ক্রিকেট সম্বন্ধে আমার আগ্রহ যে রেটে বাড়ছিল তাতে আর প্রীতম বা স্কুলের বন্ধুরা যোগান দিয়ে উঠতে পারছিল না। আমি এবার খবরের কাগজের শেষের পাতায় মন দিলাম। আজকাল পত্রিকার শ্রী অশোক দাশগুপ্ত মহাশয় আমার ট্রেনিঙের ভার নিলেন। আর সঙ্গে ছোটবেলার প্রিয় সঙ্গী ‘আনন্দমেলা’ তো ছিলই। সেই সঙ্গে বাজার করার টাকা মেরে মাঝে মধ্যে ‘খেলা’ আর ‘স্পোর্টস স্টার’ নামের পত্রিকাও নেওয়া শুরু করলাম।
ভারত বিশ্বকাপ জেতার কিছুদিন পরই হৈহৈ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দল ভারতে এল। কিছুদিন আগেই নাকি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে কপিলরা ‘প্রতিজ্ঞা’ করেছে যে তারা ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে গতবারের হারের বদলা নেবে। এটাও নতুন। এতদিন জানতাম প্রতিজ্ঞা ট্রতিজ্ঞা ভীষ্ম, অর্জুন, ভীম, কর্ণ ইত্যাদির মত মহারথীরাই করে থাকে। তারপরই ভাবলাম কপিলই বা ওইসব মহারথীর চেয়ে কম কিসের?
মাঠে অবশ্য দেখা গেল প্রতিজ্ঞা শুধু কপিলই করে নি, গ্রিনিজ, হেইন্স, রিচার্ডস, লয়েড, মার্শাল, হোল্ডিং সহ পুরো ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলটাই প্রতিশোধের জন্য খুঙ্খার হয়ে আছে। শুধু রিচার্ডসই যা একটু মিইয়ে ছিল সেই সিরিজে – অন্তত ওর নিজের ষ্ট্যান্ডার্ডে।
কানপুরে পুরোপুরি ধরাশায়ী হল ভারত, গ্রিনিজ একাই ১৯৪ হাঁকাল। তবে খবরের কাগজ পড়ে জানলাম সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপারটা নাকি ম্যালকম মার্শাল নামের এক ফাস্ট বোলার ঘটিয়েছে। ওর বলের দাপটে পৃথিবীর সবচেয়ে নামকরা ওপেনিং ব্যাটসম্যানের হাত থেকে ছিটকে গেছে ব্যাট! পুরো ভারত মিইয়ে পড়ল খবরটা পড়ে।
তখনও সুনীল গাভাস্কারকে তেমন চিনি না। পত্র পত্রিকায় ওনার কয়েকটা রেকর্ডের কথা পড়েছিলাম বটে কিন্তু ওয়ার্ল্ড কাপে একদমই সুবিধে করতে পারেননি ভদ্রলোক। পরের টেস্টেই অবশ্য নিজের পুরো নাম ঘোষণা করলেন সুনীল মনোহর গাভাস্কার। তবে সেই প্রসঙ্গে পরে আসবো।
সেই সিরিজে আমাদের পরিচয় হল ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেস ব্যাটারির সঙ্গে। পুরোভাগে অবশ্যই মার্শাল। তবে ওনাকে টি ভিতে দেখে বেশ হতাশই হলাম। পেস বোলারদের স্ট্যান্ডার্ডে বেশ ছোটখাটো শরীর। ভিভ রিচার্ডসের শরীরও তেমন দশাসই ছিল না কিন্তু তাতে পেশীর আস্ফালন যথেষ্ট থাকায় ওর শক্তি সম্বন্ধে কোন সন্দেহ থাকত না কারও মনে। সেই সঙ্গে রাজকীয় চাল চলন। মার্শাল অন্যদিকে দেখতে বেশ নরম সরম, বডি ল্যাঙ্গুয়েজে অ্যাগ্রেসিভ নয়। কিন্তু সেই আপাত নিরীহ মানুষটিই বল হাতে পৃথিবীর প্রায় সব নামকরা ব্যাটসম্যানেরই ত্রাস হয়ে দাঁড়াতেন।
