চিত্তানন্দের দ্বৈরথ

১৯৭৮ থেকে ১৯৮২ অবধি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অলরাউন্ডারের দৌঁড় ছিল মোটামুটি এই দুই ঘোড়ার মধ্যেই সীমিত। এই দুজনের মধ্যে একে অপরকে ছাপিয়ে যাওয়ার লড়াই ক্রিকেট বিশ্ব প্রথম দেখতে পায় ১৯৮১-৮২ সালের ভারত আর ইংল্যান্ডের মধ্যে পরপর দুই সিরিজে।

প্রথমটা ছয় টেস্টের সিরিজ ভারতের মাটিতে, পরেরটা তিন টেস্টের সিরিজ ইংল্যান্ডে। দুটো দেশের ক্রিকেট যুদ্ধের চেয়েও সেই সময় ক্রিকেট প্রেমীদের কাছে বেশি আকর্ষণীয় ছিল এই দুই মহান ক্রিকেটারের দ্বৈরথ।

ভারতের মাটিতে ১৯৮১-৮২র সিরিজ আরম্ভ হওয়ার ঠিক আগেই ঐতিহাসিক ‘অ্যাশেজ’ জিতে ফেলেছে ইংল্যান্ড। ক্রিকেট প্রেমীদের স্মরণ থাকবে যে এই সিরিজকে ‘বোথামের অ্যাশেজ’ও বলা হয়। যেভাবে এক হাতে ইয়ান বোথাম এই সিরিজের ভাগ্য পরিবর্তন করেছিলেন তার নজির বিশ্ব ক্রিকেটে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ব্যাট হাতে প্রায় চারশ রান করেন বোথাম সেই সিরিজে, সেই সঙ্গে নেন ৩৪টি উইকেটও।

ভারতের মাটিতে খেলা সিরিজে ব্যাট হাতে আরও বিধ্বংসী হয়ে ওঠেন বোথাম। কপিল দেব সহ ভারতের সব বোলারকেই যথেচ্ছ পিটিয়ে সংগ্রহ করে ৪৪০ রান (১ টি সেঞ্চুরি, ৪ টি হাফ সেঞ্চুরি), গড় ৫৫। তুলনায় তিনি বল হাতে কিঞ্চিৎ নিষ্প্রভ ছিলেন। প্রায় ৩৯ গড়ে ১৭টি উইকেট দখল করেন তিনি। সব মিলিয়ে অতিমানবীয় পারফরম্যান্স।

এবার কপিলের পালা। ব্যাট হাতে তিনিও যে কিছু কম যান না সেটা কপিল প্রমাণ করেন ৩১৮ রান করে, গড় ৫৩। তবে কপিলের ব্যাটিঙের আরও একটা লক্ষণীয় বিষয় ছিল তার দুর্দান্ত স্ট্রাইক রেট – ৮৮, বথামের ৬২র চেয়ে বেশ খানিকটা বেশি। বোঝা গেল বোথাম যদি ঝড় হন তো কপিল হচ্ছেন হ্যারিকেন।

সেই সঙ্গে বল হাতে কপিলের ঝুলিতে জমা পড়ে ২২টি ব্রিটিশ উইকেট, উইকেট পিছু প্রায় ৩৮ রান দিয়ে। দুইজনেই একে অপরকে দুবার আউট করেন।

মুম্বাইয়ের প্রথম টেস্ট জিতে ভারত ১-০ ব্যাবধানে সিরিজ জিতে নেয়। আর সেই টেস্টে ব্যাটে – বলে দুরন্ত পারফর্ম করে ম্যাচ সেরাও হন কপিল। সুতরাং এই সিরিজে বোথামকে টেক্কা দেন কপিল। সিরিজ সেরাও কপিলই হন।

কয়েক মাস পরেই ভারত এবার ইংল্যান্ডে তিন টেস্টের সিরিজ খেলতে যায়। এবার লড়াই খোদ সিংহের গুহার মধ্যে সিংহের বিরুদ্ধে।

বথাম মুখিয়ে ছিলেন বদলা নেওয়ার জন্যে। নিলেনও। মাত্র তিন টেস্টের সিরিজে একটি ডাবল সেঞ্চুরি এবং একটি সেঞ্চুরি হাঁকালেন। মোট রান ৪০৩। ব্র্যাডম্যানকেও গর্বিত করার মতো গড় – ১৩৪। বোলিংয়ে আবার কিঞ্চিৎ নিষ্প্রভ, ৩৫এর ওপরের গড়ে মোট ৯ উইকেট।

তবে কপিলও যে নেহাত সাইট সিয়িং করতে যান নি তার প্রমাণ তিনি সারা সিরিজ জুড়েই দিলেন। মোট ২৯২ রান করেন কপিল, গড় ৭৩। তার এবারের স্ট্রাইক রেট দেখে চোখ বড়বড় হয়ে গেল সাহেবদের – ১০৭। তখনকার দিনে তো বটেই, এখনও টেস্টে এই ধরনের মারকাটারি ব্যাটিং দেখা দুর্লভ। তবে বোথামের মতো কপিলও বল হাতে তেমন সুবিধে করতে পারেন নি। সিরিজে তার সংগ্রহ মোট দশ উইকেট, গড় ৪৪। বোথাম এবং কপিল – দুজনেই একটা টেস্টে ম্যাচ সেরাও হন। এবং এবার সিরিজে জয়লাভ করে ইংল্যান্ড, ব্যাবধান সেই ১-০।

যদিও আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে এবার বোথাম কপিলের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন, কিন্তু এই সিরিজেও সিরিজ সেরা সেই কপিলই হন। বিচারকদের যুক্তি কপিলের পারফর্মেন্স অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী দলের বিরুদ্ধে এসেছে। যুক্তিটা হয়ত খারাপ নয়, কিন্তু তার মধ্যেও ব্রিটিশদের উঁচু নাকের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছিলেন অনেকেই।

তবে তাঁদের এই নাক আর বেশিদিন থাকবে না। কারণ কিছুদিন পরেই ১৯৮৩’র বিশ্বকাপ। সেখানে শুধু নিজের প্রাক্তন প্রভুদেরই নয়, কপিলের ভারত ধরাশায়ী করবে ইতিহাসের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্রিকেট দলকেও। সেই বিশ্বকাপেই ভারত – ইংল্যান্ড সেমিফাইনালের ম্যাচে খোদ ইংল্যান্ডের মাঠে দেখা গেল সেই বিখ্যাত পোস্টার – ‘কপিল ইটস থ্রি বোথামস ফর ব্রেকফাস্ট!’

সুতরাং প্রথমের কয়েক বছর চারজনের মধ্যে বথাম এগিয়ে থাকলেও ১৯৮২-৮৩ থেকে কপিলদেব তাকে পেছনে ফেলে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ অলরাউণ্ডার হওয়ার লক্ষে বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু কাজটা সহজ হবে না কারণ ততদিনে আরও দুই প্রতিদ্বন্দ্বীও নিজেদের তৈরি করে ফেলেছেন এই লড়াইয়ের যোগ দেওয়ার জন্যে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link