২০০৭ বিশ্বকাপটা বাংলাদেশের এ যাবতকালের সেরা বিশ্বকাপ কিনা তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। অর্জনের দিক থেকে অনেকের কাছে হয়ত ২০১৫ বিশ্বকাপ এগিয়ে থাকবে, তবে আমার কাছে ২০০৭ বিশ্বকাপটাই সব থেকে প্রিয়। বাংলাদেশের মত দলের কাছে (যারা কিনা আগের বিশ্বকাপেই কানাডা, কেনিয়ার মত দলের কাছে হেরেছিল) এক আসরে ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকার মত দুই পরাশক্তিকে হারানোর চেয়ে বড় অর্জন আর কী হতে পারে আমার জানা নেই।
যাই হোক, সে প্রসঙ্গ থাক আপাতত। ২০০৭ বিশ্বকাপে আমাদের সেরা বোলার কে ছিল, বলুন তো? সবাই হয়ত মাশরাফি (৯ উইকেট) অথবা রাজ্জাকের (১৩ উইকেট) নাম বলবে। রাজ্জাকের সাথে রফিক (৮ উইকেট) আর সাকিব (৭ উইকেট) মিলে ‘লেফট আর্ম স্পিন ট্রায়ো’ তৈরি হওয়ায় তাদের নামগুলো প্রায় সময় একসাথেই উচ্চারিত হত। তবে একজনের নাম খুব কমই নেয় মানুষ, যিনি ছিলেন ওই টুর্নামেন্টে আমাদের আনসাং হিরো, বাঁ-হাতি পেসার সৈয়দ রাসেল। ২০০৭ বিশ্বকাপে রাসেলের উইকেট মাত্র ৮টা হলে কী হবে, বাংলাদেশের পক্ষে সেরা ইকোনমি রেটটা ছিল ওরই, মাত্র ৩.৮৫!
২০০৭ বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচটার কথাই ধরুন। ৩৮ রানে ৪ উইকেট নিয়ে মাশরাফি ম্যাচ সেরা; কিন্তু ইনিংসের শুরুতে রাসেলের টানা ১০ ওভারের দুর্দান্ত স্পেলটা (১০-২-৩১-০) ভারতকে কী পরিমাণ চাপে রেখেছিল সেটা একমাত্র তারাই বুঝবেন, যারা খেলাটা দেখেছেন।
এরপর শ্রীলঙ্কা এবং বারমুডার বিপক্ষে যথারীতি ধারাবাহিক রাসেল নেন একটি করে উইকেট। সুপার এইটে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচটা সম্ভবত ইনজুরির কারণে খেলতে পারেন নি, রাসেলের জায়গায় খেলেছিলেন তাপস বৈশ্য।
পরের ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের কাছে ৯ উইকেটের লজ্জাজনক হার। ব্ল্যাক ক্যাপ ইনিংসের একমাত্র উইকেটটা (ওপেনার পিটার ফুলটন) নিয়েছিলেন রাসেল। অন্য সব বোলার মার খেলেও টানা ৭ ওভারের স্পেলে রাসেল দিয়েছিলেন মাত্র ২২ রান। যেখানে মাশরাফি দিয়েছিলেন ৬ ওভারে ৪১, সাকিব ৩ ওভারে ৩৩, রফিক ৫ ওভারে ৩৭, রাজ্জাক ৮ ওভারে ৪৩!
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে পরের ম্যাচ। বাংলাদেশের বেঁধে দেয়া ২৫২ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে মাশরাফি-রাসেলের আটোসাঁটো বোলিংয়ে শুরু থেকেই চাপে ছিল প্রোটিয়ারা। ইনিংসের প্রথম দুটো ব্রেকথ্রুই এনে দিয়েছিলেন সৈয়দ রাসেল (২/৪১); গ্রায়েম স্মিথ আর জ্যাক ক্যালিস! উইকেট দুটোর ওজনটা শুধু বোঝার চেষ্টা করুন একবার!
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পরের ম্যাচে ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতায় বাংলাদেশ অলআউট মাত্র ১৪৩ রানে। জবাব দিতে নেমে শুরুতেই ইংল্যান্ডের দুই টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান অ্যান্ড্রু স্ট্রাউস আর ইয়ান বেলকে ফিরিয়ে দেন সৈয়দ রাসেল! লাইন-লেন্থ আর সুইংয়ের অনুপম প্রদর্শনী দেখিয়ে টানা ১০ ওভারের স্পেলে রান খরচ করেন মাত্র ২৫! শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ হেরেছিল চার উইকেটে।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে পরের ম্যাচেও রাসেল নেন ১ উইকেট। আইরিশদের বিপক্ষে শেষ ম্যাচটায় সম্ভবত বিশ্রামে রাখা হয়েছিল রাসেলকে। তাঁর জায়গায় সুযোগ দেয়া হয় ডানহাতি পেসার শাহাদাত হোসেনকে। বাংলাদেশও হেরে গিয়েছিল ম্যাচটা।
২০০৭ বিশ্বকাপ বাদেও রাসেলের ছোট্ট ক্যারিয়ারে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পারফরমেন্স আছে, যেগুলোর কথা না বললেই নয়। যেমন ২০০৬ সালে বগুড়ায় শ্রীলঙ্কাকে হারানো ম্যাচটির কথাই ধরুন। ১০ ওভারের স্পেলে মাত্র ২৮ রান খরচায় রাসেল নিয়েছিলেন ২ উইকেট, কুমার সাঙ্গাকারার ‘মূল্যবান’ উইকেটসহ। লো-স্কোরিং ম্যাচে রাসেলের ইম্প্যাক্ট বুঝতে হলে জেনে রাখুন, পুরো খেলায় ব্যবহৃত ১২ জন বোলারের মধ্যে রাসেলের ইকোনমি রেটই ছিল সবচেয়ে কম।
২০০৮ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মিরপুরে প্রথম ওয়ানডে জেতার পর দ্বিতীয় ওয়ানডেতেও জেতার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন রাসেল। দুর্দান্ত এক ওপেনিং স্পেলে তিনি তুলে নিয়েছিলেন ম্যাককালাম, রাইডার আর জিমি হাউয়ের উইকেট। ১০ ওভার বোলিং করে ৪টি মেডেনসহ মাত্র ২৩ রানে ৩ উইকেট! শেষ পর্যন্ত যদিও আমরা ম্যাচটা হেরেছিলাম।
জোহানেসবার্গ, ২০০৭। ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টি’র উদ্বোধনী আসরে বাংলাদেশের উইন্ডিজ বধের অন্যতম নায়ক ছিলেন সৈয়দ রাসেল। ইনিংসের প্রথম ওভারেই আগের ম্যাচের ‘সেঞ্চুরিয়ান’ ক্রিস গেইলকে ০ রানে ফিরিয়ে দিয়ে মূল আঘাতটা কিন্তু রাসেলই হেনেছিলেন। কেবল এতেই ক্ষান্ত হন নি তিনি, ৪ ওভারের বিরতিহীন স্পেলে রান দিয়েছিলেন মাত্র ১০; ইকোনমি রেট ২.৫০!