ক্ষণিক তারার আলোক বিস্ফোরণ

ঝর্ণার ক্রমশ বহমান পানিতে ডুবে স্নান করবার ইচ্ছে, শেষকালে দেখা গেল কেবল এক সরু জলাধার। কেমন লাগবে?

সুবিশাল এক পর্বত চড়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে গিয়ে যদি এক রত্তি মরুভূমির দেখা মেলে তবে কেমন লাগবে? আবার ধরুণ এক বিস্তির্ণ সবুজের সমারোহ দেখবার আপনার খায়েশ। কিন্তু গিয়ে দেখলেন ফেঁটে চৌচির হয়ে যাওয়া এক জনপদ। কেমন লাগবে? ঝর্ণার ক্রমশ বহমান পানিতে ডুবে স্নান করবার ইচ্ছে, শেষকালে দেখা গেল কেবল এক সরু জলাধার। কেমন লাগবে?

ঠিক এমন করেই বিশ্ব ক্রিকেটের উজ্জ্বল নক্ষত্র হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে আগমন ঘটেছে প্রায় প্রতিটা খেলোয়াড়ের। কেউ হয়েছেন কিংবদন্তি কেউ আবার চলে গিয়েছেন অন্ধকারের আড়ালে। সম্ভাবনার প্রদীপটা ক্রমেই যেন জ্বালানি সংকটে ভুগে এক প্রকার নিভেই গিয়েছে। এমন কিছু ক্রিকেটারদের নিয়েই থাকছে আজকের আলোচনা।

  • মার্ক রামপ্রকাশ (ইংল্যান্ড)  

মার্ক রামপ্রকাশ, দৃষ্টিনন্দন ব্যাটিং প্রদর্শনের অন্যতম এক পারফর্মার। তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ারটাকে ঠিক দুই ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমভাগে তিনি ছিলেন ইংল্যান্ডের টেস্ট দলের খেলোয়াড়। সেটার সময়কাল ছিল ১৯৯১ থেকে ২০০২। এই সময় তিনি ইংল্যান্ডের হয়ে টেস্ট খেলেছেন ৫২টি। ২৭.৩২ গড়ে তিনি রান করেছেন দুই হাজার তিনশোর কাছাকাছি।

নিন্দার ঝড় সয়ে তিনি ছেড়ে গেলেন ইংল্যান্ড জাতীয় দল। তবে চাপা একটা ক্ষোভ নিশ্চয়ই তাঁর মধ্যে ছিল। তিনি সে ক্ষোভ থেকেই নিজের প্রথম শ্রেণি ক্রিকেটটা রাঙিয়ে গিয়েছেন। ইংল্যান্ডের কাউন্টি ক্রিকেটে তিনি প্রমাণ করে গিয়েছেন যে ঠিক তিনি কতটা সামর্থ্যবান একজন ব্যাটার ছিলেন। প্রথম শ্রেণি ক্রিকেটটা তিনি শেষ করেছেন একশটি শতক হাঁকিয়ে। ক্রিকেট ইতিহাসের ২৫ তম ব্যাটার হিসেবে সে কীর্তি গড়ে তুলে রেখেছিলেন নিজের প্যাডজোরা।

এমন একজন ব্যাটার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আলো ছড়াতে হয়েছেন ব্যর্থ। ইংল্যান্ডের সমৃদ্ধশালী একটা ক্রিকেট ইতিহাসে রামপ্রকাশ ছিলেন বড্ড বেশি ফ্যাকাসে।

  • শন টেইট (অস্ট্রেলিয়া)

অস্ট্রেলিয়ার মত পরাক্রমশীল দলের মুখপাত্র একটা লম্বা সময় ধরে ছিলেন শেন ওয়ার্ন। কিংবদন্তি এই স্পিনারের ঘূর্ণি জাদু সব সময়ই সমর্থকদের আনন্দ দিয়েছে। তবে অজি ভক্তদের মনে তাঁদের পেসারদের জন্য সব সময়ই একটা আলাদা জায়গা ছিল। সে জায়গাটাই একটা সময় দখল করার সুযোগ এসেছিল শন টেইটের কাছে। তবে তিনি সে জায়গাটা যেন নিতে পারেননি। অথবা বলে যায় তাঁকে নিতে দেওয়া হয়নি।

