এক আহত যোদ্ধার বীরত্ব গাঁথা

ল্যারি গোমেজ আলতো চোখে তাকিয়ে দেখে অবাক হয়ে যান। তিনি লক্ষ্য করেন ভাঙা হাত নিয়েই ব্যাট হাতে ২২ গজের দিকে ছুটে আসছে মার্শাল!

১৯৮৪ সাল, হেডিংলি টেস্টের তৃতীয় দিনে মিলেছিল এক ত্যাগের দৃশ্য। এক হাতে ব্যাট করে চমকে দিয়েছিল বিশ্বকে; সেঞ্চুরি পাইয়ে দিয়েছিলো দুর্দান্ত খেলতে থাকা ল্যারি গোমেজকে। সেদিন ২২ গজে যেই আহত যোদ্ধা এক হাতে ব্যান্ডেজ আরেকহাতে ব্যাট নিয়ে নেমেছিল সে আর কেউ নয়, সে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মার্শাল ম্যালকম।

ইংল্যান্ডের হেডিংলি স্টেডিয়ামে চলছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ বনাম ইংল্যান্ডের মধ্যকার পাঁচ ম্যাচ সিরিজের তৃতীয় টেস্ট। টস জিতে ব্যাটিং করা ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বল হাতে ম্যালকমের শুরুটা হয়েছিল দুর্দান্ত। নিজের করা প্রথম ছয় ওভারে গতির ঝড় তুলে চার ওভার মেইডেন সহ মাত্র ছয় রান দিয়ে চেপে ধরেছিলেন ইংল্যান্ডের ওপেনিং জুটিকে।

কিন্তু এমন সময় প্রতিপক্ষ দলের ওপেনার ক্রিস ব্রডের ব্যাট থেকে ছুটে আসা একটি দ্রুতগতির বল ফলো থ্রুতে ফেরাতে গিয়ে নিজের বিপদ ডেকে এনেছিলেন ম্যালকম। বলের গতি এতোটাই বেশি ছিলো যে তাকে মাঠ ছেড়ে যেতে হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে পরীক্ষা করে বুড়ো আঙুলে চিড় ধরা পড়ে এই পেসারের। পরীক্ষা করে ডাক্তার জানিয়ে দিলেন আগামী ১০/১২ দিন ক্রিকেট মাঠে নামার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে!

ডাক্তারের পরামর্শ মেনে বাঁহাতে ব্যান্ডেজ করে ড্রেসিংরুমে বসে খেলা উপভোগ করতে বলা হয়েছিল তাঁকে। ইংল্যান্ডের করা ২৭০ রানকে সামনে রেখে ব্যাটিংয়ে আসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দলের অন্য ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতার দিনে একা থেকে দলকে এগিয়ে নিতে থাকেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ল্যারি গোমেজ। প্রায় একা হাতে দলকে এগিয়ে নেওয়া গোমেজ ছুটছিলেন সেঞ্চুরির দিকে, আর মাত্র ৪ রান হলেই পৌঁছে যাবে সেই কাঙ্খিত লক্ষ্যে!

কিন্তু এ কি? দলের নবম উইকেটের পতন! গোমেজ অপরাজিত ৯৬ রানে। তাহলে কি খুব কাছে এসে সেঞ্চুরি না করতে পারার আফসোস নিয়েই মাঠ ছাড়তে হবে তাঁকে? এমন ভাবনার মাঝে হুট করে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ড্রেসিং রুমে হৈচৈ শুরু হয়ে গেল।

গোমেজ আলতো চোখে তাকিয়ে দেখে অবাক হয়ে যান। তিনি লক্ষ্য করেন ভাঙা হাত নিয়েই ব্যাট হাতে ২২ গজের দিকে ছুটে আসছে মার্শাল!

‘ক্রিকেটের কণ্ঠস্বর’ খ্যাত রিচি বেনোর গলা তখন নিরুত্তাপ। কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলেন, শুধু বলছিলেন, ‘মার্শাল নামছেন হাতে প্লাস্টার নিয়ে। এই সিংহ-হৃদয়কে হয়তো তিনিও চিনতেন! চিনতে পারেনি শুধু ইংল্যান্ড।’

সেদিন মার্শালের বীরত্বে সেঞ্চুরি পেয়েছিলেন গোমেজ। ওয়েস্ট ইন্ডিজ নিজেদের প্রথম ইনিংসে লিড নিয়েছিল ৩২ রানের। তবে! সেদিন সবাইকে অবাক করেছিল মার্শালের সেই এক হাতে ব্যাট করার দৃশ্যটি।

এখানেই শেষ নয় মার্শালের বীরত্ব গাঁথা গল্পের। কারণ, এরপর যে নিজের নামটি নিয়েছিল ইতিহাসের পাতায়। সেই ভাঙা হাত নিয়েই দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছিল ইংল্যান্ডের ব্যাটিং লাইনআপ।

কি অবাক হচ্ছেন? এক হাতে ব্যান্ডেজ নিয়েও বল করবেন মার্শাল! অবাক হবারই কথা, কারণ সেদিন অবাক হয়েছিলো মাঠের অগণিত দর্শক, আর অবাক চোখে তাকিয়ে মার্শালের মাঠে নামার দৃশ্য দেখছিলো গাওয়ার বাহিনী। আহ, মার্শাল!

ডানহাতি বোলিংয়ে সেদিন বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল মার্শাল। ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ইনিংসে বাঁহাতের কনুই পর্যন্ত ব্যান্ডেজ দিয়ে পেঁচিয়ে বল হাতে একপ্রকার গতির ঝড় তুলেছিলেন ম্যালকম মার্শাল। ভাঙা হাত নিয়েই দলের পক্ষে  ২৬ ওভার হাত ঘুরিয়ে ৫৩ রান দিয়ে সাতটি উইকেট পুড়েছিলেন পকেটে।

হেডিংলির সেই টেস্টে আট উইকেটের বিশাল জয় পেয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সেদিন ম্যাচ সেরা হয়েছিলেন গোমেজ, কিন্তু সবার মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন মার্শাল। জায়গা করে নিয়েছিলেন অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েডের মনে।

ম্যাচ শেষে মার্শালের এমন বীরত্ব গাঁথা ত্যাগ নিয়ে বলতে গিয়ে লয়েড বলেছিলেন, ‘ভাঙা হাতে মার্শাল যে পারফরম্যান্স দেখিয়েছে তা আমি আমার ক্যারিয়ারে এর আগে কখনো দেখিনি। এ এক বিস্ময়কর ঘটনা! একটা ঘটনা আমার মনে থাকবে সব সময়। সবাই যখন বলছিল সে খেলতে পারবে না, তখন আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, মার্শাল তুমি খেলতে পারবে? মার্শাল হেসে জবাব দিয়েছিল, ‘অধিনায়ক তুমি যদি খেলাতে চাও আমি অবশ্যই খেলব।’

ক্রিকেট মাঠে এমন অনেক বীরত্ব গাঁথা গল্পের তৈরি হয়। কিন্তু ১৯৮৪ সালে মার্শালের এক হাতে ব্যাট আর ব্যান্ডেজ হাতে বল করার অবিশ্বাস্য সেই বীরত্ব এখন এক আহত যোদ্ধার বীরত্ব গাঁথায় পরিণত হয়েছে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...