কথায় বলে, রেকর্ড গড়া হয় ভাঙার জন্য। কিন্তু ক্রিকেট ইতিহাসে এমন কিছু রেকর্ড আছে যা ভাঙা এককথায় অসম্ভব। ১৯৫৬ সালের জুলাইতে, ওল্ড ট্র্যাফোর্ড টেস্টে ঠিক সেরকমই একটি রেকর্ডের সাক্ষী হয়েছিল ক্রিকেট বিশ্ব।
টেস্ট ইতিহাসের ‘প্রথম’ বোলার হিসেবে এক ইনিংসে ১০ উইকেট (দ্বিতীয় ইনিংসে ৫৩/১০) নিয়েছিলেন জিম লেকার; প্রথম ইনিংসে নয়টি সহ একাই শিকার করেন ১৯ উইকেট।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ডানহাতি এই অফ স্পিনারের ৯০ রানে ১৯ উইকেট প্রাপ্তির ‘অনন্য’ রেকর্ডটি টেস্ট ক্রিকেট তো বটেই; বরং ফার্স্ট ক্লাস ইতিহাসেও সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড! এক ম্যাচে ১৯ উইকেট তো দুরের কথা, ১৭ উইকেটের বেশিই কেউ নিতে পারেনি কখনও!
১৯৪৮ থেকে ১৯৫৯ পর্যন্ত খেলা ৪৬টি টেস্ট ম্যাচে তাঁর শিকার ২১.২৪ গড়ে ১৯৩ উইকেট। টেস্টে কমপক্ষে ১৫০ উইকেট পেয়েছেন এমন স্পিনারদের মধ্যে সেরা বোলিং গড়ের রেকর্ডটি (২১.২৪) জিম লেকারের দখলে।
টেস্টের মত তাঁর প্রথম শ্রেণীর ক্যারিয়ারটাও বেশ উজ্জ্বল। কাউন্টি দল এসেক্স ও সারের হয়ে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট খেলেছেন টানা ১৮ বছর।
প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে মাত্র ১৮.৪ গড়ে নিয়েছেন ১৯৪৪ উইকেট! এক মৌসুমে ১০০ এর বেশি উইকেট নিয়েছেন ১১ বার। ১৯৫২ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত টানা ৭ বার কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতেছেন সারের হয়ে।
ওল্ড ট্র্যাফোর্ড টেস্টে লেকারের অতিমানবীয় কীর্তির কথা তো প্রায় সবারই জানা। কিন্তু তিনি যে এর আগেও একবার ইনিংসে ১০ উইকেট নিয়েছিলেন সেটা হয়ত অনেকের কাছেই অজানা।
কাকতালীয় হলেও সত্যি, ‘প্রিয় প্রতিপক্ষ’ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে একই সিরিজের একটি প্রস্তুতি ম্যাচে ইনিংসে ১০ উইকেট নিয়েছিলেন লেকার, তবে সেটা ইংল্যান্ডের হয়ে নয়; কাউন্টি দল সারের হয়ে। ওভালে অনুষ্ঠিত সেই ম্যাচের প্রথম ইনিংসে লেকারের বোলিং ফিগার ছিল ৮৮/১০।
জিম লেকারের টেস্ট ক্যারিয়ারকে দুটো প্রধান অধ্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে। ১৯৫৬ অ্যাশেজের আগের ৮ বছরকে প্রথম অধ্যায় এবং ১৯৫৬ অ্যাশেজ পরবর্তী সময়কালকে দ্বিতীয় অধ্যায়। প্রথম অধ্যায়ের তুলনায় দ্বিতীয় অধ্যায়ের পরিসংখ্যানও অনেক বেশি সমৃদ্ধ।
- ১৯৫৬ অ্যাশেজ পূর্ববর্তী: ২৪ ম্যাচে ৮৬ উইকেট, বোলিং গড় ২৭.৮৬, ইনিংসে ৫ উইকেট ৩ বার
- ১৯৫৬ অ্যাশেজ পরবর্তী: ২২ ম্যাচে ১০৭ উইকেট, বোলিং গড় ১৫.৯৩, ইনিংসে ৫ উইকেট ৬ বার।
জিম লেকারের টেস্ট অভিষেক হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে, ১৯৪৮ সালে বারবাডোজের কেনসিংটন ওভালে। অভিষেক ইনিংসেই ৭ উইকেট নিয়েছিলেন তিনি। যার মধ্যে ৬টা উইকেটই এসেছিল এক স্পেলে, দ্বিতীয় দিন সকালের সেশনে মাত্র ২৫ রানের বিনিময়ে।
তলপেটের মাংসপেশিতে ব্যথার কারণে অভিষেক সিরিজে পুরোপুরি ফিট ছিলেন না লেকার। তবুও সিরিজ শেষে দেখা যায়, ১৮ উইকেট নিয়ে ইংলিশদের পক্ষে সেরা বোলার তিনিই।
বাঁহাতি স্পিনার টনি লকের সাথে একটা সফল ‘স্পিন জুটি’ গড়ে তুলেছিলেন জিম লেকার। ৪৯ টেস্টে ১৭৪ উইকেটের মালিক টনি লক ছিলেন সেযুগের সফলতম স্পিনারদের একজন।
