ভারতের নিজস্ব মিস্টার ক্রিকেট

অস্ট্রেলিয়ার মিস্টার ক্রিকেট খ্যাত মাইকেল হাসি ঘরোয়া ক্রিকেট খেলতে শুরু করেছিলেন ১৯৯৪ সালে। অথচ কিংবদন্তি এই ক্রিকেটারের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পা রাখতে সময় লেগে গিয়েছিল প্রায় এক দশক। অবশ্য অভিষেকের পর থেকে আর পিছনে ফিরতে হয়নি। ক্রিকেটের তিন সংস্করণেই নিজের প্রতিভার ছাপ রেখে গিয়েছেন এই ব্যাটসম্যান।

মাইকেল হাসির মতই জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়ানোর জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে ভারতের সুরিয়াকুমার যাদবকে। সুরিয়ার যখন তারুণ্য, তখন জাতীয় দলের ডাক তিনি পাননি। বয়স যখন ৩০ ছুঁয়েছে, জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছেন তখন। অন্য ক্রিকেটারদের চেয়ে দেরিতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখার আক্ষেপ-ই হয়তো তিনি এখন নিজের সেরা নিংড়ে দিচ্ছেন। বর্তমান ভারতীয় টি-টোয়েন্টি দলের সেরা ব্যাটসম্যান এই ডানহাতি।

তবে ভারতের জার্সিতে সাফল্য অর্জনের জন্য অনেক উত্থান আর পতনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে সুরিয়াকুমার যাদবকে। ২০১০ সালে দিল্লির বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে সুরিয়াকুমারের ক্রিকেট যাত্রা শুরু হয়৷ অভিষেক ম্যাচে ৮৯ বলে ৭৩ রানের ইনিংস খেলে আলোচনায় উঠে আসেন তিনি। তরুণ সুরিয়ার সম্ভাবনা বুঝতে ক্রিকেটবোদ্ধাদের সেসময় কোন ভুল হয়নি।

২০১১/১২ মৌসুমে রঞ্জি ট্রফির পুরো আসরে খেলার সুযোগ পান সুরিয়াকুমার যাদব। এই আসরে সর্ব্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায় শীর্ষস্থান দখল করে নেন তিনি। সেসময় মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স তাদের ঘরের ছেলেকে দলে নেয়। কিন্তু দলটির হয়ে মাত্র একটি ম্যাচ খেলার সুযোগ পান তিনি। ২০১৪ সালে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) নিলামে কলকাতা নাইট রাইডার্স কিনে নেয় সুরিয়াকে।

২০১৫ সালে সাবেক দল মুম্বাইয়ের বিপক্ষে ২০ বলে ৪৬ রানের ম্যাচ জেতানো ইনিংস খেলে খবরের শিরোনাম বনে যান সুরিয়াকুমার যাদবের। একটা পর্যায়ে কলকাতা সুরিয়াকে গৌতম গম্ভীরের ডেপুটির দায়িত্ব দেয়। কিন্তু তারা তাকে প্রিয় তিন নম্বর পজিশনে ব্যাট করার সুযোগ দিতে পারেনি। আর তাই ফিনিশারের ভূমিকায় খেলা সুরিয়ার কাছ থেকে সেরাটা পায়নি শাহরুখ খানের ফ্রাঞ্চাইজি।

২০১৮ সালে আবারো মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স সুরিয়াকুমার যাদবকে দলে নেয়। তবে সুরিয়াকে ছেড়ে দেয়া কলকাতার বড় ভুল ছিল বলে মত দেন দলটির সাবেক অধিনায়ক গৌতম গম্ভীর। কলকাতার এই ভুল মুম্বাইয়ের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে।

২০১৮ সালের আইপিএলে ৫০০ এর বেশি রান করেন সুরিয়াকুমার যাদব। পরের বছরগুলোতেও ধরে রেখেছিলেন নিজের ফর্ম। ২০১৯ সালে তাঁর ব্যাট থেকে আসে ৪২৪ রান এবং ২০২০ সালে এসেছে ৪৮০ রান। ধারাবাহিকতার পুরস্কার স্বরূপ ২০২১ সালের মার্চে জাতীয় দলে প্রথমবার ডাক পান তিনি।

আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের প্রথম ম্যাচে ব্যাটিং করার সুযোগ না পেলেও পরের ম্যাচে দেখা যায় ব্যাটসম্যান সুরিয়াকুমার যাদবকে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেদিন মাত্র ৩১ বলে ৫৭ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলে জাতীয় দলে জায়গা নিশ্চিত করেন এই ডানহাতি। গত এক বছরের বেশি সময় ভারতের জার্সিতে রান করার ক্ষেত্রে কোন বিরতি দেননি সুরিয়া।

বর্তমানে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) র‍্যাংকিংয়ে দুই নম্বরে আছেন ভারতের এখনকার এক নম্বর টি-টোয়েন্টি ব্যাটসম্যান সুরিয়াকুমার যাদব। অভিষেকের পর থেকে সুরিয়ার চেয়ে বেশি রান করতে পারেনি ভারতের আর কোন ব্যাটসম্যান। চলতি বছরেও তিনি ভারতীয় ব্যাটারদের মাঝে সবচেয়ে বেশি রান করেছেন।

রান আর ব্যাটিং গড় নয়; যেকোনো ক্রিকেটারের জন্য সবচেয়ে ঈর্ষণীয় দিক নি:সন্দেহে সুরিয়াকুমারের স্ট্রাইকরেট। মাঠে নামার পর অহেতুক ডট বল দেন না তিনি, যেকোনো পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে টি-টোয়েন্টির সাথে মানানসই অ্যাপ্রোচে ব্যাট করতে পারেন। টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের স্ট্রাইক রেট সেটারই প্রমাণ দেয়।

মাঠের চারদিকে শট খেলার নিজের দক্ষতা ইতোমধ্যে দেখিয়েছেন সুরিয়াকুমার যাদব। কিংবদন্তি অজি তারকা রিকি পন্টিং তাকে ভারতের ৩৬০° উপাধি দিয়েছেন। ড্রাইভ, পুল, সুইপ, হুক, কাট, স্কুপ – সব রকমের শট খেলতে পারেন সুরিয়া। তিনি কোনভাবেই বাউন্ডারি মারতে পারবেন না এমন ডেলিভারি খুব কমই আছে।

রোহিত শর্মা, লোকেশ রাহুল আর বিরাট কোহলি দলে থাকলে টপ অর্ডারে জায়গা হয় না সুরিয়াকুমার যাদবের। কিন্তু এই ডানহাতির সেরাটা পেতে চাইলে টপ অর্ডারে ব্যাটিং করার সুযোগ করে দিতে হবে টিম ম্যানেজমেন্টকে। যদিও যেকোনো পজিশনে ব্যাট করতে নিজেকে প্রস্তুত মানছেন সুরিয়াকুমার যাদব। এটাই তো ‘মিস্টার ক্রিকেট’ হওয়ার প্রধান শর্ত। তাঁর কাছে ক্রিকেটটাই মুখ্য, সেটা যে মঞ্চই হয়, যখনই হোক, যেখানেই হোক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link