দুশ্চিন্তার নাম নাম্বার নাইন

শ্রীলংকার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে আজ সাফ ফুটবলের মিশন শুরু করবে বাংলাদেশ। কিন্তু এই ম্যাচে সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার নাম বাংলাদেশের পরোয়ার্ড লাইন। বিগত বছরগুলোর তুলনায় সাম্প্রতিক সময়েও গোল করার খেলোয়াড় না থাকায় সেরা সাফল্য পাচ্ছেনা লাল সবুজ প্রতিনিধিরা। মালদ্বীপ সাফেও তাই বড় দুশ্চিন্তার নাম এই ফরোয়ার্ড লাইন। য়ারা জাতীয় দলে খেলছেন তাদের উপর খুব বেশি ভরসাও রাখা যাচ্ছেনা।

ক্লাব দলের পাশাপাশি বাংলাদেশ জাতীয় দলে দক্ষ গোল স্কোরারের অভাবটা বেশ পুরনো। সে কারণে ছোট থেকে বড় সব ক্লাবেই আক্রমনভাগে ভরসা করে বিদেশীদের উপর। তারাও আস্থা প্রতিদান রেখে চলেছেন বছরের পর বছর ধরে। সদ্য শেষ হওয়া বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) ফুটবলেও দেখা গেছে একই চিত্র। সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় সেরা দশে ছিলেন না কোন বাংলাদেশি।

যেখানে ২১ গোল করে সবার উপরের ছিলেন বসুন্ধরা কিংসের ব্রাজিলিয়ান বরসন রবিনহো সেখানে ১০ গোল করে বাংলাদেশীদের মধ্যে শীর্ষে ছিলেন ঢাকা আবাহনী লিমিটেডের জুয়েল রানা। যার পুরস্কার স্বরুপ সাফে দলে সুযোগ পেয়েছেন তিনি। জুয়েলের গোলগুলো বেশিরভাগই লিগের শেষদিকে গুরুত্বহীন ম্যাচে। সব ক্লাবে শুরুর একাদশে জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা কম সুযোগ পেয়ে থাকেন।

এই যেমন বসুন্ধরা কিংসে জাতীয় দলের মতিন মিয়া, মোহাম্মদ ইব্রাহিম ও মাহবুবুর রহমান সুফিলরা খুব বেশি সুযোগ পান না। যার প্রভাব পড়ে জাতীয় দলের হয়ে আন্তর্জাতিক ম্যাচে। শুরুর অপেক্ষায় থাকা সাফ ফুটবলেও ঠিক একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ভাল খেলেও প্রতিনিয়ত পয়েন্ট হারানোর মধ্যে থাকা লাল সবুজ প্রতিনিধিদের জন্য কঠিন লড়াই অপেক্ষা করছে। সমস্যা সমাধানে সেখানে সুশীতল ছায়া হয়ে অপেক্ষায় ছিলেন এলিটা কিংসেলে।

শুরুতে পাসপোর্ট এবপরু বাংলাদেশি জাতীয়তা সনদ পেলেও ফিফা-এএফসির অনুমোদন না পাওয়ায় গেল আগস্টে বসুন্ধরা কিংসের হয়ে এএফসি কাপ খেলতে পারেননি নাইজেরিয়ার জন্ম নেওয়া এই ষ্টাইকার। ঠিক একই কারণে জাতীয় দলের হয়ে খেলা হয়নি সাফ চ্যাম্পিয়নশিপেও। চুড়ান্ত দল ঘোষনার আগ পর্যন্ত ফিফা-এএফসির ছাড়পত্র পাননি বাফুফের জাতীয় দল ব্যবস্থাপনা কমিটি।

অথচ ৩১ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ডের মধ্যে অনেকে খুঁজছিলেন গোলখরা কাটানোর দাওয়াই। জেমি ডে’র পর অস্কার ব্রুজোনের সাফের ছকেও ছিলেন তিনি অগ্রভাগে। কেননা জাতীয় দলের জন্য বহু বছর ধরেই গোল করাটা সবসময়ই বড় দুর্ভাবনার একটা জায়গা। এলিটা না থাকার পর অস্কার দাবি করেছেন, বর্তমান দলে ভালো মানের নাম্বার নাইন ও বক্স প্লেয়ারও দলে আছে, কিন্তু তারা লিগে মূল আক্রমণভাগে সুযোগ পায় না বলেই গোল করতে পারে না।

সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে গোলের জন্য তাই নির্দিষ্ট কারো উপর নির্ভর না করে সামনে তাকাতে চান বাংলাদেশ দলের এই অন্তরর্তীকালীন কোচ। ফরোয়ার্ড থেকে শুরু করে ডিফেন্ডারদেরও দায়িত্ব নেওয়ার তাগিদ দেওয়ার কথা বলে খেলোয়াড়দের বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি। গত চার আসরে গ্রুপ পর্ব থেকে বাংলাদেশের ছিটকে পড়ার বড় কারণ ছিল ফরোয়ার্ডদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত আর সময়মতো গোল না পাওয়া।

