দ্য ব্লাাক প্যান্থার

রাশিয়ার তো বটেই, বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম সেরা গোলকিপার ছিলেন লেভ ইয়াসিন। এছাড়াও সোভিয়েত ইতিহাসের অন্যতম জনপ্রিয় ফুটবলার ছিলেন লেভ ইয়াসিন। শুধু এটাই নয়, আধুনিক গোলকিপিংয়ের শুরুও লেভ ইয়াসিনের হাত ধরেই। তাঁর ট্রেড মার্ক ছিলো কালো ড্রেস।

বিশাল সবুজ মাঠ।

মাঠ জুড়ে ফুটবলারদের ছোটাছুটি। গোলপোস্টের দিকে বল নিয়ে ছুটছেন কেউ একজন। কিন্তু সামনে তাকিয়েই শিড়দাড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেলো; পোস্টের নিচে আপাদমস্তক কালো পোশাক সাটা একটা চিতা।

হ্যা, তিনি ব্লাক প্যান্থার। ব্লাক অক্টোপাস বা ব্লাক স্পাইডার। তিনি লেভ ইভানোভিচ ইয়াসিন। সর্বকালের সেরা গোলরক্ষক লেভ ইয়াসিন।

রাশিয়ার তো বটেই, বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম সেরা গোলকিপার ছিলেন লেভ ইয়াসিন। এছাড়াও সোভিয়েত ইতিহাসের অন্যতম জনপ্রিয় ফুটবলার ছিলেন লেভ ইয়াসিন। শুধু এটাই নয়, আধুনিক গোলকিপিংয়ের শুরুও লেভ ইয়াসিনের হাত ধরেই। তাঁর ট্রেড মার্ক ছিলো কালো ড্রেস।

লেভ ইয়াসিনের জন্ম ১৯২৯ সালে রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে।  যখন তাঁর বয়স মাত্র ১২ বছর তখন তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন যোগ দেয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তাকে জোর করে মিলিটারি ফ্যাক্টরিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যদিও সে ছিলেন একজন দূর্দান্ত আইস হকি এবং ফুটবল খেলোয়াড় তারপরও এখানে কাজ করার ফলে তিনি খেলার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।

এই সময়ে তাঁর ফ্যাক্টরির সহকর্মীরা তাকে মিলিটারি সার্ভিসে যোগ দানের কথা বলেন, যাতে তিনি খেলতে পারেন। সহকর্মীদের পরামর্শমত মিলিটারিতে যোগ দেন লেভ ইয়াসিন। এখানে যোগ দিয়ে আবারো খেলার প্রতি মনোযোগ ফিরে পান। মিলিটারিতে খেলার সময় মাত্র ১৮ বছর বয়সে ডায়নামো মস্কো যুব দলের কোচ আরকার্ডি শেরনিশভের চোখে পড়েন লেভ ইয়াশিন।

লেভ ইয়াসিন বেশ প্রতিভাবান গোলকিপার হিসেবে ১৯৫০ সালে যোগ দেন ডায়নামো মস্কোতে। কিন্তু প্রথমে দলে সুযোগ পেতে বেশ কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হয় তাকে। ক্লাব কিংবদন্তি অ্যালেক্সি খোমিখের কারণে ক্লাবে সুযোগ পাচ্ছিলেন না। দলে নিয়মিত সুযোগ না পেয়ে তিনি ফুটবল ছেড়ে আইস হকি খেলার সিদ্ধান্ত নেন। কিছুদিন ডায়নামো মস্কো ছেড়ে  আইস হকি খেলতে যান। আইস হকিতে ১৯৫৩ সালে ইউএসএসআর কাপ জয় করেন।

একই বছর কিংবদন্তি গোলকিপার খোমিখ ইনজুরিতে পড়েন। এর ফলে ডায়নামো মস্কোতে আবারো ফিরে আসেন লেভ ইয়াসিন। খোমিখের ইনজুরিরি কারণে দলে  নিয়মিত হতে শুরু করেন। এর পরে আর পিছনে ফিরে থাকাতে হয়নি। ক্লাবে নিয়মিত পারফর্ম করার ফলে সহজেই সুযোগ পান সোভিয়েত ইউনিয়ন জাতীয় দলে। লেভ ইয়াসিনের অভিষেক ম্যাচে সুইডেনকে ৭-০ গোলে হারায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। জাতীয় দলে ভালো পারফর্ম করার পাশাপাশি ক্লাবের হয়েও বিভিন্ন শিরোপা জিতে যান।

ডায়নামো মস্কোর হয়ে ১৯৫৪, ১৯৫৫ এবং ১৯৫৭ সালে জিতেন লিগ শিরোপা। এছাড়াও ১৯৫৬ অলিম্পিকে সোভিয়েত ফুটবল দলের অধিনায়ক হিসেবে সোনা জিতেন তিনি।

১৯৫৬ সালের অলিম্পিকের পরই খ্যাতি পাওয়া শুরু করেন লেভ ইয়াসিন। ১৯৫৮ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের দূর্দান্ত পারফর্মেন্সের কারণে তাকে ফুটবল বিশ্ব চিনে নেয়। দূর্দান্ত গোলকিপিং, ডি-বক্সের ভিতর রাখা দূর্দান্ত পারফর্ম এবং খেলা বুঝতে পারার অসম্ভব ভালো ক্ষমতার কারণে ইয়াসিন এগিয়ে ছিলেন অন্যান্য সব ফুটবলারের থেকে। তাঁর এই দূর্দান্ত সক্ষমতার কারণে ফুটবল বোদ্ধারা তাকে এগিয়ে রাখতে এক মুহুর্তও দেরি করেননি।

