সিডনি বার্নস: বোলিংয়ের ব্র্যাডম্যান

বার্নস যে শুধু স্কিল আর বৈচিত্র্যেই সেরা ছিলেন তা নয়, তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন চাতুর্য ও বুদ্ধিমত্তার দিক থেকেও। যেকোন ব্যাটসম্যানের দুর্বলতা পড়ে ফেলতে তাঁর দুই মিনিটও সময় লাগত না। বার্নসের বোলিংয়ের একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল ‘সারপ্রাইজ অ্যাটাক’। সুযোগ বুঝে ব্যাটসম্যানের দুর্বল জায়গায় অতর্কিত আঘাত হানতেন।

টেস্ট ইতিহাসের সর্বোচ্চ রেটিং পয়েন্ট (৯৩২) প্রাপ্ত বোলার তিনি। কেবল টেস্ট ক্রিকেট নয়; সব ধরনের ক্রিকেট মিলিয়েই তাঁকে ‘সর্বকালের সেরা’ বোলার মানেন অনেকেই। তিনি মিডিয়াম পেসার নাকি স্পিনার ছিলেন তা নিয়েও আছে রহস্য। প্রখ্যাত ক্রিকেট লিখিয়ে নেভিল কার্ডাস যার সাপের ফণা তোলা বিষাক্ত ডেলিভারির নামকরণ করেছিলেন ‘বার্নস-বল’। তিনি হলেন ক্রিকেট ইতিহাসের সবচাইতে স্কিলফুল ও বৈচিত্র্যময় বোলার সিডনি ফ্রান্সিস বার্নস।

২৭ টেস্টে মাত্র ১৬.৪৩ গড়ে ১৮৯ উইকেট! অর্থাৎ ম্যাচপ্রতি ৭টি করে উইকেট! স্ট্রাইক রেট মাত্র ৪১.৬৫! অর্থাৎ প্রতিটি উইকেটের জন্য বার্নসকে বল করতে হয়েছে ৭ ওভারেরও কম!

এই ছোট্ট ক্যারিয়ারেই তিনি ইনিংসে ৫ উইকেট নিয়েছেন ২৪ বার আর ম্যাচে ১০ উইকেট ৭ বার!

ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময় খেলেছেন মাইনর কাউন্টিতে। সমসাময়িকদের তুলনায় তাঁর ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচের সংখ্যা খুব বেশি না। ১৩৩টি ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচে তাঁর শিকার ৭৩৩ উইকেট! গড় মাত্র ১৭.০৯! ইনিংসে ৫ উইকেট পেয়েছেন ৬৮ বার আর ম্যাচে ১০ উইকেট ১৮ বার!

টেস্ট ক্রিকেট, ফার্স্ট ক্লাস, কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপ, ল্যাঙ্কাশায়ার লিগ, স্টেফোর্ডশায়ার লিগ ও মাইনর কাউন্টি মিলিয়ে বার্নসের ক্যারিয়ারে সর্বমোট উইকেটের সংখ্যাটা ছাড়িয়ে গেছে ৬ হাজার! আরও নির্দিষ্ট করে বললে ৬২২৯! অথচ গড় মাত্র ৮.৩৩!

মাত্র আট গড়ে ছয় সহস্রাধিক উইকেটের এই পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে, কতটা ভয়ানক উইকেটশিকারি বোলার ছিলেন সিডনি বার্নস।

সিডনি বার্নসের জন্ম ১৮৭৩ সালের ১৯ এপ্রিল, ইংল্যান্ডের স্টেফোর্ডশায়ারে। প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে হাতেখড়ি ১৮৮৮ সালে, স্মেথউইক ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে। মজার ব্যাপার হল, তাঁর ক্যারিয়ারের শুরুটা হয়েছিল ডানহাতি অফ স্পিনার হিসেবে! অফ স্পিনের পাশাপাশি লেগ স্পিনের হাতটাও মন্দ ছিল না।

১৮৯৪ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক, ওয়ারউইকশায়ারের হয়ে। ততদিনে তাঁর পরিচয় একজন পুরোদস্তুর ফাস্ট বোলার। খুব বেশিদিন অবশ্য খেলতে পারেন নি সেখানে। ওয়ারউইকশায়ার ক্লাবের অপেশাদার আচরণের কারণে মাত্র তিন ম্যাচ খেলেই কাউন্টি চুক্তি বাতিল করেছিলেন তিনি। ক্লাবের তরফ থেকে প্রস্তাবিত চুক্তির শর্তাবলী নিয়েও নাখোশ ছিলেন বার্নস।