সেযুগের আরও অনেক স্পিনারের মত লেকারের ক্যারিয়ারটাও শুরু হয়েছিল ব্যাটসম্যান হিসেবে। পাশাপাশি মিডিয়াম পেস বোলিংও করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বের সময়টাতে বরং ব্যাটসম্যান হিসেবেই অধিক সুনাম কুড়িয়েছেন তিনি। পয়েন্ট ও গালি পজিশনে দুর্দান্ত ফিল্ডার হিসেবেও তাঁর বেশ সুখ্যাতি ছিল।
লেকারের ব্যাটিং সামর্থ্যের প্রমাণও মিলেছিল পরবর্তীকালে। ১৯৪৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ট্রেন্টব্রিজ টেস্টের প্রথম ইনিংসে মাত্র ৭৪ রানে ৮ উইকেট হারায় ইংল্যান্ড। ১০ নম্বরে নেমে লেকার খেলেছিলেন ১০১ বলে ৬৩ রানের দারুণ একটি ইনিংস। স্যার অ্যালেক বেডসারকে সাথে নিয়ে ৯ম উইকেট জুটিতে যোগ করেছিলেন ৮৯ রান।
জিম লেকারের ‘প্রিয় প্রতিপক্ষ’ ছিল অস্ট্রেলিয়া। ‘ক্যাঙ্গারু’দের বিপক্ষে তাঁর টেস্ট পরিসংখ্যানটাও দুর্দান্ত। মাত্র ১৮.২৭ গড়ে ৭৯ উইকেট। টেস্ট ও ফার্স্ট ক্লাস মিলিয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দু’বার নিয়েছেন ইনিংসে ১০ উইকেট।
অ্যাশেজে এক সিরিজে সবচেয়ে বেশি উইকেট লাভের কীর্তিটাও জিম লেকারের দখলে। ১৯৫৬ সালের অ্যাশেজে ৫ ম্যাচে নিয়েছিলেন রেকর্ড সর্বোচ্চ ৪৬ টি উইকেট। এমনকি ১৯৫৮-৫৯ সালের অ্যাশেজ, যেবার ইংলিশরা বিধ্বস্ত হয়েছিল ৪-০ ব্যবধানে, সেবারও মাত্র ২১.২০ গড়ে ১৫ উইকেট নিয়ে বল হাতে ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়েছিলেন লেকার।
১৯৫১ সালে ওভালে সফরকারী দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ নির্ধারণী টেস্টে দুই ইনিংস মিলিয়ে (৪/৫৪ ও ৬/৫৫) লেকার নিয়েছিলেন ১০ উইকেট। লেকারের অনবদ্য বোলিং নৈপুণ্যের সুবাদেই প্রোটিয়াদের বিপক্ষে সেবার সিরিজ জিততে সমর্থ হয়েছিল ইংল্যান্ড।
১৯৫১-৫২ মৌসুমে নিউজিল্যান্ডের ঘরোয়া লিগ প্লাংকেট শিল্ডে খেলতে যান অকল্যান্ডের হয়ে। মাত্র ১৫.৭৯ গড়ে ২৪ উইকেট নিয়ে হয়েছিলেন সেবারের মৌসুমে তৃতীয় সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি।
টেস্টে জিম লেকারের ইকোনমি রেটটাও দুর্দান্ত। ওভার প্রতি মাত্র ২.০৪ গড়ে রান দিয়েছেন ক্যারিয়ার জুড়ে। বোলার হিসেবে তাঁর সবচাইতে অপছন্দের জিনিস ছিল ‘সিঙ্গেল’। ব্যাটসম্যানকে সহজে সিঙ্গেল বের করতে দেয়ায় তাঁর ছিল প্রবল আপত্তি।
স্কুল জীবন থেকেই দুর্দান্ত সব বোলিং ফিগারের রেকর্ড গড়তে ভালবাসতেন জিম লেকার। স্কুল ক্রিকেটের এক ম্যাচে ০ রানে ৬ উইকেট নিয়ে রীতিমতো চমকে দিয়েছিলেন সবাইকে! সেদিনের অসাধারণ পারফরম্যান্সটাই তাকে খেলার সুযোগ করে দিয়েছিল স্থানীয় ব্র্যাডফোর্ড লিগে।
ইংলিশ বোলারদের মধ্যে সবচেয়ে কম রানে ৮ উইকেট প্রাপ্তির রেকর্ডটিও (১৪-১২-২-৮) নিজের দখলে রেখেছেন লেকার। ১৯৫০ সালে ব্র্যাডফোর্ডে অনুষ্ঠিত একটি চারদিনের ট্রায়াল ম্যাচে, ইংল্যান্ডের হয়ে অবশিষ্ট ইংল্যান্ড একাদশের বিপক্ষে এ কীর্তি গড়েছিলেন তিনি।
লেকারের অবিশ্বাস্য এই রেকর্ডটিও একবার অল্পের জন্য ভেঙে যেতে বসেছিল। লিস্টারশায়ার বনাম সারের মধ্যকার কাউন্টি লিগের এক ম্যাচে চার্লি পালমার নামের ‘অখ্যাত’ এক বোলার ০ রানেই তুলে নিয়েছিল ৮ উইকেট! কিন্তু ‘০/৮’ ফিগারটা কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিণত হয় ‘৩/৮’ এ! মহামূল্যবান ‘তিনটি’ রানই এসেছিল সারের ১০ নম্বর ‘ব্যাটসম্যান’ জিম লেকারের ব্যাট থেকে!
