স্মৃতি তুমি বেদনা, ‍তুমিই আনন্দ

মন কেমনের খেয়াল হলে স্মৃতিসাগরের অতলে তলিয়ে যেতে কোনো ডুবোজাহাজের দরকার লাগে না, দরকার শুধু একটা কেয়া পাতার নৌকোর যার পাতায় পাতায় লেখা থাকে মন কেমনের সেই না বোঝা হায়েরোগ্লিফিক্সের লিপিগুলো অথবা  সেই মন কেমনের মেঘে মাঝে মাঝে গড়িয়ে পড়া কিছু  আনন্দের বৃষ্টির সোনালী চর্যাপদ।

মহানগরী, তোমার কি মনে আছে সাগরের ওপাড়ের কথাগুলো কিংবা আজ থেকে বারো বছর আগে মকমলি ক্রিকেটের ওপর এন্টারটেইনমেন্টের চাদর বিছানোর সময়ের গল্প গুলো।

মনে পড়ে ব্রেন্ডন ম্যাককালাম, ডেভিড হাসি, ব্র‍্যাড হজ, শোয়েব আখতারকে? মনে পড়ে আমাদের মহারাজাকে? হ্যাঁ, এটা হয়তো ঠিক যে তখন তুমি আর আমি প্রায়শই মনমোর মেঘের সঙ্গী হয়ে উড়ে বেড়াতাম মন খারাপের আকাশে। একটার পর একটা হারের ধাক্কা, সত্যি এগুলো সামলানো কি মুখের কথা।কিন্তু বুকে বল থাকত আমার আর তোমার পরিচয়েতে।

মহানগরী, আমরা যে তখন থেকেই নাইট ছিলাম। হারতাম, শ্লেষাবদ্ধ হতাম, কিন্তু আবারও যখন এক টাকা দিয়ে কেনা অথবা বাবল-গামের সাথে ফ্রি পাওয়া শিডিউল কার্ডগুলোতে দেখতাম আমাদের নাইটদের ম্যাচের পরবর্তী তারিখটির কথা, আমি আর তুমি সাদাকালো স্যালোরা টিভির ওই ঘোরাবার যন্তরটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঠিক বসে পড়তাম সেট ম্যাক্সের স্ক্রিনটাতে।

তখন তো আর এতো সোশ্যাল মিডিয়া, গুগল ছিলনা। সম্বল বলতে তাই এক টাকা দিয়ে কেনা শিডিউল কার্ডগুলো।কিন্তু শুধুই যে মন খারাপই হতো তা তো নয়। আনন্দের পশলা পশলা বৃষ্টি পড়ত বই কি। শোয়েব আখতারের সেই আগুনে স্পেলটা মনে আছে? দিল্লীর সাথে মুখোমুখি হয়েছিলাম, আমি আর তুমি একসাথে।

তখন আবার কলকাতা ম্যাচের আগে স্টার আনন্দের ক্রিকেটের আড্ডা দেখাটা ছিলো মাস্ট। সেদিন দিল্লী ম্যাচের আগে সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় কি বলেছিল এখনও মনে আছে টাটকা – ‘আমাদের সবথেকে দুর্বল জায়গা হলো ওপেনিং, আর দিল্লির সবথেকে শক্তিশালী জায়গা হলো ওপেনিং। কিন্তু শোয়েব যদি আজকে খেলে, দিল্লীর কপালে দু:খ আছে।’ – কোট আনকোট এটাই। পুরো চাঁচাছোলা ভাষায়।

আসলে শোয়েব খেলবে কি না সেটাই ছিল প্রশ্নের মুখে। শাহরুখ খান নিজে অনেক কাঠখড় পুড়িয়েছিলেন শোয়েবকে আনার ব্যাপারে। শোয়েব তো এলেন, কিন্তু মাঠে নামবেন কি? হ্যাঁ, শোয়েব মাঠে নামলেন, আর হাইকোর্ট এন্ডের বাউন্ডারির ধার থেকে চিরাচরিত দীর্ঘতম রান-আপ নিয়ে পপিং ক্রিজ থেকে যেগুলি  নিক্ষেপ করলেন সেগুলি বল ছিলো না, ছিলো জ্যাকেটেড লেডের খোলসে এক একটা বুলেট।

বীরু-গৌতিকে প্যাভিলিয়নে পাঠিয়ে শোয়েব দু হাত প্রসারিত করে ছুটছেন আর ছুটতে ছুটতে  শোয়েবের কালো-সোনালী জার্সির ফাঁক বেয়ে বেরিয়ে পড়া মাংশল শরীরটাকে সৌরভ গাঙ্গুলি আলিঙ্গন করছেন – এ দৃশ্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আদৌ কোনোদিন দেখতে পেত কিনা জানিনা,তবে সেদিনের নৈসর্গিক মহানগরী দেখেছিল আর দেখেছিল হ্যান্ডক্ল্যাপ দিয়ে মহানগরীকে ক্রমাগত তাতাতে থাকা বলিউড বাদশাহ।