সর্বশেষ চার আসরে সব মিলিয়ে খেলা ১২ ম্যাচে বাংলাদেশ গোল করেছে মাত্র ১০টি, বিপরিতে হজম করে ১৮টি। সাফের প্রস্তুতির জন্য সর্বশেষ কিরগিজস্তানের ত্রিদেশীয় আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্টে খেলা তিন ম্যাচের তিনটিতেই পরাজিত হয় বাংলাদেশ দল। সব মিলিয়ে তিন গোল দিয়ে হজম করেছে ১০টি। কিরগিজস্তানের বিপক্ষে মাহবুবুর রহমান সুফিল একটি ও কিরগিজ অনূর্ধ্ব-২৩ দলের বিপক্ষে ৩-২ ব্যবধানে হেরে যাওয়া ম্যাচে দুটি গোল করেছিলেন সিরিজে প্রথমবার সুযোগ পাওয়া সুমন রেজা।

সুফিল আর সুমনের গোলের কারণেই কিনা কে জানে, এবার ঢাকা ছাড়ার আগে অতীতের মতো কোচ ও অধিনায়কের মুখে প্রত্যাশার ফুলঝুরি আউড়ে কোচ অস্কার ও অধিনায়ক জামাল ভুইয়া বলেছেন, সাফের ফাইনালে ওঠাই তাদের প্রধান লক্ষ্য। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দলে গোল করার মতো ষ্্রটাইকার যে নেই! ঠিক এই কারণে গত চার আসরে গ্রুপ পর্বের গন্ডি পার হওয়া সম্ভব হয়নি বাংলাদেশের। আর এবার গোল করতে পারদর্শী এলিটা কিংসেলেকে ছাড়াই সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে খেলতে গেছে বাংলাদেশ। দীর্ঘদিনের স্কোরিংয়ের সমস্যা সমাধানের জন্য সাফের প্রাথমিক দলে রাখা হয় নাইজেরিয়া থেকে বাংলাদেশি হওয়া এলিটাকে।

মাঠে দাপিয়ে বেড়ানো দারুণ স্কিলের সঙ্গে গোল করতে পারেন বলে এলিটাকে ঘিরে ছিল বাংলাদেশের আশা। এখন ৩১ বছর বয়সী এ ফরোয়ার্ড না থাকায় স্কোরিং নিয়ে দুশ্চিন্তা থেকেই যাচ্ছে। অনেকের মতে, এবারও যদি ভরাডুবি হয় সেটা হবে ফরোয়ার্ডদের ব্যর্থতার জন্যই। সাফের জন্য দায়িত্ব পাওয়া কোচ অস্কার যে ২৩ জনের চূড়ান্ত স্কোয়াড দিয়েছেন তাতে মাহবুবুর রহমান সুফিল, মতিন মিয়া এবং সুমন রেজা খেলেন ফরোয়ার্ড লাইনে।

জাতীয় দলের জার্সিতে সুফিল পাঁচ এবং মতিন দুই গোল করলেও সুমন রেজা আন্তর্জাতিক ম্যাচে স্কোরশিটে নাম তুলেছেন সর্বশেষ কিরগিজস্তান অলিম্পিক দলের বিপক্ষে। বিপিএলে উত্তর বারিধারার হয়ে নিয়মিত খেলেছেন সুমন। সুফিল ও মতিন বসুন্ধরার হয়ে সব ম্যাচে শুরুর একাদশে থাকেননি। যদিও এ দু’জন বিদেশি ফরোয়ার্ডদের কারণে খুব একটা সুযোগ পাননি। নাইজেরিয়ান নাগরিকত্ব বাতিল করে বাংলাদেশি হওয়া এলিটা কিংসের হয়ে দ্বিতীয় লেগে যে ক’টা ম্যাচে খেলেছিলেন সবগুলোতেই কারুকাজ দিয়ে নজর কেড়েছিলেন। ফরোয়ার্ড লাইনে খেলে গোলও পেয়েছেন দুই ম্যাচে।

সেই এলিটাকে ছাড়া কতটা আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলবে বাংলাদেশ, সেটা নিয়ে খোদ জামাল ভুইয়াও সন্দিহান, ‘এলিটার জন্য একটু মন খারাপ হচ্ছে। তবে এটাই জীবন, এটাই ফুটবল মানতে হবে। এলিটাকে আমি নাম্বার নাইন বলে থাকি। তাকে টিমে অনেক বেশি দরকার ছিল। যারা সামনে খেলে ওরা সবাই উচ্চতায় এবং শারীরিক গঠনে কিছুটা এগিয়ে রয়েছে। তবে এলিটা থাকলে নাম্বার নাইন নিয়ে আমাদের চিন্তা করতে হতোনা। যেহেতু নাই তাই যারা আছে তাদের নিয়েই ভাবতে হচ্ছে।’

সবাই জানে বাংলাদেশের মূল দুর্বলতা হলো স্কোরিংয়ে। সেটা মেনেই এবার ফাইনালে চোখ রাখছেন ডিফেন্ডার তপু বর্মণ, ‘আমাদের অবশ্যই ফাইনালে চোখ থাকবে। কারণ এটা আমার একটা স্বপ্ন বলতে পারেন। আমি ২০১৫ ও ২০১৮ সালের দুইটা সাফ খেলেছি। এই সাফটা আমার জন্য অনেক স্পেশালই হবে। আমি চাইব নিজের পারফরম্যান্স দিয়ে বাংলাদেশকে একটা ফাইনালে খেলতে।’

এদিকে র‌্যাংকিংয়ে শুধু শ্রীলঙ্কার ওপরে রয়েছে বাংলাদেশ। ভারত, মালদ্বীপ ও নেপালও এগিয়ে রয়েছে অনেক। তবে র‌্যাংকিংকে  স্রেফ একটা সংখ্যা হিসেবেই ধরতে হবে, তাহলেই সাফল্য আসবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link