প্রচণ্ড জোরে কোনাকুনি ছুটে এসে ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে ডান কানের পাশ দিয়ে বৃত্তাকার পথে ঘুরে মার্শালের হাত থেকে মিসাইলের গতিতে বলগুলি বেরিয়ে আসতো। অ্যাকশন চেস্ট অন হলেও দু দিকেই স্যুইং এবং কাট করানোর ক্ষমতা ছিল ওনার। অবশ্য সেই সিরিজে মূলত গতির ওপর নির্ভর করেই ভারত বধ করেন মার্শাল, অন্যান্য অস্ত্রগুলির প্রয়োজন ওনার পড়ে গতি একটু কমে আসার পর। নিজে তাঁর অ্যাকশন নকল করতে গিয়ে দেখেছি তাতে বলের স্পিড বাড়লেও, অসম্ভব চাপ পড়ে কাঁধের ওপর।
কোন কারণে আমাদের দিলিপ ভেংসরকারের ওপর খাপ্পা ছিলেন মার্শাল। যতদূর মনে পড়ছে দিলিপ সম্ভবত অত্যাধিক আপিল করে একবার আম্পায়ারকে বাধ্য করেন তাঁকে ভুল আউট দিতে। এর ফলটা ভালো হয়নি দিলিপ আর ভারতের পক্ষে। ভেংসরকার ব্যাট করতে নাবলেই নিজের সবকিছু উজাড় করে তাঁর প্রাণ অতিষ্ঠ করে ছাড়তেন মার্শাল। এমনিতে ভেংসরকার মূলত ফ্রন্ট ফুট প্লেয়ার ছিলেন, অসম্ভব দৃষ্টিনন্দন ছিল তার ড্রাইভগুলি। কিন্তু শর্ট বলের বিরুদ্ধে বেশ বিপর্যস্ত বোধ করতেন তিনি, তুলনায় অনেকটা সৌরভেরই মতো অনেক স্বচ্ছন্দ ছিলেন স্যুইং খেলায়। ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ভেংসরকারকেই সবচেয়ে বেশি বার আউট করেন মার্শাল – ১০ বার।
সেই সিরিজে সহনায়কের ভুমিকায় ছিলেন মাইকেল হোল্ডিং। তাঁর বোলিং অ্যাকশনের সৌন্দর্য্য প্রবাদপ্রতিম – হোল্ডিংকে ফাস্ট বোলারদের মধ্যে ‘রোলস রয়েস’ নামে চিহ্নিত করা হয় তাঁর মসৃণ রান আপ আর একশনের জন্যে। একসময় ওনারও গতিও ছিল ভয়াবহ, ওনার অন্য নিকনেম – ‘হুইস্পারিং ডেথ’ তাঁর ভয়াবহতার সাক্ষ্য বহন করে। তবে ১৯৮৩ সিরিজের হোল্ডিঙের বলে সেই গতি ছিল না। তবু ৬ টেস্টের সিরিজে ৩০ উইকেট নিয়ে ভারত বধের অন্যতম কারিগর ছিলেন এই হোল্ডিং।
এই দুজন ছাড়াও ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৭০/৮০ দশকের ভয়ঙ্কর পেস আক্রমনের অংশ ছিলেন অ্যান্ডি রবার্টস আর জোয়েল গারনার। রবার্টসকে দিয়েই এই স্বর্ণযুগের আরম্ভ – তারপর ওঁর সঙ্গে যোগ দেন ভয়ঙ্কর গতির হোল্ডিং আর মার্শাল। ভারতের শিল্পী ব্যাটসম্যান গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ আর অ্যান্ডি রবার্টসের মধ্যে ১৯৭৪/৭৫ সিরিজের দ্বৈরথ আজ ক্রিকেটের কিংবদন্তী। শেষ পর্যন্ত ওয়েস্ট ইন্ডিজ জিতলেও মাদ্রাজে সবুজ উইকেটে ভিশির খেলা ৯৭ রানের ইনিংসটিকে সর্বকালের ১০০ সেরা ইনিংসের সম্মান দেয় উইজডেন। সুনীল গাভাস্কার নিজের ‘আইডলস’ নামের বইয়ে ভূয়সী প্রশংসা করেন রবার্টসের, ওনাকে ডেনিস লিলির ঠিক পরেই স্থান দেন শ্রেষ্ঠ ফাস্ট বোলারদের মধ্যে। এই সেদিন ইউ টিউবেও দেখলাম ইয়ান বোথাম, ডেনিস লিলি আর অ্যান্ডি রবার্টসকে তাঁর দেখা শ্রেষ্ঠ ফাস্ট বোলার হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
