তুষার দেশপান্ডে, আইপিএলের নতুন তারকা

অথচ আগের দুই মৌসুম মিলিয়ে আইপিএলে মাত্র সাতটি ম্যাচে মাঠে নেমেছিলেন। কিন্তু মাঠের পারফরম্যান্সে সেটা বোঝার উপায় কই! ১৯ উইকেট নিয়ে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি এখন তুষার দেশপান্ডে। ডেথ ওভারে দুরন্ত পেসের সাথে অফকাটার আর নাকল বলের বৈচিত্র্যে তাঁকে সামলানোর সাধ্য কই ব্যাটসম্যানদের। 

২০২০ সালে প্রথমবারের আইপিএলে তাঁকে দলে ভেড়ায় দিল্লী ক্যাপিটালস। সেবারে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আইপিএল শেখার জায়গা নয়। আমি যদি ভবিষ্যতে ভারতের হয়ে খেলতে চাই, তাহলে আইপিএলে পারফর্ম করতে হবে। শেখার সুযোগ অবশ্যই কাজে লাগাতে হবে, তবে মাঠে ভালো করতে পারাটাই বেশি জরুরি।’

মাঠের বাইরে তুষারকে খুব বেশি কথা বলতে দেখা যায় না। তবু ছোট কিন্তু অর্থবহ এই কথাটাই বুঝিয়ে দেয় নিজের বোলিং নিয়ে কতটা সচেতন এই তারকা। এবারের মৌসুমেই তুষারের সেরাটা দেখেছে গোটা বিশ্ব।

ঘরোয়া ক্রিকেটেও ছিলেন নিজের সেরা ছন্দে, সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফিতে শিকার করেছেন ১৭ উইকেট। ইকোনমিও বেশ ঈর্ষণীয়, মাত্র ৬.৭২। আইপিএলেও শুরুর দিকে খানিকটা খরুচে হলেও সময় গড়ানোর সাথে সাথে ছন্দটা ফিরে পেয়েছেন। 

অথচ ছোটবেলাতে পেসার হবার আলাদা কোনো তাড়না ছিল না তুষারের। তিনি কেবল চাইতেন সারাদিন ক্রিকেট খেলতেই। বাড়ি থেকে একবার  অনূর্ধ্ব-১২ দলের জন্য ট্রায়াল দিতে এসে দেখলেন ব্যাটারদের তুলনায় বোলারদের লাইনে ভিড় কম। ব্যস! সেদিনই যেন নিয়তি লেখা হয়ে গিয়েছিল তুষারের।  

তুষারের বোলিং নজর কাড়ে বর্তমানে দিল্লী ক্যাপিটালসের সহকারী কোচ প্রবীন আম্রের। যদিও ক্যারিয়ারের শুরুতেই সফলতার মুখ দেখেননি এই পেসার। তাঁর সতীর্থ শ্রেয়াস আইয়ার এবং শার্দুল ঠাকুর যখন জাতীয় দলের হয়ে আলো ছড়াচ্ছেন, তখনো তুষার আইপিএলেই খেলার সুযোগ পাননি।

আম্রে বলেন, ‘তুষারের মাঝে প্রতিভা ছিল। আমরা জানতাম সে একদিন ভালো করবে। একবার সে আমাকে কাঁদতে কাঁদতে এসে বলেছিল তাঁর অনূর্ধ্ব-১৯ দলের কোচ তাঁকে বলেছে সে কখনো পেস বোলার হতে পারবে না। আমি তাঁকে বলেছিলাম নিজের উপর বিশ্বাস রাখতে, সেটাই সবচেয়ে জরুরি। পরিশ্রমটা বাড়িয়ে দাও আর কখনো হতাশ হওয়া চলবে না।’

এরপর মুম্বাইয়ের আরেক বিখ্যাত কোচ সন্দেশ কৌলের সাথে নিজের বোলিং নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন তুষার। নিজের ফিটনেসে আমূল পরিবর্তন আনার পাশাপাশি রানআপ এবং অ্যাকশনে উন্নতি আনেন।

কৌল বলেন, ‘সে এমনিতে চুপচাপ প্রকৃতির, কিন্তু একবার রেগে গেলে একদম আগ্রাসী হয়ে যায়। তাঁর মাঝে পেসারদের সহজাত আগ্রাসন আছে। কেউ একবার বাউন্ডারি হাঁকালে, সে ভীষণ রেগে যায়। আমরা তাঁকে বলেছি কোনো গতির সাথে আপোষ না করতে। আপনি যদি গতি কমিয়ে ফেলেন তাহলে কখনোই পেসার হতে পারবেন না। এখন তাঁর বোলিংয়ে টি-টোয়েন্টিতে সফল হওয়ার সমস্ত অস্ত্রই বিদ্যমান।’

