫৩ রান। পরের ম্যাচেও ফিফটি পেলেও কোনো ইনিংসকেই সেঞ্চুরিতে রূপান্তর করতে পারেননি তিনি। শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত ২০০৬ অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ দলে জায়গা পান পোলার্ড। যদিও বিশ্বকাপে জঘন্য পারফরম্যান্স করেন তিনি, চার ম্যাচে করেন কেবল ১৯ রান। তবে বল হাতে দুই উইকেট পান পোলার্ড।

২০০৬ মৌসুমে হ্যাক্সি ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে খেলতে লিংকনশায়ারে আসেন পোলার্ড। সেখানে পাঁচ ম্যাচ খেলার পর ডাক পান ত্রিনিদাদ এন্ড টোবাগোর হয়ে স্টানফোর্ড টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে। সেমিফাইনালে কিটস এন্ড নেভিসের বিপক্ষে ৩৮ বলে ৮৩ রান করে দলকে ফাইনালে তুলেন পোলার্ড। টুর্নামেন্টে ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি বল হাতেও নেন ছয় উইকেট। এর মাসছয়েক পরে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেও অভিষেক হয়ে যায় পোলার্ডের।

অভিষেক ম্যাচেই ১২৬ রান করে নিজের প্রতিভার জানান দেন তিনি। ১২৬ রানের ৮৬ রানই তিনি করেন বাউন্ডারির মাধ্যমে। লিস্ট এ ক্রিকেটে অভিষেক ম্যাচেও উজ্জ্বল ছিলেন পোলার্ড, অপরাজিত থাকেন ৪৬রান করে। এভাবেই নিয়মিত ভালো খেলার ফলে পোলার্ডের সামনে খুলে যায় জাতীয় দলের দরজা।

৩.

পোলার্ডের ওয়ানডে অভিষেক হয় ২০০৭ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। লোয়ার অর্ডারে ব্যাট করার সুবাদে খুব বেশি ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেতেন না পোলার্ড। এজন্যই ক্যারিয়ারের প্রথম আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি পেতে অপেক্ষা করতে হয় চার বছর, অবশেষে ২০১১ সালে ভারতের বিপক্ষে দেখা পান কাঙ্খিত সেঞ্চুরির। সে ম্যাচে ১১৯ রান করেন তিনি।

২০১৪ সালে বোর্ডের সাথে বেতন সংক্রান্ত ঝামেলায় জড়িয়ে দল থেকে বাদ পড়েন পোলার্ড। এমনকি ছিলেন নাহ ২০১৫ বিশ্বকাপগামী উইন্ডিজ দলে।

জাতীয় দলের হয়ে ১১৬টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে তিনটি শতক এবং ১১টি অর্ধশতকের সাহায্যে ২,৫৬৪ রান করেন তিনি। তার স্ট্রাইকরেট ঈর্ষণীয় ৯৫.৩৫! বল হাতেও ভীষণ কার্যকরী পোলার্ড। জাতীয় দলের হয়ে বল হাতে শিকার করেছেন ৫৪টি উইকেট।

জাতীয় দলের হয়ে ৭৯টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলে ১৩৭ স্ট্রাইকরেটে পোলার্ডের সংগ্রহ ১২২৭ রান। বল হাতে নেন ৩৭ উইকেট, ৮.৪৯ ইকোনমি বজায় রেখে।

২০১২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপজয়ী ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের সদস্য ছিলেন কাইরেন পোলার্ড।

৪.

ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই মারকুটে ব্যাটসম্যান হিসেবে স্বীকৃতি ছিল পোলার্ডের। মূহূর্তের মাঝেই ম্যাচের রঙ পাল্টে দিতে পারতেন তিনি। ফলশ্রুতিতে বিশ্বজুড়ে ফ্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টগুলোতে তার চাহিদা সবার উপরে। বিশ্বের সকল ফ্যাঞ্চাইজি লীগের নিয়মিত মুখ কাইরেন পোলার্ড।

২০০৯ সালে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ টি-টোয়েন্টিতে ত্রিনিদাদ এন্ড টোবাগোর হয়ে নিউ সাউথ ওয়েলসের বিপক্ষে ১৮ বলে ৫৪ রান করে বিশ্বকে চমকে দেন পোলার্ড। সেই ম্যাচের পরই তার সাথে চুক্তি করে নিউ সাউথ ওয়েলস। ২০১০ সালে সমারসেটের হয়ে খেলেন ফ্রেন্ডস প্রভিডেন্ট টি-টোয়েন্টি।

চ্যাম্পিয়ন্স লিগে দুর্দান্ত পারফরমেন্স পোলার্ডকে ২০১০ আইপিএল অকশনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ক্রিকেটারে পরিণত করে। অকশনের টেবিলে সবাইকে পেছনে ফেলে সাড়ে সাত লাখ ডলারে তাকে দলে ভেড়ায় মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স। সেই থেকে শুরু তার মুম্বাইয়ের সাথে গাঁটছড়া।এখনো তিনি খেলে যাচ্ছেন মুম্বাইয়ের হয়ে।

মুম্বাইয়ের আস্থার প্রতিদানও পোলার্ড দিয়েছেন দারুণভাবে। ২০১৩ আইপিএল ফাইনালে চেন্নাইয়ের বিপক্ষে ৩২ বলে  অপরাজিত ৬০ রান করেন দলকে চ্যাম্পিয়ন করেন তিনি। ২০১৫ আইপিএল ফাইনালেও তিনি ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল, ১৮ বলে ৩৬ রান করেন তিনি।

১৭১ টি আইপিএল ম্যাচ খেলে পোলার্ডের সংগ্রহ ৩,১৫৭ রান।তার স্ট্রাইকরেট চোখ কপালে তোলার মতো ১৪৯.৫৭!

ব্যাটের পাশাপাশি স্লো মিডিয়াম পেস বলেও তুলে নিয়েছেন ৬৩ উইকেট।

পিএসএলে খেলেছেন করাচি কিংস,মুলতান সুলতান্স, পেশোয়ার জালমির হয়ে।বিপিএলেও খেলেছেন ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরর্স, ঢাকা ডাইনামাইটসের হয়ে। বিগ ব্যাশে মাঠ মাতিয়েছেন মেলবোর্ন রেনেগেডসের হয়ে। সিপিএলের প্রথম তিন আসরে বার্বাডোসের অধিনায়ক হিসেবে থাকলেও বর্তমানে ত্রিনবাগো নাইট রাইডার্সের অধিনায়ক তিনি। সর্বশেষ সিপিএলে ত্রিনবাগোকে এনে দিয়েছেন অপরাজিত শিরোপা।নিজে নির্বাচিত হন টুর্নামেন্টের সেরা ক্রিকেটার হিসেবে।

৫.

কাইরন পোলার্ড;হার্শেল গিবস এবং যুবরাজ সিংয়ের পর তৃতীয় ব্যাটসম্যান যিনি কিনা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এক ওভারে ছয় ছক্কা মারেন। একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে ৫০০ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেন তিনি। কয়েকদিন আগে মাত্র দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে টি-টোয়েন্টিতে স্পর্শ করেন ১০,০০০ রানের রেকর্ড।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ জাতীয় দল থেকে অনেকদিন নির্বাসিত থাকার পর ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে দলের ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টি দলের অধিনায়ক হন পোলার্ড। তার অধীনে ১৭টি এক দিনের ম্যাচ খেলে ১১টিতেই জয়লাভ করে ক্যারিবিয়ানরা।

পোলার্ডের মধ্যে এখন নতুন এক স্বপ্নের অধিনায়ক দেখছে ক্যারিবিয়রা।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...