তুষার ইমরানকে অনেক সুযোগ দেয়া হয়েছে – এই কথাটা অনেককেই বলতি শুনি। নির্বাচকরা বলেন, সাংবাদিকরাও কেউ কেউ বলেন, সমর্থকরাও বলেন! কেউ কেউ তো বলেই বসেন – ওই সময়ে বাংলাদেশের যেকটা ম্যাচ থাকতো তার অর্ধেক ম্যাচেই তুষার ইমরানরে সুযোগ দেয়া হয়েছে! চলেন- ব্যাপারটা একটু বোঝার চেষ্টা করি।
তুষার ইমরানের প্রথমে অভিষেক হয় ওয়ানডেতে ২০০১ সালের নভেম্বর মাসে। আর টেস্ট অভিষেক হয় ২০০২ সালের জুলাইয়ে। শেষ টেস্ট খেলছে ২০০৭ সালের জুলাইয়ে, শেষ ওয়ানডে একই বছর ডিসেম্বরে। এই ৫-৬ বছরের ক্যারিয়ারে ওয়ানডে খেলেছেন মোট ৪১ টা, আর টেস্ট খেলেছে সাকুল্যে ৫ টা। ঐ সময়কালে বাংলাদেশ জাতীয় দল টেস্ট খেলেছে ৩৮ টা, আর ওয়ানডে খেলেছে ১২২ টা। অর্ধেক ম্যাচেই সুযোগ পেয়েছে বলা যাবে?
টেস্ট পাঁচটা খেলেছে কখন? ২০০২ সালে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে অভিষেক হলো, ওই এক ম্যাচ খেলেই দল থেকে বাদ। আবার দলে ডাক আসলো তিন বছর পরে ২০০৫ সালে, দক্ষিণ আফ্রিকায়। দুটা টেস্টে খেলে আবার বাদ। এরপরে ২ বছর পর ডাক আসলো ২০০৭ সালে – আবার শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে, দুটো টেস্ট খেলে এবারে চিরতরে বাদ।
হ্যাঁ, এই ৫ টেস্টের ১০ ইনিংসে তুষার ইমরান ভালো খেলতে পারেনি – সর্বোচ্চ রান ২৮, তিনটা ইনিংসেই ছিল ডাক মানে শুন্য। গড় মাত্র নয়। এইটা দেখে বাদ দেয়ার যথার্থ কারণ ছিল ভাবতেই পারেন! কিন্তু, সাথে এই তথ্যগুলোও জানা দরকার, যে তিন সিরিজে বিচ্ছিন্নভাবে সুযোগ পেয়েছে তুষার ইমরান – যে পাঁচ টেস্টের পারফরম্যান্স দেখে তুষার ইমরানকে ছুড়ে ফেলা হয়েছে, তার সব কটিই খেলেছেন অ্যাওয়ে – শ্রীলঙ্কায় ও দক্ষিণ আফ্রিকায়।
হোমে একটা টেস্টেও সুযোগ পায়নি। আরো জানা দরকার – এই পাঁচ টেস্টেই বাংলাদেশ হেরেছে ইনিংস ব্যবধানে, বাংলাদেশ দল বেশিরভাগ ইনিংসেই প্রতিপক্ষের বোলিং তোপে পড়েছে, মাত্র দুবার দুশ রান পার করতে পেরেছে, ১০০ এর নিচেও ইনিংস আছে একটা, দেড়শোর কমে প্যাকেট ইনিংস আছে কয়েকটা। কোন ইনিংসেই বাংলাদেশের হয়ে দুজন ব্যাটার ফিফটি করতে পারেনি, ১০ ইনিংসে ফিফটির সংখ্যা মোটে ছয়টা। একজন নতুন খেলোয়াড়কে যাচাই করার জন্যে- যথেষ্ট সুযোগ বলা যাবে কি? কঠিন কন্ডিশনে, শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সামনে ঠেলে দিয়ে ১-২ ম্যাচের পারফর্মেন্স দেখে যাচাই করার ক্রাইটেরিয়াটা কি সঠিক? যৌক্তিক?