শাহরুখ খান তো ভালোভাবেই জানতেন এ মহানগরী আজহারকে ভালোবাসতে জানে, আজহারকে ঘৃণা করতেও জানে, এ মহানগরী ইন্ডিয়ার শচীনের সেঞ্চুরির জন্য গলা ফাটাতে জানে আবার মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের শচীন আউট হতে হায়েস্ট পিচে চিৎকার করতেও জানে, এ মহানগরী জানে ইডেন টেস্টে দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে একা লড়ে যাওয়া হাশিম আমলাকে স্ট্যান্ডিং ক্ল্যাপ দিতে।

এ মহানগরী রোহান কানহাইয়ের জন্য স্ট্যান্ডিং ক্ল্যাপ দেয়,আসিফ ইকবালের জন্য স্ট্যান্ডিং ক্ল্যাপ দেয়, স্লিপ অনেকটা দৌড়ে গিয়ে গ্যারি সোবার্স ক্যাচ ফসকালেও তাকে দণ্ডায়বান অভিবাদনে ভরিয়ে দেয়। এ মহানগরী ক্রিকেট জানে, আবেগ জানে – শাহরুখ জানতেন সেদিন এসব কিছুই।

কিংবা ওই বছরের একেবারে শেষের দিকে পাঞ্জাব ম্যাচটার কথা, মহানগরী তোমার মনে আছে? সেই যে তোমার আর আমার মহারাজা আর সেই পেশোয়ারী তুর্কি উমর গুল কেমন জিতিয়ে দিলো ম্যাচটা। কে বলে,তুমি আর আমি শুধুই মন খারাপ করতাম।

এই ম্যাচগুলোতো দু:খের পাহাড়ের গায়ে পশলে পড়া আনন্দঝর্ণার ফোঁটা। এই ম্যাচগুলোর আনন্দধারা যে এখনও লেগে আছে প্রিন্সেপ ঘাটের ধারে কিংবা আকাশবাণী থেকে ইডেন যাবার পথের ট্রাফিক সিগন্যালগুলোতে। বছর এগোলো।

তোমার আর আমার চিরসবুজ অধিনায়ককে মাঠের সবুজের অধিনায়কত্ব থেকে ফেয়ারওয়েল দেওয়া হলো।আবারও আগুন জ্বললো কলকাতায়।বুকাননের চার ক্যাপ্টেনের থিওরিকে নস্যাৎ করে কলকাতা আবারও দেখিয়েছিল,তারা জ্বলতে জানে তাদের শিখার জন্য।

সেই বারের কষ্টটাতো আরও অসহনীয়। পরপর নয় ম্যাচে হারের ধাক্কা। কিন্তু ওই,তারপরে আবারও এক পশলা বৃষ্টি নামল তোমার আমার জীবনে। ব্রেন্ডন ম্যাকালামের সেই অসাধারণ ইনিংস আর ঋদ্ধি-হজের দূরন্ত ফিনিশিংয়ে চেন্নাইবধের আনন্দে আবারও রাত জেগেছিলাম তুমি আর আমি।

আমার কি মনে হয় জানো তো,তখন তুমি আর আমি দুজনেই খুব ছোটো ছিলাম।তাই হয়তো দুঃখ পেতাম, আনন্দ পেতাম। ঈশান্ত শর্মা কিংবা অশোক ডিন্ডারা বেধড়ক মার খেলে চ্যানেল ঘুরিয়ে দিতাম আবার ব্র‍্যাড হজ-ডেভিড হাসির কিছু দূরন্ত ফিনিশিংয়ের খবর পেলে সাথে সাথে সেই ঘোরাবার যন্ত্রটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে টেনে নিয়ে যেতাম সেট ম্যাক্সে।

তখন হাতে রিমোটই ছিল না,আর এখন আমাদের জীবনটাই যেন একটা আস্ত রিমোট, যে কেউ যখন তখন বোতাম টিপে আমাদের নিয়ে যেতে পারে যেখানে সেখানে, যত্রতত্র। তোমার মনে আছে সেই মর্নি ভ্যান উইকের ধৈর্য্যশীল ইনিংসগুলোর কথা? ওগুলোই তো ছিল আমাদের উইকেট পড়ার শ্রাবণধারায় একমাত্র পলির বাঁধ। তুমি আর আমি সেবার মনে মনে বলেছিলাম – এ আফ্রিকান ইনিংস গড়তে জানে।

 

আমি আর তুমি কি খুশিই না হয়েছিলাম যখন ঠিক পরের বছরেই অধিনায়কত্ব ফিরে পাওয়া মহারাজার অসামান্য বোলিং চেঞ্জে প্রায় হারা ম্যাচ জিতে নিয়ে আবারও শুরু করলাম আমরা। আমাদের সোঁদা মনে পড়তে শুরু করলো অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউস আর ওয়াইজ শাহের রৌদ্রস্নাত ছায়া। ভাবলাম, আমার আর তোমার ভিজে মনখানি খানিক শুকোবে এবার।