১৮৯৫ সালে কাউন্টি ক্রিকেট ছেড়ে বার্নস যোগ দেন ল্যাঙ্কাশায়ার লিগের দল রিশটনে। ১৮৯৯ সাল পর্যন্ত সেখানেই কাটিয়েছেন। রিশটনের হয়ে ৩৮ ম্যাচ খেলে পেয়েছেন ৪১১ উইকেট। ১৮৯৮ মৌসুমে মাত্র ৮.৪৬ গড়ে নিয়েছিলেন ৯৬ উইকেট!

ওয়ারউইকশায়ারে থাকতে বার্নস ছিলেন মূলত ফাস্ট বোলার। তবে রিশটন ক্লাবে আসার পর পেস কমিয়ে হয়ে যান মিডিয়াম পেসার। তখন থেকেই পেসের সাথে স্পিন মিশিয়ে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন বার্নস।

১৯০০ সালে ল্যাঙ্কাশায়ার লিগেরই আরেক ক্লাব বার্নলিতে যোগ দেন সিডনি। ততদিনে অবশ্য ল্যাঙ্কাশায়ারের হয়ে কাউন্টি অভিষেকটাও হয়ে গেছে তাঁর।

বার্নসের টেস্ট অভিষেক ১৯০১ সালে, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে একরকম হঠাৎ করেই। তাঁর অপ্রত্যাশিতভাবে টেস্ট দলে ডাক পাওয়ার পেছনের গল্পটাও বেশ ইন্টারেস্টিং। চলুন গল্পটা একবার শুনেই আসি।

১৯০১ সালের অ্যাশেজ সফরের জন্য ইংল্যান্ডের অধিনায়ক মনোনীত করা হয় আর্চি ম্যাকলারেনকে। যিনি আবার ছিলেন ল্যাঙ্কাশায়ারেরও অধিনায়ক। দল নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাঁকে দেয়া হয়েছিল পূর্ণ স্বাধীনতা।

ফ্রন্টলাইন বোলার হিসেবে আর্চির প্রথম পছন্দ ছিল ইয়র্কশায়ারের বাঁহাতি পেস জুটি জর্জ হার্স্ট এবং উইলফ্রেড রোডস। কিন্তু ইয়র্কশায়ার সভাপতি লর্ড হক তাঁর দলের সেরা দুই বোলারকে ছাড়তে মোটেও রাজি ছিলেন না। আর্চির তখন হঠাৎ মনে পড়ল বার্নসের কথা। কিছুদিন আগেই না ল্যাঙ্কাশায়ারের হয়ে লেস্টারশায়ারের বিপক্ষে ৭০ রানে ৬ উইকেট নিয়েছিল সে!

ল্যাঙ্কাশায়ারের অধিনায়ক হিসেবে বার্নসকে খুব কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা ছিল আর্চি ম্যাকলারেনের। তো যেই ভাবা সেই কাজ! তৎক্ষণাৎ তিনি বার্নসকে ডেকে পাঠালেন জাতীয় দলের নেটে। বার্নসের বোলিংয়ে কিছুক্ষণ ব্যাটও করলেন। বেশিরভাগ বলেই অবশ্য পরাস্ত হলেন; শরীরে আঘাতও পেলেন বেশ কয়েক জায়গায়। নেট সেশন শেষে ম্যাকলারেনকে তাই ‘সরি’ জানাতে ছুটে এসেছিলেন বার্নস। আর এসেই অধিনায়কের মুখ থেকে শুনলেন সুখবরটা! ‘অভিনন্দন বার্নস, তুমি আমাদের সাথে অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছ।’

১৯০১-০২ অ্যাশেজের দলে বার্নসের অন্তর্ভুক্তিকে বলতে হবে একটা বিরাট চমক। মাত্র ৭টি ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন খেলোয়াড়কে কেবল একবার দেখেই দলে নেয়াটাকে স্রেফ পাগলামি বলেও উড়িয়ে দিতে চেয়েছিল অনেকে। উইজডেনের ভাষায়, ‘the most daring experiment in the history of the game.’