কেন বেরিংটনকে মনে করা হয় ইংল্যান্ডের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন। তাঁর বোলিংয়ের হাতটাও নেহাত মন্দ ছিল না। লেগ স্পিনে কবজি ঘুরিয়ে শিকার করেছেন ২৭৩ টি ফার্স্ট ক্লাস উইকেট যার ২৯টাই এসেছে টেস্টে।
১৯৬৪-৬৫ সালে কেপটাউনে, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে একবার লেগ স্পিনের পরিবর্তে অফ স্পিন করেছিলেন বেরিংটন। তা তিনি করতেই পারেন, কিন্তু মজাটা অন্য জায়গায়। তিনি জিম লেকারের বোলিং একশন হুবহু নকল করে বোলিং করেছিলেন এবং কোন ফিল্ডারের সাহায্য ছাড়াই পেয়েছিলেন তিন উইকেট!
জিম লেকারের অনুকরণে করা অফ স্পিনে বেরিংটনের শিকার হয়েছিলেন ডেনিস লিন্ডসে, পিটার পোলক আর গ্লেন হল। চমৎকার সেই বোলিং ফিগারটাও (৩.১-১-৪-৩) কিন্তু জিম লেকারের কথাই মনে করিয়ে দেয়।
১৯৪৮ সালের অস্ট্রেলিয়া দলটিকে বলা হয় ‘ব্র্যাডম্যান’স ইনভিন্সিবলস’। শক্তির বিচারে ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা ব্যাটিং লাইনআপ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল দলটি। এই দলটির হাতেই একবার বেদম মার খেতে হয়েছিল জিম লেকারকে।
লর্ডসে অনুষ্ঠিত একটা ট্যুর ম্যাচে অজিদের বিপক্ষে তিনি খেলতে নেমেছিলেন এমসিসি একাদশের হয়ে। ম্যাচের দ্বিতীয় দিন, সকালের সেশনে অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানদের হাতে গুণে গুণে নয়টি ছক্কা খেয়েছিলেন লেকার! যার ফলশ্রুতিতে প্রথম টেস্টের দল থেকে বাদ পড়তে হয়েছিল তাঁকে।
জিম লেকারকে মনে করা হয় সর্বকালের সেরা অফ স্পিনারদের একজন। ফ্লাইট, লুপ এবং লেংথের ওপর তাঁর ছিল অবিশ্বাস্য নিয়ন্ত্রণ। বিষাক্ত টার্নের সাথে সাপের মত ফণা তোলা বাউন্স মিশিয়ে ব্যাটসম্যানদের কুপোকাত করতেন তিনি।
ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তি স্যার গ্যারি সোবার্স তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘when you batted against Jim Laker, you could hear the ball fizz as he spun it.’
একটা সময় কমেন্ট্রি বক্সেও দারুণ জনপ্রিয় ছিলেন সাবেক এই অফ স্পিনার। এমনকি কিংবদন্তী ধারাভাষ্যকার রিচি বেনোর সাথেও তাঁর তুলনা করা হত। সাবলীল ও আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গি, বিশেষণের পরিমিত ব্যবহার, দুর্দান্ত সেন্স অব হিউমার এবং স্মৃতিশক্তি ও পরিসংখ্যানের নির্ভুল ব্যবহার ছিল তাঁর ধারাভাষ্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
তাঁর কমেন্ট্রিতে লক্ষণীয় একটা ব্যাপার ছিল, ইংরেজি ক্রিয়াপদের (verb) চলমান কাল (continuous tense) বোঝাতে -ing এর পরিবর্তে -in এর বহুল ব্যবহার। বিখ্যাত ক্রীড়া সাংবাদিক জন আর্লটের ভাষ্যমতে, ‘He (Jim Laker) thought about cricket with a deep intensity and a splendid ironic point of view.’
১৯৫২ সালে উইজডেন মনোনীত বর্ষসেরা ক্রিকেটারের সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন জিম লেকার। ১৯৫৬ সালে ইতিহাসের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে বিবিসি স্পোর্টস পারসোনালিটি অফ দ্য ইয়ার পুরস্কারের জন্য মনোনিত হয়েছিলেন। ২০০৯ সালে আইসিসি হল অফ ফেমের গর্বিত সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় তাঁকে।