সব গল্পের শেষটা সুন্দর হয় না

ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো আর নেইমার জুনিয়র – দুই মহাতারকার জন্মতারিখ জানা আছে? না থাকলেও সমস্যা নেই; দুই দেশের দুই সুপারস্টারই জন্ম নিয়েছিলেন ৫ই ফেব্রুয়ারিতে। শুধু জন্মতারিখ নয়, কাতার বিশ্বকাপের ফলাফলও একসূত্রে বেঁধেছে রোনালদো আর নেইমারকে।

বিশ্বমঞ্চে ধ্রুপদী লড়াইয়ের মাঝপথেই দুজনকে বিদায় বার্তা পাঠিয়েছেন ফুটবল বিধাতা। তাই তো চব্বিশ ঘন্টার ব্যবধানে নেইমার আর রোনালদো দুজনেরই মুখ নীল হয়েছে বেদনায়।

ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই ফুটবলারের বয়স এখন ৩৭। স্বাভাবিকভাবেই ২০২৬ সালের বিশ্বকাপে মাঠে নামা হবে না তাঁর। মধ্যপ্রাচ্যে আয়োজিত বিশ্বকাপকেই তাই নিজের বিশ্বকাপ স্বপ্ন পূরণের শেষ সুযোগ ভেবেই এসেছিলেন তিনি। কিন্তু সোনালী ট্রফি ছোঁয়ার অপূর্ণ ইচ্ছে নিয়েই ফিরে যেতে হবে পর্তুগিজ তারকাকে; বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারেই থেকে যাবে এই অপূর্ণতাটুকু।

অন্যদিকে নেইমার জুনিয়র তো ফুটবলের দু:খী রাজপুত্র। বারবার ইনজুরির শিকার নেইমার নিজের প্রতিভার অনেক কিছু মাঠে দেখাতে পারেননি। নিজের এমন ঘন ঘন ইনজুরির ঘটনায় তিনি নিজেই বিরক্ত, এবারের বিশ্বকাপ শুরুর আগে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে বলেই দিয়েছিলেন, এবারের বিশ্বকাপটাই হয়তো তাঁর শেষ বিশ্ব আসর। কিন্তু শেষটা রাঙিয়ে রাখতে পারেননি নেইমার জুনিয়র।

অথচ কি দারুণ শুরুটাই না করেছিল ব্রাজিল আর পর্তুগাল। নিজেদের প্রথম ম্যাচ থেকেই দুই দল ছিল দারুণ ছন্দে; দুই ম্যাচ খেলেই নিশ্চিত করেছিল শেষ ষোলোর টিকিট। আবার তৃতীয় ম্যাচে বেঞ্চের শক্তি পরীক্ষা করতে গিয়ে হারের মুখ দেখলেও গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে পরের রাউন্ডে উঠতে সমস্যা হয়নি পর্তুগাল এবং ব্রাজিলের৷

সেখানে আরো বিধ্বংসী তারা; দক্ষিণ কোরিয়া আর সুইজারল্যান্ডের সাথে ছেলেখেলা করেই কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত করে এই দুইদল।

কোয়ার্টার ফাইনালেও গল্পটা প্রায় একই। ব্রাজিলের মুখোমুখি হয় গতবারের ফাইনালিস্ট ক্রোয়েশিয়া, নির্ধারিত নব্বই মিনিট গোলশূন্য ড্রতে নিষ্পন্ন হলে খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে, সেটিও ১-১ গোলে সমতায় শেষ হলে টাইব্রেকার নামক ভাগ্যপরীক্ষায় নামতে হয় ব্রাজিল আর ক্রোয়েশিয়াকে, তবে ভাগ্যদেবী সেসময় মুখ তুলে তাকাননি সেলেসাওদের দিকে। অবশ্য ক্রোয়েশিয়ার গোলরক্ষকের লিভাকোভিচের কৃতিত্বও সেখানে কম নয়।

অন্যদিকে পর্তুগালকে কোন সুযোগই দেয়নি টুর্নামেন্টের ডার্ক হর্স মরক্কো। নিঁখুত ডিফেন্ডিংয়ের সাথে দুর্দান্ত কাউন্টার এটাকের পসরা সাজিয়ে পর্তুগিজদের থামিয়ে দিয়েছে আরব দেশটি। শেষপর্যন্ত ১-০ গোলে জিতে প্রথম আফ্রিকান দেশ হিসেবে সেমিফাইনালে জায়গা করে নেয় জিয়েচ-হাকিমিরা। সেই সাথে স্বপ্নযাত্রার ইতি ঘটে রোনালদো, ব্রুনো ফার্নান্দেজদের।

ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স বিবেচনায় অবশ্য নেইমার আর রোনালদোর অবস্থান দুই মেরুতে। ইনজুরির কারণে দুই ম্যাচ খেলতে না পারলেও নেইমার ছিলেন দলীয় আক্রমণভাগের প্রাণভোমরা। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ম্যাচেও নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন এই পিএসজি তারকা।

অন্যদিকে রোনালদোর খেলায় ছিল বয়সের ছাপ, পর্তুগালের উদ্বোধনী ম্যাচে প্লেয়ার অব দ্য ম্যাচের পুরষ্কার জিতলেও গ্রুপ পর্বের বাকি দুই ম্যাচেই ছিলেন নিষ্প্রাণ। নক আউট ম্যাচে তাই শুরুর একাদশে জায়গাও হারিয়েছেন।

২০০৬ সাল থেকে প্রায় গড়পড়তা পর্তুগাল দলকে একাই টেনে নিয়েছিলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো; তাঁর কাঁধে ভর করেই টানা পঞ্চমবারের মত বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেয়েছে তারা। অথচ রোনালদোর আগমনের পূর্বে মাত্র দুইবার বিশ্ব আসরে নাম লিখিয়েছিল ইউরোপের দেশটি। তবে বিশ্বকাপ জেতা আর হয়নি রোনালদোর। চোখের জল আর বিশ্বকাপ জয়ের তীব্র ইচ্ছে লুকিয়েই ছেড়েছেন মাঠ।

ইনজুরির সাথে লড়াই করতে থাকা নেইমারও হেরেছেন বারবার। ২০১৪ সালে মারকানা ট্র্যাজেড়ি দেখেছেন মাঠের বাইরে থেকে, ২০১৮ সালে বেলজিয়ামের সাথে সর্বোচ্চ নিংড়ে দিয়েও পারেননি দলকে একধাপ এগিয়ে নিতে। এবারও একই চিত্রই দেখা মিলেছে, শুধু বদলেছে স্থান আর সময়।

ক্লাব ফুটবলের সম্ভাব্য সব ট্রফি, ব্যালন ডি’অর, বেস্ট প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার, গোল্ডেন বুট সহ সবকিছু জেতা হয়েছে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর। ফুটবল ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলের মালিকের তাই নতুন করে প্রমাণের কিছু নেই, ফুটবলের জন্য যা করেছেন তিনি তাতে সোনালী ট্রফিতে একটা চুমু আঁকার সুযোগ তাঁর প্রাপ্যই ছিল। আর পায়ের জাদুতে প্রজন্মের সব ফুটবলভক্তকে মোহিত করা সময়ের অন্যতম সেরা ফুটবলার নেইমার বিশ্বকাপ ট্রফির ছোঁয়া পেতেই পারতেন।

ফুটবল দেবতা নাকি কারও পাওনা বাকি রাখেন না। গত শতকের শেষ দিক থেকে সুনিপুণ ফুটবল খেলতে থাকা স্পেনের প্রাপ্য মিটিয়েছেন ২০০৮ ইউরো আর ২০১০ বিশ্বকাপের শিরোপা উপহার দিয়ে। ডিয়েগো ম্যারাডোনার বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারকে পূর্ণতা দিয়েছেন ১৯৮৬ বিশ্বকাপের মুকুট পরিয়ে।

আবার ফুটবলেই প্রাপ্য বাকি থেকে যাওয়ার গল্পও আছে। ইউসেবিও আর ইয়োহান ক্রুইফের কখনো বিশ্বকাপ না-জেতা কিংবা ডি স্টেফানো বা জর্জ বেস্টের মতো ফুটবলারদের কখনো বিশ্বকাপ খেলতে না পারা সেসব গল্পের এক একটা অংশ। নেইমার জুনিয়র, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোরাও হয়তো অপ্রাপ্তির বেদনাতুর গল্পের একটা অংশ হয়েই বিদায় নিলেন।

পর্তুগাল আজ হেরেছে, আগামীকাল হয়তো জিতে যাবে; একই কথা বলা যায় ব্রাজিলের জন্যও। জোয়াও ফেলিক্স, রাফায়েল লিও, ভিনিসিয়ুস জুনিয়র, অ্যান্টনি, রিচার্লিসনরা বয়সের সাথে আরো পরিপক্ক হয়ে উঠবেন। আগামী আসরগুলোতে তাই শিরোপা জিতলেও জিততে পারে তারা।

কিন্তু সেসময় থাকবেন না ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, হয়তো নাও দেখা যেতে পারে নেইমার জুনিয়রকে। তাইতো ফুটবলীয় মহাযজ্ঞের আকাশ থেকে দুই তারার এমন পতন ভক্তদের হৃদয়ে ক্ষত সৃষ্টি করেছে, আর এই ক্ষত থেকে যাবে অনেকটা সময়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link