২০১৭ মৌসুমে শার্দুল ঠাকুর জাতীয় দলে ডাক পেলে প্রথমবারের মতো মুম্বাইয়ের রঞ্জি ট্রফির স্কোয়াডে ডাক পান তুষার। নিজের অভিষেক ম্যাচেই চার উইকেট নিয়ে জানান দেন নিজের সামর্থ্যের। সেবারে গড়পড়তা এক মৌসুম কাটান তুষার, ১৪ ইনিংসে শিকার করেন ২১ উইকেট। 

এরপরই চোট খানিকটা পিছিয়ে দেয় তুষারকে। অ্যাংকেলের চোটে পড়ে প্রায় ছয় মাস মাঠের বাইরে থাকতে হয় তাঁকে। এছাড়া ব্যক্তিজীবনেও সে সময় কঠিন সময় পার করছিলেন তিনি। তাঁর মা সে সময়টাতে ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। ফলে মোটেই বাইশ গজে মনোযোগ দিতে পারছিলেন না এই পেসার। 

২০১৮-১৯ মৌসুমে হ্যামস্ট্রিং ইনজুরিতে পড়লেও ঘরোয়া ক্রিকেটে বেশ ভালো সময় কাটান তুষার। ১৫ উইকেট নিয়ে মুম্বাইকে বিজয় হাজারে ট্রফি জেতানোর পাশাপাশি রঞ্জি ট্রফিতে চার ম্যাচে শিকার করেন ১৭ উইকেট। এছাড়া সৈয়দ মুস্তাক আলী ট্রফিতেও তাঁর নামের পাশে ছিল ১৯ উইকেট। এমন পারফরম্যান্সের সুবাদেই কিনা ভারত এ দলের হয়ে ডাক পান এই তারকা। 

মুম্বাইয়ের ক্রিকেট পাড়ায় শার্দুল ঠাকুর এবং তুষারকে একই ঘরানার পেসার হিসেবে ভাবা হয়। তবে আমরের ভাষায়, ‘শার্দুল বলকে সুইং করাতে ভালোবাসে অন্যদিকে, তুষার হিট অ্যান্ড ডেক ঘরানার পেসার। তবে তুষারের নো বলের প্রবণতা আছে।’

তুষারের ক্যারিয়ারের প্রায় পুরোটা জুড়েই জড়িয়ে আছেন শার্দুল ঠাকুর। মুম্বাইয়ের হয়ে প্রথমবার ডাক পেয়েছিলেন শার্দুলের বিকল্প হিসেবে। চেন্নাই সুপার কিংসও তাঁকে দলে ভিড়িয়েছে শার্দুলের বদলি হিসেবেই। 

চেন্নাইতে নাম লেখানোর আগে দিল্লী ক্যাপিটালসের হয়ে পাঁচ ম্যাচে তিন উইকেট শিকার করেন তুষার। এরপর ২০২১ আইপিএল নিলামে অবিক্রীত থাকার পর চেন্নাইতে যোগ দেন নেট বোলার হিসেবে।

কিন্তু, এবারের মৌসুমে বদলে যায় দৃশ্যপট। চেন্নাইয়ের দুই নিয়মিত পেসার কাইল জেমিসন এবং মুকেশ চৌধুরি টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই ছিটকে যান ইনজুরিতে। এছাড়া টুর্নামেন্ট শুরুর পরই ইনজুরিতে পড়েন বেন স্টোকস, সিমারজিৎ সিং এবং দীপক চাহার। ফলে কপাল খোলে তুষারের, আর সেই সুযোগটা তিনি কাজে লাগিয়েছেন দারুণভাবে। 

এবারের মৌসুমে ১১ ম্যাচে ১৯ উইকেট নিয়ে ইতোমধ্যেই সর্বোচ্চ উইকেট শিকারির তালিকায় শীর্ষে আছেন এই পেসার। ডেথ ওভারে বোলিং করার কারণেই কিনা তাঁর ইকোনমি রেটটা বেশি, ১২.৭০। তবে প্রবীন আম্রে তুষারের এমন উন্নতিতে ভীষণ খুশি।

তিনি বলেন, ‘দিল্লীতে হয়তো তাঁর সময়টা ভালো কাটেনি, তবে অভিজ্ঞতা বেড়েছে। তাঁকে ভালো একটা মৌসুম কাটাতে দেখা ভীষণ আনন্দের। আমার ধারণা মহেন্দ্র সিং ধোনির বড় অবদান আছে এর পেছনে। ভারতীয় একজন পেসারের জন্য গতি থাকাটা ভীষণ জরুরি এবং তুষারের সেটা আছে। আমি নিশ্চিত তাঁর বাবা তাঁকে নিয়ে ভীষণ গর্বিত।’

আইপিএলের আঙ্গিনায় পা রাখতে হয়তো খানিকটা দেরিই হয়েছে তুষার দেশপান্ডের। কিন্তু নিয়মিত সুযোগ পেয়ে তুষার বুঝিয়ে দিয়েছেন নিজের সামর্থ্য। উন্নতির ধারাটা বজায় রাখলে জাতীয় দলে ডাক পেতেও খুব বেশি অপেক্ষা করতে হবে না তাঁকে। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link