Social Media

Light
Dark

সোনালি অতীতের শেষ স্মৃতি

১.

প্রথম টেস্ট জয়টাই ২২৬ রানের!  প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়ের স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ তখন আত্নবিশ্বাসে ভরপুর। এনামুল জুনিয়র,মোহাম্মদ রফিক,মাশরাফি বিন মর্তুজা,তাপস বৈশ্যরা তখন বল হাতে আগুন ঝরাচ্ছেন মাঠে।

মানসিকভাবে পিছিয়ে থেকেই দ্বিতীয় টেস্ট খেলতে নামে জিম্বাবুয়ে। কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প ভেবে রেখেছিলেন অন্য একজন। প্রথম ইনিংসে বাকিরা আউট হয়ে যাওয়ায় অপরাজিত থাকতে হয় ৮৫ রান করে। দ্বিতীয় ইনিংসেও মাশরাফির আগুনে ছিন্নভিন্ন জিম্বাবুয়ের টপঅর্ডার, ৩৭রানেই নেই চার উইকেট।

এমন অবস্থায় ব্যাটিংয়ে নেমে ব্রেন্ডন টেলরের সাথে গড়লেন ১৫০ রানের জুটি। টেলর ৭৮ রান করে আউট হবার পর লোয়ার অর্ডারের সাথে ছোট ছোট জুটি গড়ে শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে যখন প্যাভিলিয়নে ফিরলেন ততক্ষণে জিম্বাবুয়ে পেয়ে গেছে লড়াই করবার মতো সংগ্রহ আর তার নামের পাশে জ্বলজ্বল করছে ১৫৩ রান। যদিও পরবর্তীতে বোলারদের ব্যর্থতায় ম্যাচটি ড্র হয়। অতিমানবীয় এক ইনিংস খেলেন নাফিস ইকবাল।

সেই ব্যাটসম্যানটি ছিলেন টাটেন্ডা টাইবু – জিম্বাবুয়ের সোনালি যুগের শেষ প্রতিনিধি।

২.

ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় ১৯৬০ সালের দিকে মালাউই ছেড়ে তৎকালীন রোডেশিয়ায় আসেন টাটেন্ডা টাইবুর বাবা। জিম্বাবুয়ের বেশিরভাগ কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটারদের মতো তার পরিবারের সাথেও ক্রিকেটের কোনো সম্পর্ক ছিল না। স্কুলে থাকাকালীন ক্রিকেটের চেয়ে ফুটবলে আর রাগবিতেই বেশি আগ্রহ ছিল টাইবুর। চিপেমব্রে স্কুলের ফিফথ গ্রেডে পড়ার সময় জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের জেলাভিত্তিক উন্নয়ন কর্মসূচীর মাধ্যমে ক্রিকেটের সাথে তার পরিচয়। তার ইচ্ছা ছিল ঈগলসভেইল স্কুলে ভর্তি হবার। কিন্তু বাবার মৃত্যু এবং চার্চিল স্কুলে স্কলারশিপ পেয়ে যাওয়ায় আর্থিক দিক বিবেচনায় সেখানেই ভর্তি হন।

টাটেন্ডা টাইবু মূলত ক্যারিয়ার শুরু করেন অফস্পিনার হিসেবে কিন্তু সপ্তম গ্রেডে ওঠার পর থেকে ব্যাটিংয়ে উন্নতি করতে শুরু করেন। একই বছরে তিনি স্টিফেন ম্যাঙ্গোঙ্গোর অধীনে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যান। সেখানে তিনি মূলত অফস্পিনার হিসেবেই সুযোগ পান ফলে বেশিরভাগ ম্যাচেই ব্যাটিং করার সুযোগ পাননি।

ব্যাটিংয়ে সুযোগ পাওয়া প্রথম ম্যাচে ৩১ রান করে অপরাজিত থাকেন। যদিও স্পিন বোলিংয়ে তিনি ছিলেন বরাবরই উজ্জ্বল, শ্যারন স্কুল এবং চিতুংজিয়া স্কুলের বিপক্ষে নেন ৫ উইকেট। এক ম্যাচে টপ অর্ডারে ধস নামলে তিনি ব্যাট করার সুযোগ পান। সে ম্যাচে ৭৪ রানে অপরাজিত থেকে নিজের ব্যাটিং প্রতিভার জানান দেন তিনি। এরপরই তিনি ব্যাটিং অর্ডারে উপরে চলে আসেন।

একদিন তার দলের উইকেটরক্ষক মাঠে না থাকায় তাকেই গ্লাভস হাতে উইকেটের পেছনে দাঁড়াতে হয়। সে ম্যাচে যদিও কোনো ক্যাচ বা স্ট্যাম্পিং করতে পারেননি, কিন্তু মাঠে উপস্থিত থাকা বিল ফ্লাওয়ার (অ্যান্ডি এবং গ্রান্ড ফ্লাওয়ারের বাবা) তার প্রশংসা করেন।

