তারিকুজ্জামান মুনির ৩০৮ নট আউট!

তারিকুজ্জামান মুনির নিজের যাত্রাটা শুরু করেছিলেন ফুটবল দিয়ে। তাঁর বাবা ফখরুজ্জামানও ছিলেন পেশাদার ফুটবলার। খেলেছেন ঢাকার বিখ্যাত ক্লাব ওয়ান্ডারার্সের হয়ে। ফুটবল খেলে বেশ নাম ডাকও করেছিলেন তারিকুজ্জামান মুনিরও। তিনিও মালিবাগ অভিযাত্রীর হয়ে তৃতীয় বিভাগের ফুটবল খেলেছেন।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের কোন ব্যাটসম্যান এখনো ট্রিপল সেঞ্চুরির দেখা পায়নি।

প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটে দু জন ব্যাটসম্যানের ট্রিপল সেঞ্চুরি আছে। কিন্তু সেই তালিকায় আবার তার নাম নেই। লিখিত ইতিহাসে সেভাকে তার নাম খুজে পাওয়াই কঠিন। অথচ বাংলাদেশে এই ইতিহাসটা তার হাত ধরেই রচিত হয়েছিলো।

এই কঠিন পথটা প্রথম পাড়ি দিয়েছিলেন। এই একটা কারণেই দেশের ক্রিকেটে এক অবিস্মরণীয় নাম হয়ে থাকবেন তিনি। তবে তাঁকে মনে রাখার মত বাংলাদেশ ক্রিকেটে আরো অনেক কিছুই করেছিলেন এই ব্যাটসম্যান। বাংলাদেশের ক্রিকেটের এ অবিচ্ছেদ্য অংশ, প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরিয়ান ছিলেন তারিকুজ্জামান মুনির।

অথচ তারিকুজ্জামান মুনির নিজের যাত্রাটা শুরু করেছিলেন ফুটবল দিয়ে। তাঁর বাবা ফখরুজ্জামানও ছিলেন পেশাদার ফুটবলার। খেলেছেন ঢাকার বিখ্যাত ক্লাব ওয়ান্ডারার্সের হয়ে। ফুটবল খেলে বেশ নাম ডাকও করেছিলেন তারিকুজ্জামান মুনিরও। তিনিও মালিবাগ অভিযাত্রীর হয়ে তৃতীয় বিভাগের ফুটবল খেলেছেন।

এছাড়া বাবার অনুপ্রেরণায় তাঁরা পাঁচ ভাই-ই কোন না কোন পর্যায়ের ক্রিকেট খেলেছেন। ফলে পারিবারিক ভাবেই খেলাধুলার মধ্যেই বড় হয়েছেন তাঁরা। মূলত বাবার অনুপ্রেরণাতেই ক্রিকেটে আসা তারিকুজ্জামান মুনিরের। তবে ক্রিকেটে তাঁর হাতেখড়িটা হয়েছে হঠাত করেই। তাঁর এক পারিবারিক বড় ভাইয়ের হাত ধরে সিদ্ধ্বেশরীর মাঠে খেলতে যেতেন। আসলে ছোট বলে দলে কখনো জায়গা পেতেন না।

তবে হঠাৎই একদিন খেলোয়াড় কম পড়ায় দলে সুযোগ পেয়ে গেলেন। এরপর অবশ্য সেই ইগলেটসের হয়েই ১৯৭৬-৭৭ মৌসুমে পেশাদার ক্রিকেটে নাম লিখিয়েছিলেন। এরপর সেই সময় দেশের ক্রিকেটে ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ নাম হতে শুরু করেন তিনি। খেলেছেব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আবাহনী, মোহামেডানের মত ডাকসাইটে দলগুলোর হয়ে।

তবে দেশের ক্রিকেটে আলোড়ন তৈরি করেছিলেন একটি ইনিংস দিয়েই। জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে সেই সময়ে অবিশ্বাস্য এক কীর্তি করেন। সেমিফাইনালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ট্রিপল সেঞ্চুরি করে ফেলেন। ৫১০ মিনিট উইকেটে থেকে খেলেছিলেন ৩০৮ রানের বিখ্যাত সেই ইনিংস।

তখনও বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেট প্রথম শ্রেনীর স্বীকৃতি পায়নি।

