পেটানোই তাঁর দর্শন

১৯৭৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর। ক্যারিবিয়ানের জ্যামাইকার কিংস্টনে জন্মেছিলেন একটি ছেলে। তখন কেউ জানতেন না যে ক্রিকেটে ৬৬ বলে ১৭৫ রান করা যায়। বা সবধরণের ম্যাচ মিলিয়ে ৪৭৮ আন্তর্জাতিক ম্যাচে ৫৫০ টি ওভার বাউন্ডারি আর ২৩২৯ টি বাউন্ডারি মারা যায়।

অনেক পরে ‘ছয় মারার মেশিন’ নামে খ্যাত ছেলেটির আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকই তো হবে এর প্রায় ২০ বছর পরে, টরেন্টোতে ভারতের বিরুদ্ধে ওয়ানডে দিয়ে। ছেলেটির ২০ বছর পূর্ণ হতে তখনো ১১ দিন বাকি। তার ৬ মাস পরে হবে তার টেস্ট অভিষেক আর প্রায় ৭ বছর পরে হবে টি-টোয়েন্টি অভিষেক। নামটা আর বলে না দিলেও চলে। তিনি ক্রিস্টোফর হেনরি গেইল!

১০৩ টি টেস্ট, ৩০১ টি ওয়ানডে আর ৭৪ টি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলা ওয়েস্ট ইন্ডিজের এই অলরাউন্ডার ক্রিকেটারকে নিছক পরিসংখ্যানে মাপতে যাওয়া তাঁর ছয় মারা আটকানোর মতই অসম্ভব ব্যাপার। তবুও রেকর্ড বই জানায় যে তার রানসংখ্যা ৭২১৫, ১০৪৮০ আর ১৮৫৪, টেস্টে, ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টিতে, যথাক্রমে।

ঐ ক্রমেই বাউন্ডারি মেরেছেন ১০৪৬, ১১২৮ আর ১৫৫টি। আর ওভার বাউন্ডারি মেরেছেন ৯৮, ৩৩১ আর ১২১ টি, ঐ একই ক্রমে। ঐ ক্রমেই শতরান ১৫টি (যার মধ্যে দু’টি ত্রিশতরান আর একটি দ্বিশতরান আছে), ২৫টি (যার মধ্যে আছে একটি দ্বিশতরান), আর দু’টি এবং অর্ধশতরান ৩৭ টি, ৫৪ টি আর ১৪ টি।

তার সর্বোচ্চ রান টেস্টে ৩৩৩, ওয়ানডেতে ২১৫ আর টি-টোয়েন্টিতে ১১৭। টেস্টে, ওয়ানডেতে আর টি-টোয়েন্টিতে তাঁর উইকেটসংখ্যা ৭৩, ১৬৭ আর ১৯, যথাক্রমে। ইনিংসে পাঁচ উইকেট টেস্টে দু’বার আর ওয়ানডেতে একবার। টেস্টে, ওয়ানডেতে আর টি-টোয়েন্টিতে তাঁর নেওয়া ক্যাচের সংখ্যা ৯৬, ১২৪ আর ১৮, যথাক্রমে। তার বাউন্ডারি আর ওভারবাউন্ডারির সংখ্যা অন্তত: ২৫ শতাংশ বেশি হত, অতটা ঝড়ো আর আকাশপথে না খেললে।

প্রথমত তিনি ছিলেন বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান, দ্বিতীয়ত ফিল্ডার, তৃতীয়ত ডানহাতি অফ ব্রেক বোলার আর শেষ পর্যন্ত ক্রিকেটের এক চরম এন্টারটেইনার। ব্যাট হাতে মার, মার, আরো মার, এই ছিল তার দর্শন, যা দর্শনসুখে ভরিয়ে রাখত আপামর বিশ্বজোড়া ক্রিকেটপ্রেমীকে।

উপরের পরিসংখ্যানে আইপিএল বা অন্যান্য দেশে (ওয়েস্ট ইন্ডিজ, পাকিস্তান আর বাংলাদেশ) তার প্রিমিয়ার লিগ খেলার রূপকথাগুলো নেই। শুধু আইপিএলেই প্রথম ১২ টি সংস্করণে (২০০৮-২০১৯) তার ১৪০ ম্যাচে ৪৯৫০ রান, ৪০৪টি বাউন্ডারি আর ৩৫৭ টি ওভারবাউন্ডারি, ১৮ টি উইকেট আর সর্বোচ্চ ৬৬ বলে ১৭৫।

জাস্ট অচিন্ত্যনীয় এইসব অলৌকিকতা। ব্যাট হাতে বারবার অসহায় করে দিয়েছেন তিনি বোলার আর ফিল্ডারদের।দিনের পর দিন ঝড়ের ঠিকানা খুঁজে নিয়েছে তার ব্যাট, বারবার। যাতে ‘উড়ন্ত সব জোকার’ মনে হত বোলারদের আর নিশ্চিন্তে থাকতেন ফিল্ডাররা, তাদের দৌড়তেই হতনা বেশিরভাগ সময়। ব্যাটের ঝড় প্রভাব ফেলেছিল তার মুখে আর ব্যবহারেও।

বারবার ঝামেলায় জড়িয়েছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ বোর্ডের সঙ্গে, মাঠের বাইরেও থাকতে হয়েছে যার জেরে। ফিরে এসে আবার তাঁদের ‘স্টেপ আউট’ করে উড়িয়েছেন, প্রতিপক্ষ বোলারদের সঙ্গেই। তাই ২০১৪ সালের পাঁচ সেপ্টেম্বরের পরে আর টেস্ট খেলতে দেখা যায়নি তাকে। ২০১৯ সালের ১৪ আগস্ট খেলেছেন শেষ ওয়ানডে। এবং এতদসত্ত্বেও টি-টোয়েন্টি দল থেকে তাঁকে বাদ দেওয়া যায়নি। আসন্ন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও তিনি জায়গা করে নিয়েছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে।

তার উড়িয়ে দেওয়া শটগুলির মতই বহুদিন আমাদের মনের আকাশে ডানা মেলে উড়তে থাকবে তার খেলা দেখার সুখস্মৃতি। আমরা বহুদিন পরেও গর্বিত হব এই ভেবে যে আমাদের কাছে তার খুঁজে পাওয়া ‘ঝড়ের ঠিকানা’ রেখে গিয়েছেন তিনি, দীর্ঘ ২১ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি ‘দ্য ইউনিভার্স বস’!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link