সিরিজের প্রথম ম্যাচটা ছিল সিডনিতে। অভিষেক ম্যাচের প্রথম ইনিংসেই ৫ উইকেট নিলেন বার্নস। বিপক্ষ দলের সেরা দুই ব্যাটসম্যান ভিক্টর ট্রাম্পার ও ক্লেম হিলের উইকেটসহ। ইংল্যান্ড জিতল এক ইনিংস ও ১২৪ রানের বিশাল ব্যবধানে!

উল্লেখ্য, বার্নসের সাথে একই ম্যাচে অভিষিক্ত হয়েছিলেন বাঁ-হাতি স্পিনার কলিন ব্লাইথ এবং লেগ স্পিনার লেন ব্রাউন্ডও। এই তিন ডেব্যুট্যান্ট মিলেই ধস নামিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ান শিবিরে। অস্ট্রেলিয়ার ২০ উইকেটের সবগুলোই জমা পড়েছিল বার্নস (৬), ব্লাইথ (৭) আর ব্রাউন্ডের (৭) ঝুলিতে!

মেলবোর্নে দ্বিতীয় টেস্টে ইংল্যান্ড ২২৯ রানে হেরে গেলেও বার্নস ছিলেন বিধ্বংসী ফর্মে। দুই ইনিংস মিলে একাই নিয়েছিলেন ১৩ উইকেট (৬/৪২ ও ৭/১২১)!

পরের ম্যাচের ভেন্যু ছিল অ্যাডিলেড। কিন্তু দুর্ভাগ্য বার্নসের! হাঁটুর ইনজুরিতে পড়ে ওই সিরিজেই আর খেলাই হলো না তাঁর। ক্যারিয়ারের প্রথম অ্যাশেজটা শেষ হয়ে গেল তৃতীয় টেস্টেই।

হাঁটুর ইনজুরি থেকে সেরে উঠতে বার্নসের লেগে গিয়েছিল অনেকটা সময়। পুরোপুরি ফিট না হওয়া সত্ত্বেও ১৯০২ সালে হোম অ্যাশেজের দলে ডাকা হয় বার্নসকে। তবে এক ম্যাচের বেশি খেলতে পারেন নি। ওই এক ম্যাচেই নিয়েছিলেন ৭ উইকেট।

ইনজুরির কারণে ফিটনেস নিয়ে সমস্যা থাকলেও ১৯০২ ও ১৯০৩ সালের ফার্স্ট ক্লাস মৌসুমে খুব একটা খারাপ করেন নি বার্নস। ১৯০২ মৌসুমে ২১.৫৬ গড়ে ৯৫ উইকেট আর ১৯০৩ মৌসুমে নেন ১৭.৮৫ গড়ে ১৩১ উইকেট।

১৯০৪ সালে বেতন-ভাতা নিয়ে ল্যাঙ্কাশায়ার ক্লাব কর্তৃপক্ষের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে শেষমেশ চুক্তি বাতিল করেন তিনি। ক্লাব ছেড়ে ফিরে আসেন মাইনর কাউন্টিতে। রাগে-অভিমানে জীবনে আর কোনদিন মেজর কাউন্টিতে অংশ নেন নি তিনি। যার বিরূপ প্রভাব পড়েছিল তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারেও।

একটা তথ্য দিয়ে রাখি, বার্নসের ক্যারিয়ারের শুরু ও শেষের মাঝখানে ইংল্যান্ড টেস্ট খেলেছে মোট ৫৮টি, এর মধ্যে বার্নস খেলতে পেরেছেন মাত্র ২৭টিতে! সেই ২৭ টেস্টেই তাঁর শিকার ১৮৯ উইকেট! ৫৮টার মধ্যে অন্তত ৪০টা টেস্টও যদি খেলতে পারতেন, হয়ত ছাড়িয়ে যেতেন ৩০০ উইকেটের মাইলফলকটাও।

অবশেষে তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরলেন তাও প্রায় বছর পাঁচেক পর, ১৯০৭-০৮ সালের এ্যাশেজ দিয়ে। অস্ট্রেলিয়ার কাছে ১-৪ ব্যবধানে এ্যাশেজ খোয়ালেও চার ম্যাচে বার্নসের শিকার ছিল ২৬ গড়ে ২৪ উইকেট। প্রত্যাবর্তন সিরিজ হিসেবে খারাপ বলা যাবে না মোটেও। সিরিজের যে একটা মাত্র টেস্টে ইংলিশরা জিতেছিল, সেটা বার্নসেরই কৃতিত্বে। বল হাতে দ্বিতীয় ইনিংসে বার্নস নিয়েছিলেন ৭২ রানে ৫ উইকেট। আর ব্যাট হাতে ১০ নম্বরে নেমে খেলেছিলেন অপরাজিত ৩৮ রানের ম্যাচ উইনিং ইনিংস!

