টেস্ট ক্রিকেট ইজ বেস্ট ক্রিকেট!

টেস্ট ক্রিকেটের একটা বৈশিষ্ট্য বলি।

১.

২০১৫ সালের ভারত বনাম দক্ষিণ আফ্রিকার বিখ্যাত ব্লকেথন সিরিজের তৃতীয় টেস্টের কথা। ডু প্লেসিস আর আমলা টেস্ট বাঁচানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। বল যাই আসুক, ব্লক চলছে। আগের ২৫ ওভারে কোন বাউন্ডারি হয় নাই।

এই অবস্থায় অমিত মিশরা একটা শর্ট বল দিলেন। অফ স্ট্যাম্পের বাইরে সেই হাফ ভলি এতোটাই ডলি ছিল যে ডু প্লেসিস বাধ্য হলেন নিজের খোলস ছেড়ে বের হতে। কাভার দিয়ে চার হলো। এই বাজে বলের আসল উদ্দেশ্য ডুপ্লেসিসকে খোলস থেকে বের করা। এই যে এতক্ষণ ধরে পা সামনে নিয়ে ডু প্লেসিস ব্লক করে যাচ্ছিলেন সেই মনঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটলো। ডু প্লেসিসও একটু মারার কনফিডেন্স পেলেন। দুই বল পরেই অমিত মিশ্র আরেকটা শর্ট কুইকার দিলেন। এবারেরটা মিডল স্টাম্পে।

আগের ১৫০ বল ধরে ব্লক করতে থাকা ডুপ্লেসিস মাত্রই দুই বল আগে হাত খোলার রাশ এনেছেন নিজের শরীরে। এবারও লোভ সামলাতে পারলেন না। পুল করতে গেলেন। মিস করে হলেন বোল্ড!

২.

এবার পরের টেস্টের কথা। এবারও দক্ষিণ আফ্রিকা টেস্ট বাঁচাতে লড়ছে। ১১৭ ওভারে তাঁদের রান ১০৫! (হ্যাঁ, ১১৭ ওভারে ১০৫ রান!) ফাফ ডু প্লেসিস ৮৭ বলে ৫ রানে অপরাজিত। জাদেজা টানা ১৬ ওভার মেডেন দিয়েছেন। এবার তিনি টোপ ফেললেন অফ স্ট্যাম্পের বাইরে ড্রাইভ করতে দিয়ে। হঠাৎ ডু প্লেসিসের ধৈর্যচ্যুতি ঘটলো। ড্রাইভ করে চার মেরে দিলেন। ব্লকের মানসিকতা থেকে নড়লেন ফাফ। পরের ওভারে কোহলি শর্ট লেগ থেকে ফিল্ডার সরিয়ে দিলেন। জাদেজার বলও পায়ে দুইটা শর্ট, ওদিকে ফিল্ডারও নাই। দক্ষিণ আফ্রিকা টানা দুই বলে দুই রান নিয়ে নিলো। ক্রিকইনফোর কমেন্ট্রি বলছিলো, ‘Jadeja bleeding runs now.’

পরের বলেই মিডল স্টাম্পে জাদেজার আর্মার। মাত্রই খোলস ছাড়া ফাফ ডু প্লেসিসের কনসেন্ট্রেশনে আঘাত আসলো। হলেন এলবিডাব্লিউ! ব্লকেথনের সমাপ্তি।

৩.

ম্যানচেস্টার টেস্ট। ইংল্যান্ডের অফ স্পিনার ডম বেস সামনে বল করে যাচ্ছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের শেষ ভরসা হিসেবে আছেন জেসন হোল্ডার, আর অন্যদিকে কেমার রোচ একদম কপিবুক ডিফেন্স করে যাচ্ছেন। খেলার বাকি আরও ২৫ ওভার। কিন্তু যদি ওয়েস্ট ইন্ডিজকে এই টেস্ট বাঁচাতে হয় তাহলে হোল্ডারই শেষ ভরসা!

শেষ বাধা হোল্ডারকে অফ স্ট্যাম্পের বাইরে ফুলটস দিলেন ডম বেস। ফুলটস পেয়ে হোল্ডারের ড্রাইভে চার, তারপরের বলে আবারও ঝুলিয়ে দিলেন বেস, এবারে হোল্ডার এক পা সামনে নিয়ে উড়িয়ে দিলেন। ছক্কা!

হোল্ডারের মনোযোগে বাঁধা আসলো চার-ছক্কা দিয়ে! দুই বল পরে ক্লাসিক অফ স্ট্যাম্প টার্ন বেসের! এবারে আর সামনে ব্লক করতে দেননি, একটু খাটো করে দিয়েছেন। কারণ হোল্ডারের ডিফেন্স এখন ওপেন। ব্যাট-পায়ের মাঝখান দিয়ে বোল্ড জেসন হোল্ডার! শেষ আশাটুকু শেষ ক্যারিবিয়ানদের!

এই জিনিস অন্য ক্রিকেটে পাবেন না, স্লগ ওভারে পাবেন না। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে এক ওভারে অনেকগুলো রান দেয়া মানে আসলেই ক্ষতি, টেস্ট ক্রিকেটে এক ওভারে বেশী রান দেয়া বেশিরভাগ সময়েই বোলারের প্ল্যান। আপনাকে জানতে হবে, টানা অফ স্ট্যাম্পের বাইরে বল করলেও ঠিক কী জন্যে বোলিং অধিনায়ক ফাইন লেগে একটা ফিল্ডার দাঁড় করিয়ে রেখেছেন, অথচ কাভারে কোন ফিল্ডার নাই কেন? টেস্ট ক্রিকেট এইসব ক্যালকুলেশনের খেলা, ব্যাটসম্যানদের জন্যও এই স্ট্র্যাটেজি বোঝাটাই বড় চ্যালেঞ্জ!

কেউ যখন জিজ্ঞেস করে টেস্ট ক্রিকেট কেন সেরা, তখন আমি এই প্ল্যানের কথা বলি। টেস্ট ক্রিকেটে একটা আউট দেখতে হলে আপনাকে শুধু আউটের ডেলিভারিটা দেখলেই হবে না। শেন ওয়ার্নের দুই ওভার বোলিং দেখলে আপনি বুঝতে পারবেন ওয়ার্ন ১২ নাম্বার বলটাতে আউট করবার জন্য কিভাবে আগের ২ ওভার ধরে পরিকল্পনা সাজিয়েছেন। ম্যাকগ্রা ওভারের প্রথম পাঁচ বলে কিভাবে ব্যাটসম্যান সেট আপ দিয়েছেন সেটা মন দিয়ে না দেখতে পারলে ছয় নম্বর ডেলিভারিতে আউটের মর্মটা আপনি বুঝতে পারবেন না!

টেস্ট ক্রিকেট ইজ বেস্ট ক্রিকেট! পিরিয়ড!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link