এই ইনিংসটিই তারিকুজ্জামান মুনিরের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় হাইলাইট হয়ে রয়েছে। সেই সময় পত্রিকাগুলোতে শিরোনাম ছিলেন তিনিই। ১৯৮৪-৮৫ মৌসুমে খেলা সেই ইনিংসের কারণে বিসিবি থেকে ১২ হাজার টাকা পুরষ্কার পেয়েছিলেন। ওই টাকা দিয়ে নাকি সেইসময় তিন বছর চলেছিলেন তিনি। এছাড়া ওই ম্যাচে আতাহার আলীও ১৫৫ রানের একটি ইনিংস খেলেছিলেন।

আবাহনী মাঠের সেই ম্যাচে দ্রুত কিছু উইকেট হারিয়ে ফেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে মধ্যাহ্নভোজের কিছু আগেই ব্যাট করতে নেমেছিলেন তিনি। সেদিন ব্যাট করার পরে, দ্বিতীয় দিনেরও পুরোটা বাইশ গজে কাটিয়েছেন প্রায়। দ্বিতীয় দিন খেলা শেষ হওয়ার মিনিট দশেক আগে সুব্রতর বলে আউট হন তিনি। ওই ইনিংসটিতে অবশ্য দুবার জীবনও পেয়েছিলেন। একটি ৯৬ রানে ও আরেকটি ২১৪ রানে।

বাংলাদেশের ঘরেরায়া ক্রিকেটে প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরি বলে কথা। স্পেশাল না হওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে আরো কিছু কারণে ইনিংসটি তারিকুজ্জামানের কাছে বিশেষ ছিল। ওই ইনিংসটি তাঁর বাবা মাঠে বসে দেখেছিলেন। ইনিংসের পর নাকি ছেলেকে ধরে কেঁদে দিয়েছিলেন বাবা ফখরুজ্জামান। এর আগে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে রকিবুল হাসানের সর্বোচ্চ ২১৪ রানের ইনিংস ছিল। ফলে সবাইকে অনেক অনেক পিছনে ফেলে সেই সময়ের ক্রিকেটে নতুন এক জোয়ার এনে দিয়েছিলেন তিনি।

এরপরের ম্যাচে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে আবার সেঞ্চুরি করেন তিনি। ইনিংস দুটির ফলও পেয়েছিলেন হাতে নাতে। কিছুদিন পরে শ্রীলঙ্কা দল আসে বাংলাদেশ সফরে। সেখানে বাংলাদেশের হয়ে ডাক পান তিনি। যদিও মাত্র ২ টি ম্যাচই খেলেছেন বাংলাদেশের হয়ে। এরপরের বছরই আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনায়কের দায়িত্ব পান। সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে খেলতেন গাজী আশরাফ হোসেন লিপু, ওয়াহিদুল গণি, আলি আহসান বাবুর মত দেশ সেরা ক্রিকেটাররা। এছাড়া সেই সময় দ্রুততম সেঞ্চুরিও এসেছিল তাঁর ব্যাট থেকেই। করেছিলেন মাত্র ৫১ মিনিটে।

অবশ্য ফিল্ডার হিসেবেও নিজের সময়কে উত্তীর্ন করেছিলেন তিনি। সেই সময় দেশের ক্রিকেটের সেরা ফিল্ডারদের একজন ছিলেন তিনি। দ্রুতগতির ফিল্ডিং এর জন্য পরিচিত ছিলেন গুল্লি নামে। গালি ও পয়েন্টে ফিল্ডিং করতেন বাজপাখির মত। এই সময়ে আমরা বাউন্ডারিতে যে ধরনের ফিল্ডিং দেখি সেটা দেশের ক্রিকেটে প্রথম করে দেখিয়েছিলেন তিনিই।

ফিল্ডিং দিয়েও যে স্টার হওয়া যায় সেটা সেই সময় বোধহয় কেউ বিশ্বাস করতেন না। এখনকার সময় জন্মালে বোধহয় দেশের ক্রিকেটের বড় তারকা হতেন তিনি। অনেকেই তাঁকে স্মরণ করেন বাংলার জন্টি রোডস হিসেবে। অনেকে স্মরণ করেন বাংলাদেশের প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরিয়ান হিসেবে। তবে আমরা তাঁকে স্মরণ করেছি যে ভিত্তি গুলোর উপর আজ বাংলাদেশের ক্রিকেট বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেটার একজন ভিত্তি হিসেবে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...