চতুর্থ ইনিংসে ইংল্যান্ডের সামনে লক্ষ্য ছিল ২৮২ রানের। কিন্তু ২৪৩ রান তুলতেই পড়ে যায় ৯ উইকেট! এমন অবস্থায় দলকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসেন ‘ব্যাটসম্যান’ সিডনি বার্নস (৩৮*)। আর্থার ফিল্ডারের (১৮*) সাথে অবিচ্ছিন্ন শেষ উইকেট জুটিতে যোগ করেন ৩৯ রান, দলকে পাইয়ে দেন ১ উইকেটের নাটকীয় জয়।

১৯০৯ সালে অজিদের বিপক্ষে হোম সিরিজ। তিন ম্যাচ খেলে বার্নস পেলেন ১৭ উইকেট; আর ইংল্যান্ড পেল ‘ব্যাক টু ব্যাক’ অ্যাশেজ হারের স্বাদ।

১৯১১ সালে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে স্বাগতিকদের ৪-১ ব্যবধানে হারিয়ে অ্যাশেজ শিরোপা পুনরুদ্ধার করে ইংল্যান্ড। ২২.৮৮ গড়ে ৩৪ উইকেট নিয়ে সিরিজের সেরা বোলার ছিলেন সিডনি বার্নস।

১৯১২ সালে অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও স্বাগতিক ইংল্যান্ডকে নিয়ে আয়োজন করা হয় ইতিহাসের প্রথম ও একমাত্র ত্রিদেশীয় টেস্ট সিরিজ। সিরিজ নির্ধারণী শেষ ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে ২৪৪ রানে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ইংল্যান্ড। পাঁচ ম্যাচে তিনবার ইনিংসে ৫ উইকেটসহ মাত্র ১০.৩৫ গড়ে বার্নসের শিকার ছিল ৩৯ উইকেট!

বার্নস তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ সিরিজটি খেলেছিলেন ১৯১৪ সালের মার্চে, স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। ৪ টেস্টে ৩ বার ১০ উইকেটসহ মাত্র ১০.৯৩ গড়ে বার্নস একাই নিয়েছিলেন ৪৯ উইকেট!

টেস্টে এক সিরিজে সর্বাধিক উইকেট প্রাপ্তির রেকর্ডও এটাই। দ্বিতীয় স্থানে আছেন ইংলিশ অফ স্পিনার জিম লেকার; ১৯৫৬ এ্যাশেজে যিনি পাঁচ ম্যাচে নিয়েছিলেন ৪৬ উইকেট।

উল্লেখ্য, চার ম্যাচে মোট ৮ ইনিংসে বল করেছিলেন বার্নস, তার মধ্যে ৭ বারই পেয়েছিলেন ৫ উইকেট!

বার্নসের ক্যারিয়ার সেরা বোলিং পারফরম্যান্সটা এসেছিল জোহানেসবার্গে, সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে। ১৫৯ রান খরচায় তুলে নিয়েছিলেন ১৭ উইকেট! টেস্ট ইতিহাসের সেরা ম্যাচ ফিগারের তালিকায় যার অবস্থান দ্বিতীয়। ৯০ রানে ১৯ উইকেট নিয়ে তালিকার এক নম্বরে আছেন জিম লেকার।

ডারবানে নিজের শেষ টেস্টেও বার্নস উইকেট পেয়েছিলেন ১৪টা; সমান ৭টি করে উইকেট নিয়েছিলেন উভয় ইনিংসেই! ‘বার্নস ম্যাজিকে’ ভর করে ইংল্যান্ড হেসেখেলে সিরিজ জিতেছিল ৪-০ ব্যবধানে।