জোয়েল গারনারের গতি অন্যদের তুলনায় একটু কম হলেও ওনার ৬ ফুট ৮ ইঞ্চির উচ্চতাকে ব্যাবহার করে উনি ব্যাটসম্যানদের খুবই অসুবিধেয় ফেলতেন। আর সেই সঙ্গে ছিল কাঁটার মতো নিখুঁত লেন্থ আর লাইন। বিশেষ করে একদিনের ক্রিকেটে ওনার বলে রান করার মতো কঠিন কাজ বিশ্ব ক্রিকেটে খুব বেশি ছিল না। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ একদিনের দলে উনি প্রায় অটোম্যাটিক চয়েস।
যে সময়টার কথা বলছি, অর্থাৎ ৭০ দশকের শেষ আর ৮০র দশকের আরম্ভ, সেটা ছিল ফাস্ট বোলারদের স্বর্ণযুগ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেস ব্যাটারি ছাড়াও তখন ক্রিকেট দুনিয়া দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল অস্ট্রেলিয়ার লিলি ও টমসন, পাকিস্তানের ইমরান ও সরফরাজ, ইংল্যান্ডের উইলিস, স্নো ও বথাম, ভারতের কপিল আর নিউজিল্যান্ডের রিচার্ড হ্যাডলি।
এঁদের মধ্যে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে যে কোন একজন কে সেরা নির্বাচিত করা প্রায় অসম্ভব। কাকে ছেড়ে কার কথা বলবো?
ডেনিস লিলিকে অনেকেই সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাস্ট বোলারের শিরোপা দিয়ে থাকেন। যেমন আগুনে গতি, তেমনই দর্শনীয় রান আপ আর একশন। পরের দিকে বলের ওপর লিলির নিয়ন্ত্রণও ছিল অসাধারন। সব মিলিয়ে লিলি ছিলেন কমপ্লিট ফাস্ট বোলার। লিলি – টমসনের বোলিং কম্বিনেশানকেও সর্বকালের অন্যতম ভয়াবহ কম্বিনেশান বলা যেতে পারে। অস্ট্রেলিয়ার কঠিন উইকেটে প্রায়ই দেখা যেত রডনি মার্শ নিজের মাথার ওপর ওদের বল গ্যাদার করছেন।
মিডিয়ম পেসার হিসেবে শুরু করলেও আশির দশকের আরম্ভে ইমরান খান বিশ্বের অন্যতম সেরা ফাস্ট বোলার হয়ে ওঠেন তাঁর গতি, বাউন্স আর পুরনো বলে রিভার্স স্যুইং ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে। এই সময়ে ওনার বোলিং একশনেরও পরিবর্তন হয় – ক্রিজের কোনা থেকে ছোঁড়া ওনার বিখ্যাত ‘ইন ডিপার’ (নামটা সম্ভবত রিচি বেনোর দেওয়া – দ্য বিগ বানানা ইন্স্যুইঙ্গার) যে কোন ব্যাটসম্যানের বুকে কাঁপুনি ধরিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। একমাত্র সুনীল গাভাস্কর আর মহিন্দার অমরনাথ ছাড়া ভারতের কোন ব্যাটসম্যানই ওঁর বলে সেই সময় স্বচ্ছন্দ বোধ করেন নি।