এর পেছনে অবশ্য প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছিল ইনজুরি। খেলোয়াড়দের জীবনের সবচেয়ে বড় ঘাতক ইনজুরিই একটা অমিত সম্ভাবনাকে আটকে রাখে অদৃশ্য এক জালে। অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দলে খুব একটা সুযোগ তাঁর কখনোই মেলেনি। সেই ইনজুরির ভয়াল থাঁবা তাঁকে ঘরোয়া ক্রিকেটেও খুব একটা বিস্তার ঘটাতে দেয়নি। তিনি বরং ইনজুরির সাথে পাল্লা দিয়ে যেটুকু সময় পেয়েছেন বাইশ গজে আগুন ঝড়িয়েছেন। তবে একটা লম্বা সময় ধরে তাঁকে দেখার আক্ষেপটা নিশ্চয়ই রয়ে গেছে।

  • ওয়াসিম রাজা (পাকিস্তান)

নিজের প্রতিভার কদর সবাই আসলে করতে পারে না। তেমনই একজন পাকিস্তানের ওয়াসিম রাজা। তাঁর বিষয়ে ইমরান খান একবার বলেছিলেন যে তিনি নাকি ন্যাচারাল ক্রিকেটারদের একজন ছিলেন। শহীদ আফ্রিদির আগে বোলারদের মনে ভয় ধরানো ব্যাটারদের একজন হিসেবেই বিবেচিত হতেন ওয়াসিম রাজা। বাইশ গজে নেমেই বোলারদের তুলোধুনো করতে তিনি ছিলেন ওস্তাদ।

তিনি প্রচণ্ডরকম আত্মকেন্দ্রিক ছিলেন। তবে ক্রিকেট মাঠে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো এক যোদ্ধা। তিনি তাঁর ক্যারিয়ারটা হয়ত আরও খানিকটা সুসজ্জিত করতে পারতেন। ক্রিজে নামার সাথে সাথেই তিনি চাইতেন বলকে মাঠ ছাড়া করতে। প্রতিপক্ষ বোলারদের শাসন করতে। তবে সে বিষয়টাই তাঁকে উজ্জ্বলতম নক্ষত্র হতে বাঁধা দিয়েছে। তিনি কোন এক বিচ্ছিন্ন বিস্ময় হয়েই রয়ে গেলেন পাকিস্তানের ক্রিকেট ইতিহাসে।

  • অজয় শর্মা (ভারত)

নির্ভয়ী এক যোদ্ধাই যেন ছিলেন অজয় শর্মা। ভারতের বাঘা বাঘা বোলারদের বিপক্ষে খুব একটা হেলমেট পড়ে খেলতে নামার বিষয়ে তিনি আগ্রহী ছিলেন না। বরং তিনি বিশ্বাসটা রাখতেন নিজের সামর্থ্যের উপর, নিজের প্রতিভার উপর। ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটে তিনি রান তুলেছেন প্রায় ৬৫ এর উপরে। দুর্ধর্ষ এক ব্যাটার ছিলেন তিনি। বাইশ গজে একটা আধিপত্য বিস্তার করতে পারতেন।

তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিনি খেই হারিয়ে ফেলেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর শুরুটা হয় বেশ নড়বড়ে। সে নড়বড়ে শুরুটা আর থিতু হওয়ার সুযোগই পায়নি। মাত্র এক টেস্ট খেলেছেন তিনি ভারতের হয়ে। অথচ ঘরোয়া প্রথম শ্রেণি ক্রিকেটে তিনি রান করেছেন প্রায় দশ হাজারের বেশি। এমন একজন খেলোয়াড় ক্রিকেটের সর্বোচ্চ পর্যায়ে বড্ড বেশি মলিন হয়েই একটা আক্ষেপ রেখে গেলেন।

  • মোহাম্মদ আশরাফুল (বাংলাদেশ)

উদীয়মান বাংলাদেশ ক্রিকেটের ‘আশার ফুল’ হিসেবে ফুঁটেছিলেন আশরাফুল। বাংলাদেশের প্রথম ‘পোস্টার বয়’। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিনি বরাবরই লাল-সবুজের একটা ছাপ ফেলে রেখে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। বাংলাদেশের ক্রিকেটকে দক্ষ নাবিক হিসেবে তারই তো কথা ছিল একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। তিনি সে কাজটাই করছিলেন। তবে মাঝপথে হয় ছন্দপতন।

লোভ বড়ই খারাপ। লোভে পাপ, আর পাপে মৃত্যু। ঠিক মরণফাঁদে পড়েছেন আশরাফুল তা নয়। তবে তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ারটা একপ্রকার সমাধিস্থই বলা চলে। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে ফিক্সিংয়ের অভিযোগ থেকে নিষেধাজ্ঞা।

এরপর অতলে হারিয়ে যাওয়া। তিনি প্রতিভাবান ছিলেন তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে নিজের লোলুপ দৃষ্টি সংবরণ করতে না পারার খেসারতটাই দিয়েছেন আশরাফুল, এখনও দিচ্ছেন।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...