দক্ষিণ আফ্রিকা সফর শেষ না হতেই শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। যুদ্ধের দাবানলে কেঁপে ওঠে সমগ্র পৃথিবী। স্যার জ্যাক হবস, উইলফ্রেড রোডস, অব্রে ফকনার, চার্লি ম্যাককার্টনিদের মত সিডনি বার্নসের জীবন থেকেও হারিয়ে যায় ছয়-ছয়টি বছর।

যুদ্ধ যখন শেষ হল, বার্নসের বয়স তখন ৪৭ বছর। সামনেই অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অ্যাশেজ। ১৯২০-২১ অ্যাশেজের দল ঘোষণা করা হল, সে দলে জায়গা পেলেন বার্নসও। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বেঁকে বসলেন তিনি। জুড়ে দিলেন অদ্ভুত এক শর্ত! তাঁর স্ত্রী এবং সন্তানদের অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ ও থাকা-খাওয়ার যাবতীয় ব্যবস্থা করে দিতে হবে। ইংলিশ ক্রিকেট কর্তৃপক্ষ তাতে রাজী না হওয়ায় শেষমেশ বার্নসও স্কোয়াড থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নিলেন। বার্নসের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার কার্যত ওখানেই শেষ।

জাতীয় দল ও কাউন্টিতে আর কখনও না খেললেও এত সহজে ক্রিকেট ছাড়ার পাত্র নন বার্নস। স্থানীয় লিগ ও মাইনর কাউন্টিতে খেলা চালিয়ে যান আরও বহুদিন। ওয়েলসের হয়ে পরবর্তীতে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটেও অংশ নিয়েছেন তিনি। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, এত বছর খেলেও তাঁর পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতায় এতটুকুও ছেদ পড়েনি কোনদিন।

বার্নসের ক্রিকেট ক্যারিয়ার সম্পর্কে যতটুকু বলার তা বলে দিয়েছি। এবারে আসি বার্নস কেমন বোলার ছিলেন, কী তার রহস্য সেই প্রসঙ্গে। পেস বিবেচনা করলে বার্নস ছিলেন একজন মিডিয়াম পেসার। গতি ছিল ঘন্টায় আনুমানিক ৭০ মাইল বা তারও কম থেকে সর্বোচ্চ ৮০ মাইল। সাবেক ইংরেজ অলরাউন্ডার স্যার অ্যালেক বেডসারের গতির সাথেও তাঁর সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন অনেকে।

সিডনি বার্নসকে বলা হত কম্পলিট বোলার। বোলিংয়ের বেসিক স্কিল যতগুলো আছে অর্থাৎ সুইং, সিম এবং স্পিন—একাধারে তিনটিতেই পারদর্শী ছিলেন তিনি! অনেকের মতে, বিষাক্ত সুইংয়ের সাথে তিনি নাকি স্পিনের মায়াজাল মেশাতে পারতেন! কি অবাক হচ্ছেন? নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না? আসলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

একটা বলকে দু’দিকেই কথা বলাতে পারতেন বার্নস অর্থাৎ ইনসুইং, আউটসুইং দুটোতেই ছিলেন সমান পারদর্শী। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল লেট সুইং। এমনকি নিখুঁত ইয়র্কার পর্যন্ত দিতে পারতেন।

পেসার হিসেবে এত এত স্কিল আর বৈচিত্র্য থাকা সত্ত্বেও বার্নস নিজেকে একজন ‘স্পিনার’ পরিচয় দিতেই গর্ববোধ করতেন। তিনি বারবারই বলেছেন, তাঁর সাফল্যের রহস্য ছিল স্পিন।

উইজডেন বলছে, ‘Barnes was creative, one of the first bowlers really to use the seam of a new ball and combine swing so subtly with spin that few batsmen could distinguish one from the other.’

অস্ট্রেলিয়ার সাবেক বাঁহাতি গ্রেট ক্লেম হিলের মতে, ‘On a perfect wicket Barnes could swing the new ball in and out “very late”, could spin from the ground, pitch on the leg stump and miss the off.’