লেভ ইয়াসিনের সেরা বিশ্বকাপ ম্যাচ ছিলো ১৯৫৮ সালে ব্রাজিলের বিপক্ষে ম্যাচ। এই ম্যাচে ব্রাজিলের নেতৃত্বে ছিলেন ফুটবল কিংবদন্তি গারিঞ্চা এবং দূর্দান্ত পারফর্ম করেছেন ১৭ বছর বয়সী পেলে। এই ম্যাচে ব্রাজিলের কাছে ২-০ গোলে হেরেছিলো । কিন্তু এই ম্যাচে ব্রাজিলের জন্য গোল করা ছিলো সবচেয়ে কঠিন একটি কাজ। অনেক কষ্টার্জিত জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে ব্রাজিল। ব্রাজিলের বিপক্ষে এই ম্যাচ হারলেও ম্যাচে দূর্দান্ত পারফর্ম করেছিলেন লেভ ইয়াসিন। এই বিশ্বকাপে সুইডেনে কাছে হেরে কোয়াটার ফাইনাল থেকে বিদায় নেয় লেভ ইয়াসিনের সোভিয়েত ইউনিয়ন। কোয়াটার ফাইনাল থেকে দল বাদ পড়লেও বিশ্বকাপের সেরা গোলকিপার হিসেবে নির্বাচিত হন লেভ ইয়াসিন।

তাঁর সময়ের কিংবা তাঁর আগের কোনো গোলকিপার এতো ভালো কোনো অবস্থায় ছিলেন না। লেভ ইয়াসিন জানতেন তিনি কি কাজ করতে মাঠে নেমেছেন। তিনি তাঁর পজিশন, সাহস এবং সক্ষমতার জন্য বেশ পরিচিত ছিলেন। তাকে ভেদ করে গোল করা ছিলো যেকোনো স্ট্রাইকারের জন্য বেশ কঠিন এক কাজ। লেভ ইয়াসিন প্রথম দিককার একজন গোলকিপার যিনি কিনা গোলবারের নিচ থেকে উচ্চস্বরে দলকে উৎসাহ দিতেন।

১৯৫৯ সালে ডায়নামো মস্কোকে আরেকটি লিগ শিরোপা এনে দেন। এছাড়াও ১৯৬০ সালে জেতেন ইউরোপিয়ান নেশন্স কাপের শিরোপা। এরপরেই তাঁর ক্যারিয়ারের অবনমন শুরু হয়। ১৯৬২ সালের বিশ্বকাপে কলম্বিয়ার বিপক্ষে শিশুসূল্ভ কিছু ভুল করে বসেন তিনি। যার ফলে নির্ধারিত সময়ে ৪-৪ গোলে ড্র করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। এরপর কোয়াটার ফাইনালে চিলির বিপক্ষে ২-১ গোলে হেরে আবারো কোয়াটার ফাইনাল থেকে বিদায় নেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন।

খারাপ পারফর্মেন্সের পরও জাতীয় দলে সুযোগ পান লেভ ইয়াসিন। ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপে প্রথম পর্বের দুই ম্যাচে ইনজুরির কারণে মাঠে নামতে পারেননি তিনি। ইনজুরি থেকে ফিরে সোভিয়েত ইউনিয়নের হয়ে দূর্দান্ত পারফর্ম করতে শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপে চতুর্থ অবস্থান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের। এটাই এখন পর্যন্ত রাশিয়া তথা সোভিয়েত ইউনিয়নের বিশ্বকাপ ইতিহাসের সেরা অর্জন। এই বিশ্বকাপে লেভ ইয়াসিন শুধু একজন খেলোয়াড় নন, ছিলেন সহকারী কোচ।

ফুটবলকে বিদায় জানানোর পর দুই দশক ছিলেন ডায়নামো মস্কো ক্লাবের বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্বে।  কিন্তু এখানে থাকাকালীন সময়ে ক্লাবের চেয়ারম্যান পিটার বোগডানভের সাথে বিভিন্ন ইস্যুতে সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে। এর ফলে তাঁর পরবর্তী জীবন ভীষণ কষ্টকর হয়ে উঠে। লেভ ইয়াসিন দেশ ছাড়তে চাইলেও তাকে এবং তার স্ত্রীকে ভিসা দিতে বাঁধা দান করেছিলেন ডায়নামো মস্কোর চেয়ারম্যান।

লেভ ইয়াসিন একমাত্র গোলকিপার যিনি কিনা ব্যালন ডি অর জিতেছিলেন। লেভ তাঁর ক্যারিয়ারে ১৫১ টি পেনাল্টি শট ঠিকেছিলেন এবং ২৭০ ম্যাচে ক্লিন শীট রেখেছিলেন। এছাড়াও ১৯৮৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ বেসামরিক সন্মাননা অর্ডার অফ লেনিন পান।

১৯৯০ সালে পরলোক গমন করেন লেভ ইয়াসিন। তিনি ছিলেন আধুনিক ফুটবলের অন্যতম সেরা গোলকিপার।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...