এরপরই টাইবু জাতীয় দলের সাবেক উইকেটরক্ষক দেস ইভান্সের কাছে কিপিং শেখা শুরু করেন এবং সেখান থেকেই উইকেটকিপিংয়ের যাত্রা শুরু হয় তাঁর। পাশাপাশি অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারও তাকে উইন্সটোনিয়ান স্পোর্টস ক্লাবে প্রাকটিস করার ব্যাপারে সহায়তা করেন।

পরবর্তী তিন বছর বিভিন্ন পজিশনে ব্যাট করার পর অবশেষে তিন নম্বর পজিশনে থিতু হন তিনি।ঈগলসভেইলের বিপক্ষে ১৫৬ রানের ইনিংসে খেলায় মাত্র ১৪ বছর বয়সেই উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান হিসেবে জায়গা করে নেন নামিবিয়াগামী অনুর্ধ্ব-১৬ জাতীয় দলে। সেখানে তার দুর্দান্ত ব্যাটিং প্রদর্শনীর ফলে মাত্র ১৬ বছর বয়সে জায়গা পান দক্ষিণ আফ্রিকাগামী অনুর্ধ্ব-১৯ দলে।

শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ দলেও জায়গা করেন নেন তিনি। সে বিশ্বকাপে দুটি অর্ধ-শতকও তুলে নেন তিনি। ২০০২ সালে নিউজিল্যান্ডে অনুষ্ঠিত অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে যান জিম্বাবুয়ে দলের অধিনায়ক হিসেবে। সেখানে ব্যাট হাতে ৫০ গড়ে ২৫০ রানের পাশাপাশি বল হাতে তুলে নেন ১২ উইকেট।কিপিংয়ে কম যাননি,উইকেটের পেছনে দাঁড়িয়ে লুফে নেন ৫টি ক্যাচ। ফলশ্রুতিতে সেই বিশ্বকাপের টুর্নামেন্ট সেরা হন তিনি।

৩.

২০০১ সালে সবাইকে অবাক করে দিয়ে জিম্বাবুয়ের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের দলে ডাক পান তিনি। বিষয়টা জেনে তিনি এতটাই অবাক হন যে লোগান কাপে নিজের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক ম্যাচ দেরি করে পৌঁছানোর কারণে মিস করেন। যদিও তৎকালীন নির্বাচক অ্যান্ডি পাইক্রফট জানান,তাকে দলে নেয়া হয়েছে কেবলমাত্র অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য।

ব্যাটসম্যান হিসেবে তার শক্তির জায়গা ছিল দুর্দান্ত কভার ড্রাইভ এবং পুল। আকারে ছোটখাটো হলেও বিশ্বসেরা সব বোলারদের পুল করেছেন অবলীলায়। আর স্পিনারদের বিপক্ষে খেলতে বরাবরই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন তিনি।

টাইবুর ক্যারিয়ার অদ্ভুত রোলার কোস্টার রাইডের মতো। হুট করে ১৭ বছরের এই কিশোরের জাতীয় দলে অভিষেক হয়ে যায়। আবার কয়েকদিনের মাঝেই দেখেন সিনিয়র ক্রিকেটারদের অবসর নেয়ার হিড়িক। এমতাবস্থায় ঘরের মাঠে শ্রীলংকা সিরিজের জন্য দল ঘোষণা করে জিম্বাবুয়ে, যে দলের মাত্র ছয়জন আগে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছেন। সেই দলের অধিনায়ক হিসেবে নির্বাচিত হন টাটেন্ডা টাইবু।

রশিদ খানের পূর্বে তিনিই ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট অধিনায়ক।দেশের মাটিতে শ্রীলংকার বিপক্ষে টেস্ট এবং ওডিয়াই দুটোতেই হোয়াইটওয়াশের লজ্জায় পড়ে জিম্বাবুয়ে। পরের সিরিজটি ছিল ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে লজ্জাজনক সিরিজ। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে খেলা তিনটি ওয়ানডে এবং দুইটি টেস্টে বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ গড়তে পারেনি টাইবুর জিম্বাবুয়ে।

২০০৫ সালে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট বোর্ড ক্রিকেটারদের নতুন চুক্তির প্রস্তাব দেয় যেখানে বেতন কাঠামো ছিল পূর্বের তুলনায় কম। এরপর টাইবু তার কয়েকজন সতীর্থদের সংবাদ সম্মেলন করলে টাইবু এবং তার স্ত্রী মৃত্যুর হুমকি পান। কিন্তু যখন তার স্ত্রীকে অপহরণের চেষ্টা করা হয় তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন ক্রিকেট থেকে অবসরের। এর মাঝেই তার কয়েকজন সতীর্থ বোর্ডের নতুন চুক্তিতে রাজি হয়ে যান যা তাকে ব্যথিত করে তোলে। কিন্তু অবসর নিলেও তার উপর থেকে আক্রমণ না কমায় তিনি দেশ ছাড়তে বাধ্য হন।