সিডনি বার্নস পেসার হলেও তাঁর মধ্যে একজন কোয়ালিটি স্পিনারের সবরকম গুণাবলী বিদ্যমান ছিল। তিনি ছিলেন এমন একজন পেসার, যিনি স্বাভাবিকের চেয়ে লম্বা রানআপে দৌড়ে এসে ‘স্পিন’ বল করতেন।  সবচেয়ে বড় কথা, একই অ্যাকশনে স্পিন বোলিংয়ের বেসিক তিনটা ডেলিভারি অর্থাৎ অফ স্পিন, লেগ স্পিন এবং টপ স্পিন করতে পারতেন তিনি, যা তাঁকে বিশ্বের সেরা বোলারের স্বীকৃতি এনে দিয়েছিল।

এ সম্পর্কে উইজডেন বলছে, ‘With all three balls coming out of the front of the hand at considerable speed it would be almost impossible for the batsman to differentiate between them.’

যেহেতু তিনি বলকে স্পিন করাতে পারতেন সেহেতু তাঁকে একজন স্পিনার বলা যেতেই পারে। তা সিডনি বার্নস ঠিক কোন ধরনের স্পিনার ছিলেন? ফিঙ্গার স্পিনার নাকি রিস্ট স্পিনার? এই প্রসঙ্গে বলব, বার্নসের গ্রিপ ছিল ফিঙ্গার স্পিনারদের মত, কিন্তু বল রিলিজ করতেন ফাস্ট বোলারদের রিস্ট অ্যাকশনে।

সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হল, কব্জি না বাঁকিয়েই কেবলমাত্র আঙুলের সাহায্যে (finger twisting) একটা বলকে টার্ন করাতে পারতেন তিনি। প্রখ্যাত ক্রিকেট সাহিত্যিক নেভিল কার্ডাস যথার্থই বলেছেন, ‘He fingered a cricket ball sensitively, like a violinist his fiddle.’

শারীরিকভাবে বার্নস ছিলেন বেশ লম্বা (ছয় ফুটেরও বেশি), চওড়া কাঁধ, সুগঠিত বাহু ও সুঠাম দেহের অধিকারী। তাঁর ছিল স্মুথ ইজি রানআপ, হাই রিলিজ পয়েন্ট (অনেকটা ম্যাকগ্রার মত) এবং কুইক আর্ম একশন। বল ডেলিভারির সময় চাবুকের বাড়ি দেবার মত এক ধরনের ইফেক্ট তৈরি হত। ‘এক্সট্রা লিফট’ এবং ‘লেট ডিপ’ আদায় করে নিতে পারতেন খুব সহজেই।

প্রখ্যাত ক্রিকেটলেখক ও ধারাভাষ্যকার জন আর্লট বলেছেন, ‘বার্নস ওয়াজ পারফেক্টলি বিল্ট টু বি এ বোলার।’ লাইন-লেন্থের ওপর বার্নসের ছিল অবিশ্বাস্য নিয়ন্ত্রণ, শর্ট বল দিতেনই না বলতে গেলে। সাথে ছিল বুদ্ধিদীপ্ত ‘চেঞ্জ অব পেস’। তাঁর প্রতিটা ডেলিভারির জন্যই ছিল ফাস্টার এবং স্লোয়ার দুই ধরনের ভ্যারিয়েশন।

বার্নস যে শুধু স্কিল আর বৈচিত্র্যেই সেরা ছিলেন তা নয়, তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন চাতুর্য ও বুদ্ধিমত্তার দিক থেকেও। যেকোন ব্যাটসম্যানের দুর্বলতা পড়ে ফেলতে তাঁর দুই মিনিটও সময় লাগত না। বার্নসের বোলিংয়ের একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল ‘সারপ্রাইজ অ্যাটাক’। সুযোগ বুঝে ব্যাটসম্যানের দুর্বল জায়গায় অতর্কিত আঘাত হানতেন।

জন আর্লটের মতে, ‘বার্নসের প্রতিটা ডেলিভারিই ছিল ব্যাটসম্যানকে ফাঁদে ফেলার অব্যর্থ প্রচেষ্টা, যা একটা সুনির্দিষ্ট কৌশলগত প্যাটার্ন মেনে চলত।’

বার্নস সবচেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর ছিলেন আনকভার্ড স্টিকি উইকেটে। তবে ফ্লাট উইকেটেও নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়েছেন অসংখ্যবার। দক্ষিণ আফ্রিকার কৃত্রিম ‘ম্যাটিং উইকেটে’ তিনি ছিলেন ‘লিটারেলি আনপ্লেয়েবল’!

