সাদা পোশাকের সেই প্রথম দিন!

ভেম্বরের সেই দিনে জেমস লিলি হোয়াইটের নেতৃত্বে ইংল্যান্ডের সেই দলটা যখন অস্ট্রেলিয়া সফরে গেল, ততক্ষণে ইতিহাস তৈরি হয়ে গেছে। সেটিই যে ছিল আমন্ত্রণমূলক সফর ছাড়া প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটের প্রথম কোন সাদা পোশাকের সিরিজের সফর!

ইংল্যান্ড এখন হামেশাই অস্ট্রেলিয়া সফরে যায়।

তা যাক! কিন্তু, সেই দিনটার মত যাওয়া তো আর কোনদিনও যেতে পারবে না। আর পারবেই বা কি করে? নভেম্বরের সেই দিনে জেমস লিলি হোয়াইটের নেতৃত্বে ইংল্যান্ডের সেই দলটা যখন অস্ট্রেলিয়া সফরে গেল, ততক্ষণে ইতিহাস তৈরি হয়ে গেছে। সেটিই যে ছিল আমন্ত্রণমূলক সফর ছাড়া প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটের প্রথম কোন সাদা পোশাকের সিরিজের সফর!

লিলিহোয়াইটের ইংল্যান্ডের সেই দলটা ছিল নবীন-প্রবীণ এক সূত্রে গাঁথা। তবে সেই স্কোয়াড তৈরিরও একটা নীতিমালা ছিল। সেই সফরে ইংল্যান্ড তাদেরকেই বাছাই করেছিল যারা আক্ষরিক অর্থেই ক্রিকেটটা পেশাদারভাবে খেলতে চায়। তখন তো ক্রিকেটের যুগ আসেনি, খেলাটাও সবাই সমান গুরুত্বের সাথে নিত না। তাই নিখাদ ‘অ্যামেচার’ যারা ছিল তাদের সবাইকে ইংল্যান্ড রেখে গেল টেমস নদীর পাড়েই। সেই স্কোয়াড নির্বাচনে আরেকটা বিষয়ও জরুরী ছিল আর সেটা হল অভিজ্ঞতা।

লিলিহোয়াইটের সেই দলের বোলিং অ্যাটাক ছিল দুর্দান্ত, ব্যাটিং লাইন আপ ছিল বোলিং অ্যাটাকের মানের চাইতে একটু কম- কিন্তু বিশেষে স্কোয়াড ছিল মাত্র ১২ জনের!  তা ইংল্যান্ডের স্কোয়াডে এত কম লোক থাকলেও অস্ট্রেলিয়া কিন্তু ঘরের মাঠের টেস্টেও স্কোয়াড দিয়েছিল ঢের বেশি লোকের, তা প্রায় ২২ জনের মত! অবশ্য সে সময় অস্ট্রেলিয়া ইংল্যান্ডের তুলনায় এতটা শক্তিশালী ছিল না, সেটা এই বহরের একটা কারণ হতে পারে।

এবার একটা মজার তথ্য দেওয়া যাক। আগেই তো বলা হয়েছে ইংল্যান্ডের এই দলটা ছিল বারো জনের, তা সত্ত্বেও অস্ট্রেলিয়াতে গেছিল কিন্তু মাত্র ১১ জনের একটা দল। কেন? অস্ট্রেলিয়া সফর করার আগে প্রস্তুতিমূলক ম্যাচ খেলতে ইংল্যান্ড সেবার গেছিল নিউজিল্যান্ড। সেই নিউজিল্যান্ডে গিয়েই ইংল্যান্ড দলের উইকেটরক্ষক টেড পুলি জুয়াবৃত্তিতে ধরা পড়ে ক্রাইস্টচার্চের জেলে বন্দী হন। অগত্যা ইংল্যান্ডকে তাই তাসমানপাড় ছাড়তে হয় একজনকে ছাড়াই, ঠিক ১১ জন নিয়ে!

কিন্তু এই ১১ জন নিয়েই ম্যাচের আগে বিপাকে পড়ে যায় ইংল্যান্ড। টেড পুলি ছাড়া না পেলে উইকেটকিপিং করার কথা যার, সেই ব্যাকআপ উইকেটরক্ষক হ্যারি জুপ চোখের ইনফ্লামেশনে ভুগছিলেন। এদিকে দলে আর কোন ব্যাকআপ উইকেটরক্ষকও ছিল না। শেষে আর কোন উপায়ন্তর না পেয়ে অবশ্য জুপকেই গ্লাভস হাতে নামতে হয়েছিল।