২০০৫ সালে অবসর নেবার আগে টাইবু ২৪ টেস্টে ১,২৭৩ রান করেন,সাথে ছিল ৪৮টি ক্যাচ এবং চারটি স্ট্যাম্পিং। ক্যারিয়ার সেরা বাংলাদেশের বিপক্ষে ১৫৩।৮৪টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে কোনো শতক না থাকলেও সাতটি অর্ধ-শতকের সাহায্যে করেন ১,৪১০রান।

দুই বছর পর স্পন্সরদের অনুরোধে পুনরায় জাতীয় দলে ফিরে আসেন টাইবু। ফিরে আসার পর চার টেস্টে তিন ফিফটিতে করেন ১৮৪ রান এবং ৬৬টি একদিনের ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দুটি শতকের পাশাপাশি ১৫টি অর্ধ-শতকে ১,৯৮৩ রান সংগ্রহ করেন তিনি। পরিসংখ্যান হয়তো আহামরি কিছু নাহ কিন্তু মৃতপ্রায় জিম্বাবুয়ের জন্য টাইবু ছিলেন আশীর্বাদস্বরূপ।

২০১১ সালে মাত্র ২৯ বছর বয়সে টাটেন্ডা টাইবু সব ধরনের ক্রিকেট থেকে অবসর নেন। অথচ এই বয়সে এসেই কিনা বেশিরভাগ ব্যাটসম্যান ক্যারিয়ারের সেরা ফর্মে থাকেন।

৪.

টেস্ট থেকে অবসর নেয়ার পর তিনি গীর্জায় ট্রাস্টি হিসেবে যোগ দেন। অভিজাত সাদা পোশাক পড়ে টেস্ট খেলতেন, অবসরের পর কেবল পোশাকটা বদলে যায়, রঙটা একই থাকে। চার্চের সব সম্পদের হিসাব রাখাই ছিল তার কাজ। পাশাপাশি অসুস্থ রোগিদের জন্য প্রার্থনা করতেন। চার্চে এমন রোগিরা আসতেন যাদের কিনা বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছেন চিকিৎসকরা। তাদের জন্য প্রার্থনা করতেন তিনি। সেই সময়টাকেই নিজের সেরা সময় বলে মানেন টাইবু।

সময়ের সাথে সাথে পালাবদল ঘটে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটেও। বোর্ডের চেয়ারম্যান হয়ে আসেন টাইবুর কাছের মানুষ তাভেংওয়া মুকুলানি। চেয়ারম্যান হয়েই ক্রিকেট বোর্ডে যুক্ত  হতে অনুরোধ করেন টাইবুকে, টাইবু ফিরিয়ে দিলেও হাল ছাড়েন না মুকুলানি। অবশেষে বছর খানেক পর রাজি হন টাইবু।

নির্বাচক এবং ডেভেলপমেন্ট অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পান টাইবু। দল নির্বাচনের পাশাপাশি উদীয়মান তরুণ ক্রিকেটার তুলে আনার জন্য ব্যক্তি উদ্যোগে একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। দায়িত্ব নিয়েই ফিরিয়ে আনেন কলপ্যাক চুক্তিতে দেশ ছাড়া দুই সাবেক সতীর্থ ব্রেন্ডন টেলর আর কাইল জার্ভিসকে। নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো শ্রীলঙ্কা গিয়ে ওয়ানডে সিরিজ জিতে জিম্বাবুয়ে তাঁর সময়কালে।

৫.

ঢাকার ঘরোয়া ক্রিকেটে পরিচিত মুখ ছিলেন টাইবু। সিটি ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে খেলেছেন অনেকদিন। সাবেক বিসিবি কর্মকর্তা রিয়াজ উদ্দিন মামুনের সাথে তার ভাইয়ের মতো সম্পর্ক। এমনকি জিম্বাবুয়ে থেকে বিতাড়িত হবার পর বাংলাদেশেই এসে উঠেছিলেন প্রথম।

এজন্যই তো বাংলাদেশকে পরিচয় দেন নিজের দ্বিতীয় বাড়ি হিসেবে। সম্প্রতি দায়িত্ব পান বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান(বিকেএসপি) এর ব্যাটিং কোচ হিসেবে। করোনা পরিস্থিতির কারণে যোগদান পিছিয়ে গেলেও আশা করা যায় বাংলার ভবিষ্যৎ ক্রিকেট কান্ডারিদের বেড়ে উঠতে সাহায্য করবেন তিনি।

অসামান্য ক্রিকেট প্রতিভার অধিকারী ছিলেন না টাইবু। নিজের সীমিত সামর্থ্যের সর্বোচ্চ প্রয়োগ করার চেষ্টা করে গেছেন আজীবন। ক্যারিয়ারের শুরুতে যেমন অংশ ছিলেন জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের সোনালি সময়ের তেমনি ক্যারিয়ারের মাঝামাঝিতে এসে মুখোমুখি হয়েছেন নোংরা রাজনীতির। জিম্বাবুয়েতে ক্রিকেটের সংস্কৃতি ছিল একসময়, সেটা এখন ধ্বংস হয়ে গেছে। সেই ধ্বংসাবশেষ থেকেই নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটাতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন টাটেন্ডা টাইবু।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link