নেভিল কার্ডাসের ভাষায়, ‘on matting, Barnes was undoubtedly the most difficult bowler ever evolved by cricket.’

একটা ব্যাপার লক্ষণীয়, বার্নসের সবগুলো ডেলিভারিই ছিল ‘ফ্রন্ট অব দ্য হ্যান্ড’ অ্যাকশনের। ‘ব্যাক অব দ্য হ্যান্ড’ অ্যাকশনে ‘গুগলি’ দিতে পারতেন না তিনি। অবশ্য তার প্রয়োজনও ছিল না। এ বিষয়ে বার্নসের ভাষ্য ছিল, ‘আমি গুগলি পারতাম না। কখনও দেয়ার চেষ্টাও করি নি।’

বার্নসের স্টক ডেলিভারি ছিল ‘মিডিয়াম পেসড লেগ ব্রেক’। যা প্রচলিত ‘আউটসুইঙ্গার’ থেকেও ভয়ঙ্কর ছিল। লেগ স্টাম্পের বাইরে পিচ করা বলকে অনায়াসে ‘টপ অব দ্য অফ স্টাম্পে’ হিট করাতে পারতেন তিনি। মাঝেমধ্যে নাকি বল এতটাই টার্ন করত যে উইকেটকিপারও নাগাল পেতেন না; সরাসরি স্লিপ ফিল্ডারের কাছে চলে যেত।

বার্নসের বলে ‘ক্লিন বোল্ড’ হওয়ার অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করতে গিয়ে ক্লেম হিল একবার বলেছিলেন, ‘The ball pitched outside my leg-stump, safe to the push off my pads, I thought. Before I could ‘pick up’ my bat, my off-stump was knocked silly.’

গতির কারণে বার্নসের স্পিনিং ‘ব্রেক’ ডেলিভারিগুলোকে ‘কাটার’ বলে রায় দিয়েছেন অনেকে। কিন্তু বার্নস তাঁর ব্রেকগুলোকে কাটার মানতে নারাজ।

৭০-৭৫ মাইল গতিতে বলে স্পিন ইমপার্ট করা খুবই কঠিন ব্যাপার। অথচ এই কাজটাই দিনের পর দিন অবলীলায় করে যেতে পারতেন বার্নস। একবার কল্পনা করুন তো, মাইক গ্যাটিংকে করা শেন ওয়ার্নের ‘শতাব্দী সেরা’ বলটা ৭০ মাইল গতিতে করলে কেমন হত?

শেষ করা যাক একটি চমকপ্রদ তথ্য দিয়ে। বার্নস তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট ম্যাচটি খেলেছেন ১৯১৪ সালে। তার ঠিক ১৪ বছর পর ১৯২৮ সালে ইংল্যান্ড সফরে আসে টেস্ট পরিবারের নবীনতম সদস্য ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বার্নসের বয়স তখন ৫৫।

আপনাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে জানি, কিন্তু বিশ্বাস করুন ওই ৫৫ বছর বয়সেই ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচ খেলতে মাঠে নেমে পড়লেন বার্নস! শুধু খেললেনই না, দলকে জেতালেনও! ১১৮ রানে নিলেন ১২ উইকেট!

অবিশ্বাসের গল্পের এখানেই শেষ নয়। ওই ঘটনার বছর দুয়েক পর দক্ষিণ আফ্রিকা এল ইংল্যান্ড সফরে। একটি প্রস্তুতি ম্যাচের প্রতিপক্ষ ছিল ওয়েলস। বার্নসও ছিলেন সে দলে। যথারীতি আরও একবার দেখালেন বুড়ো হাড়ের ভেল্কি! মাত্র ৪১ রানে ৮ উইকেট নিয়ে সাতান্ন বছরের ‘বুড়ো’ বার্নস মনে করিয়ে দিলেন ক্রিকেটের সেই অমর বাণী ‘ফর্ম ইজ টেম্পোরারি বাট ক্লাস ইজ পার্মানেন্ট!’

আসলে বার্নসের বেলায় শুধু ক্লাস না, ফর্মও ছিল পার্মানেন্ট। তাঁর সম্পর্কে বলা উচিত, ‘ফর্ম অ্যান্ড ক্লাস বোথ আর পার্মানেন্ট!’

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...