অস্ট্রেলিয়া দলেও কিন্তু ম্যাচের আগে সমস্যার অভাব ছিল না। অস্ট্রেলিয়া দলের সে সময়ের নামী পেসার ছিলেন ফেড স্পফোর্থ। নামী হওয়ার কারণে দলে স্পফোর্থের দাপটও ছিল একজন সাধারণ পেসারের চাইতে কিছুটা বেশিই। সেই দাপটের জেরেই হয়তো, তিনি উইকেটরক্ষক হিসেবে দলে চাইছিলেন বিলি মারডচকে। কিন্তু এ যাত্রায় যখন নির্বাচকেরা স্পফোর্থের কথা শুনলেন না, তখন স্পফোর্থ ম্যাচে নামতেই অস্বীকৃতি জানালেন। ব্যাস, অস্ট্রেলিয়া পড়ে গেল দোলাচলে। পরে অবশ্য ইংল্যান্ডের মত অস্ট্রেলিয়াও এ ঝড় সামাল দিতে পেরেছিল, স্পফোর্থের বদলি হিসেবে তাঁরা খেলিয়েছিল ফ্রাংক অ্যালেনকে।

  •  ১৫ মার্চ, ১৮৭৬। টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম দিন।

ঘড়ির কাঁটা কেবল একটা পেড়িয়েছে। এমসিজি এর মাঝেই দর্শকে ভরতে শুরু করেছে। যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে তখনই এমসিজিতে আছে প্রায় পনেরশো দর্শক। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম সে বলটা সেদিন করেছিলেন আলফ্রেড শ, ক্রিজে সেই বল ব্যাট হাতে মোকাবেলা করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার চার্লস ব্যানারম্যান। প্রথম বল তো হল, এবার প্রথম রানের পালা। তা সেটা আসতেও সময় লাগেনি। ম্যাচের মাত্র দ্বিতীয় বলেই তা নিয়ে ইতিহাসের পাতায় ঢুকে গেছিলেন ব্যানারম্যান।

তবে প্রথম ওভারেই যেমন ঝটপট রান এসে গেল, উইকেট নেওয়ার ক্ষেত্রে এতটা তাড়াহুড়া কিন্তু দেখা যায়। সাদা পোশাকের ইতিহাসে প্রথম ম্যাচের প্রথম উইকেট পেতে ইংলিশ বোলারদের টানা বল করে যেতে হয়েছে একেবারে চতুর্থ ওভার অব্দি, যতক্ষণ না অ্যালেন হিল ন্যাট থম্পসনের স্ট্যাম্প ভেঙে দেন! এত কিছু যখন বলাই হল, শূন্য রানে প্রথম আউট হওয়া ব্যাটসম্যানের নামটা না বললে ষোলকলা পূর্ণ হচ্ছে না। ‘ডাক’ পাওয়া সেই ব্যাটসম্যানের নাম এডওয়ার্ড গ্রেগরি।

দুর্দান্ত এই ম্যাচ যখন এমসিজিতে চলছে, আস্তে আস্তে তখন লোক ভিড়তে শুরু করেছে স্টেডিয়ামে। এখনকার প্রাসাদোপম এমসিজি দেখে হয়ত আপনার বিস্ময়ে চোখ ছানাবড়া হতে পারে, কিন্তু সে সময় এমসিজির ধারণক্ষমতা ছিল টেনেটুনে মাত্র দুই হাজার। সেই দুই হাজার ধারণ ক্ষমতার এমসিজিতে সেদিন লোক হয়ে গেছিল সাড়ে চার হাজার। যারা আগে এসেছিলেন তাঁরা স্ট্যান্ডে জায়গা পেয়ে বসেছেনই, কিন্তু যারা পরে এসেছেন তাদের কেউ বসেছে নিচে, কেউ কেউ তো আবার মাঠের পাশেই ঘাসের ওপর বসে দেখতে শুরু করেছিলেন ঐতিহাসিক এই ক্রিকেট ম্যাচ!

নানা ঘটনায় থাকা এই টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম দিন শেষ হয়েছিল ঠিক বিকাল পাঁচটায়। অস্ট্রেলিয়ার সেই পড়ন্ত বিকালে গ্লাভস খুলে যখন প্যাভিলিয়নে যাচ্ছেন,তখন ব্যানারম্যান হয়ে গেছেন রেকর্ড বয়। প্রথম দিনেই ১৬৬ বলে ১২৬ রানের ইনিংস খেলে বনে গেছেন টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম সেঞ্চুরিয়ন।

ব্যানারম্যান তো দিন শেষ করলেন সেঞ্চুরিতে, কিন্তু দলগুলো? সেটারও আয়োজন ছিল। ম্যাচের প্রথম দিন শেষে ক্লান্ত দুই দল সেদিনের সন্ধ্যাটা কাটিয়েছিল অপেরাতে!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...