ইমরানের যদি ইন স্যুইং বিখ্যাত ছিল, আমাদের কপিল বিখ্যাত ছিলেন তাঁর আউট স্যুইং-এর জন্যে। পরে অবশ্য অফ কাটার এবং ইন স্যুইংএও পারদর্শী হয়ে ওঠেন কপিল। তবে ভারতের মরা পিচে মোটামুটি একাই বোলিঙের বোঝা টানতে টানতে নিজের গতি অনেকটাই কমিয়ে ফেলতে তিনি বাধ্য হন পরের দিকে। স্পোর্টিং উইকেট আর অন্য প্রান্ত থেকে অল্প সাহায্য পেলে কপিল যে কোন উচ্চতায় পৌঁছতে পারতেন সেটা জল্পনার বিষয়।
১৯৮৩/৮৪ তে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে কপিল অসাধারন বল করে ২৯ টি উইকেট নেন উইকেট প্রতি মার্শালের চেয়েও কম রান দিয়ে। মার্শাল, হোল্ডিংরা ভারতের ১১টা ইনিংসে বল করার সুযোগ পান, কপিল ১০টা। আর যে ব্যাটিং লাইন আপের বিরুদ্ধে কপিলের উইকেটগুলি আসে তার পুরোভাগে ছিলেন গ্রিনিজ, হেইন্স, ভিভ, লয়েড, গোমস, ডুজনের মতো ব্যাটসম্যান, ভারতের চেয়ে অনেকটাই বেশি মজবুদ।
আর ছিলেন রিচার্ড হ্যাডলি – সিম আর স্যুইং বোলিংয়ের সুলতান। যেমন অব্যর্থ লক্ষ, তেমনই বলের কাজ। পরের দিকে বলের স্পিড অনেকটা কমিয়ে ফেলে ছোট্ট রান আপ নিয়ে বল করলেও ওনার বল স্বচ্ছন্দে খেলতে কাউকে দেখি নি বললেই চলে। কপিলেরই মতো হ্যাডলিও একাই টেনে নিয়ে যেতেন নিউজিল্যান্ডের বোলিং আক্রমন – তবে ওনার গড় এবং স্ট্রাইক রেট ছিল কপিলের তুলনায় অনেকটাই ভাল। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে উনি নিজের বেশীরভাগ ক্রিকেটই ফাস্ট বোলিং সহায়ক পিচে খেলেছেন।
ক্যারিয়রের শুরুর দিকে লিলির মডেলে নিজেকে তৈরি করলেও, শেষের পাঁচ ছয় বছর হ্যাডলির বোলিং ছিল সম্পূর্ণ নিজস্ব চিন্তাভাবনার ফসল। যতটা প্রয়োজন তার থেকে একফোঁটাও এক্সট্রা শক্তি খরচ করতেন না হ্যাডলি। আর তার সঙ্গে ওনার ছিল প্রত্যেকটি ব্যাটসম্যানের দুর্বলতা বুঝে সেই অংশে একনাগাড়ে আঘাত করে যাওয়ার ক্ষমতা।
এঁদের মধ্যে আমার মতে সেরা তিন বোলার ছিলেন লিলি, মার্শাল এবং হ্যাডলি। তবে এই তিনজনের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ এই বিচারে আমি যাবো না। তিনজনেরই পক্ষে অনেক পয়েন্ট আছে – কোন পয়েন্টকে কতটা গুরুত্ব দেবেন সেটা ব্যাক্তিগত পছন্দের ব্যাপার। পিক ফর্মের লিলি পিক ফর্মের হ্যাডলির চেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর ছিলেন, দর্শনীয়ও। অন্যদিকে হ্যাডলির ধারবাহিকতা এবং উপমহাদেশের উইকেটে সাফল্য লিলির চেয়ে বেশি।
মার্শাল এই দু’জনের মাঝামাঝি জায়গায় রয়েছেন – একদিকে যেমন তার ছিল ভয়ঙ্কর গতি, তেমনই সারা ক্যারিয়র জুড়েই প্রায় তিনি ধারাবাহিক ভাবে সাফল্য পেয়ে এসেছেন। এই তিনজনের মধ্যে টেস্ট প্রতি উইকেট হ্যাডলি আর লিলির বেশি হলেও (পাঁচের সামান্য বেশি), বোলিং গড় সবচেয়ে ভালো ছিল মার্শালের। সুখের কথা এই যে এই তিন ঘাতকেরই প্রচুর ভিডিও ইউ টিউবে আছে – ক্রিকেট প্রেমীরা এদের স্ট্যাটিস্টিকস আর ভিডিও দেখে তুলনা করে দেখতে পারেন।