কিন্তু বরুণদেবের যে বারেবারে ইচ্ছে হয়েছিল আমার-তোমার মনকে বিরহের শ্রাবণধারায় ভিজাতে তা কে জানত। আবারও একের পর এক হার। শেষ চারে পৌঁছাতে পৌঁছাতেও পৌঁছাতে পারলাম না আমরা। আর তারপরেই যেন তোমার-আমার ভুবনটা খানিকটা বদলালো,বদলালো পুরো টিম,বদলালো অধিনায়ক, জার্সিটা আগেই বদলেছিল। প্রথমে খাপ খাওয়াতে পারিনি। ভেবেছিলাম বিদ্রোহী হবো। কিন্তু মহানগরী, দলের নামটা যে তোমার নামেই, তাই ভালোবেসে ফেললাম আবারও।

মহানগরী,আমি তোমাকে ভালোবেসেছি বারবার,তোমাকে নতুন নতুন করে আবিষ্কার করেছি বারবার,তাই তো এই গঙ্গাতীরে ঢেউয়ের মাঝে তোমার সাথে আমার একান্ত সাক্ষাৎকারে আজ হঠাৎ করে ফিরে যেতে পেরেছি আমার তোমার পুরোনো সংসারের ধারাভাষ্যগুলোতে। নতুন সংসারে আমি আর তুমি খুব সুখী। আমরা দুবারের ভারতজয়ী।

দিল্লী বাসীর আগমনে কুয়াশা সরিয়ে আমরা বিশের খেলা দেখতে শুরু করেছি অন্য চোখে।আমাদের চোখ এখন অনেক বেশী স্ট্র‍্যাটেজিক, অনেক বেশি অ্যানালিস্টিক।আমি আর তুমি এখন অনেক বেশী ম্যাচিউরড। আমি আর তুমি এখন জানি আমাদের অজন্তা মেন্ডিসের মোহটা ভুল ছিল, আমাদের মিসবাহ উল হককে না নেওয়াটা ভুল ছিল।

কিন্তু তবুও মহানগরী, তবুও তো মাঝে মাঝে আমার তোমার ইচ্ছে করে সেই তারাহীন সন্ধ্যার আকাশে মেঘবালক হয়ে ভেসে বেড়াতে, তবুও তো ইচ্ছে করে তারাহীন আকাশে মিটমিটে আলোয় সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালা ডেভিড হাসি-ব্র‍্যাড হজ-উমর গুলের কথা ভাবতে। মহানগরী,আমাদের আগের সংসারটা যে আমাদের প্রথম প্রেম, সেকথাগুলো কি এতো সহজে ভোলা যায়। হোক না কষ্ট,হোক না যাতনা,তবুও তো প্রেমে পড়েছিলাম,তবুও তো ভালোবেসেছিলাম।

আচ্ছা মহানগরী, অ্যাঞ্জেলো-গুল-বন্ড-গেইল-ব্রেন্ডন-ডেভিড-সৌরভদের খাঁচা ভেঙে যখন নতুন খাঁচার ডাক দেওয়া হলো, তখন কি একবারের জন্যেও সিংহলী ম্যাথিউসের মৈথেলী ভাষায় কোনো করুণ মাউথ অর্গ্যানের সুর মনে পড়েনি কিংবা সেই পেশোয়ার নিবাসী উমর গুলের কি মনে পড়েনি কোনো মনখারাপী গজল?  ওদের চোখগুলো কি একটুকুও ভেজেনি! ওরাও কি আমার-তোমার মতো একাকী রাত্রে হারিয়ে যায় মাঝে মাঝে আজও। শোয়েবের কি এখনও মনে পড়ে সৌরভ গাঙ্গুলির আলিঙ্গনের স্পর্শের অনুভূতিটা।

মহানগরী, আজ তোমায় একটা প্রশ্ন করবো। ভেজা চোখ নিয়ে কলকাতা ছাড়তে ছাড়তে বেহালাবাসী বাঙালী কি সত্যিই তোমার দিকে তাকিয়ে শেষ রাত্তিরে কিছু বলে যায়নি তোমাকে? – জানি তুমি বলবেনা আমায় সেই নীরব মনের অনুরণনের কথাটা – কিন্তু আমি জানি সেদিন সেই বেহালাবাসী নতুন করে সংসার পাতা তার তিলোত্তমাকে আলতো স্বরে বলে গিয়েছিল, ‘If Winter comes,Can spring be far behind!’

অনেক রাত হলো মহানগরী। ওই দেখো বর্ডার থেকে ভেসে আসছে উমর গুলের গজলের সুর। ওই দেখো সিংহাসনে বসে আমাদের দিকে তাকিয়ে মহারাজা মিষ্টি হাসি হাসছে তাঁর সাবেক গৃহিনী তিলোত্তমার দিকে, প্রিয় প্রাক্তন, নতুন সংসারে আমরা সুখী – খুব সুখী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link