বলতে পারেন – তুষার ইমরানকে ৪১ ওয়ানডে ম্যাচে তো সুযোগ দেয়া হয়েছে! তুষার ইমরান, নাঈম ইসলাম, এখন মোসাদ্দেক কয়টা ওয়ানডেতে সুযোগ পেয়েছে/ পাবে – এইটা আমি গুনিই না (উল্টা সমালোচনা করি, প্রশ্ন তুলি- এদেরকে কেন ওয়ানডেতে খেলানো হইচ্ছে!)।
তুষার ইমরানের ফার্স্ট ক্লাস রেকর্ড আর লিস্ট এ রেকর্ড পাশাপাশি রাখলে তফাতটা ভালো বুঝতে পারবেন। ফার্স্ট ক্লাসে ৩২ সেঞ্চুরি, ৬৩ ফিফটি- গড় ৪৩+, সেইখানে লিস্ট ‘এ‘ ম্যাচে সেঞ্চুরি ১, ৩০ ফিফটি, গড় ২৮ এরও নিচে। ফলে, বুঝতেই পারছেন- তুষার ইমরানের শক্তির জায়গা কোনটা? আপনি ফার্স্ট ক্লাসে প্রচুর রান দেখে তাকে জাতীয় দলে নিতেছেন, ঐ সময়ে খেলা আছে ওয়ানডে, তাই তাকে ওয়ানডে দলে নিলেন, ওয়ানডেতে ভালো করতে পারলো না – ফলে পরে যখন টেস্ট সিরিজ আসলো, ওয়ানডেতে খারাপ খেলার শাস্তি দিলেন টেস্ট স্কোয়াড থেকে বাদ দিয়ে।
পরের বছর আবার ফার্স্ট ক্লাসের পারফরম্যান্স দেখে জাতীয় দলে নিলেন – ওয়ানডে খেলালেন, কিন্তু আবার টেস্ট থেকে বাদ। এই কাজটাই হইছে- ঐ ৫-৬ বছরে। অদ্ভুত স্যাপার। এবার যেটা নাজমুল হোসেন শান্তকে নিয়ে হয়েছে। নাজমুল হোসেন শান্ত বিপিএল এ সর্বোচ্চ রান করলো, সর্বোচ্চ ছক্কা মারলো, সর্বোচ্চ স্ট্রাইক রেটে রান করলো। আপনি জাতীয় দলে ডেকে ওয়ানডেতে খেলালেন, ওয়ানডেতে ফ্লপ করায় ছুড়ে ফেলে দিলেন।
তারপরে টি-টোয়েন্টি আসলো – বিপিএলের পারফর্মেন্স ভুলে গেলেন – ইমিডিয়েট আগের ওয়ানডে পারফর্মেন্স দিয়ে বিচার কইরা তাকে টি-টোয়েন্টিতেও রাখলেন না (বদলি যারা খেললো, তাদের ব্যর্থতায় আবার শেষ ম্যাচে নামাইয়া দিলেন, চাপের পাহাড়-পর্বত মাথায় দিয়া কইলেন, যা বেটা পারফর্ম কর)!
এই ‘অকাজ’টাই নির্বাচকরা করছেন, টিম ম্যানেজমেন্ট সায় দিচ্ছে। কোন খেলোয়াড় কোথায় ফিট সেটা তারা বুঝতে চান না। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এক ফরম্যাটের সাথে আরেক ফরম্যাটের বিরাট পার্থক্য। সৌম্য সরকার সাব্বির রহমান, মোহাম্মদ মিঠুনকে নিয়েও একই কাজ হয়েছে।
আবার তুষার ইমরানে ফিরি। ঘরোয়া ক্রিকেটে তুষার ইমরানের পিক টাইম এসেছে তো ২০০৭ সালেরও পরে। ২০১০-১২ থেকে ঘরোয়া ফার্স্ট ক্লাসে টপ রান স্কোরার হওয়া শুরু করেছেন। রান মেশিন- সেঞ্চুরি মেশিন হয়েছেন। কিন্তু আপনার মাথায় আছে ২০০২-২০০৭ এ পাঁচ টেস্টের পারফর্মেন্স! আপনার মাথায় আছে ৪১ ওয়ানডের পারফর্মেন্স।
আর, তারপরে আপনার মাথায় ঢুকলো – তুষার ইমরানের বয়স তো ২৭-২৮ হয়েছে, প্রায় ৩০ ছুইতেছে, ৩০ পার হয়েছে। বুড়ো হয়ে গেছে, আর কয় বছর খেলবে, ইত্যাদি! ফলে, আর সুযোগই দিলেন না। আর, বলার সময় বলছেন – তাঁকে অনেক সুযোগ দেওয়া হয়েছে, ঘরোয়া ক্রিকেটে কোয়ালিটি উইকেট নাই, কোয়ালিটি বোলার নাই, কোনো লেগি নাই (থাকলেও অবশ্য খেলার সুযোগ পাননা।
সরাসরি আপনি বিদেশের মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বাউন্সি উইকেটে পোলক-এনটিনি-ক্যালিসের মুখে ঠেলে দিবেন, শ্রীলঙ্কার টার্নিং উইকেটে মুরালি – মালিঙ্গাদের মুখে ঠেলে দিয়া এক দুই ম্যাচ দেখেই পারফরম্যান্স বিচার করবেন, দেশের মাটিতে খেলায়া, জিম্বাবুয়ের মত দলের সাথে খেলিয়ে – কনফিডেন্স গ্রো করবার দিবেন না, আর বলবেন মেলা সুযোগ দেয়া হইছে! অদ্ভুত!
একটা প্রোপার ক্রিকেট নেশন হওয়ার জন্যে প্রোপার ক্রিকেট-শিক্ষিত (যারা ক্রিকেট খালি খায় না, ক্রিকেটটা বুঝেও) সমর্থক দরকার, ক্রিকেট-শিক্ষিত সাংবাদিক দরকার! আর, আমাদের বোর্ড, নির্বাচক, টিম ম্যানেজমেন্ট যেভাবে পাবলিক অপিনিয়ন, মিডিয়ার মতামতকে গুরুত্ব দেয়, সেইখানে ক্রিকেট-শিক্ষিত সমর্থক, সাংবাদিক দরকার আরো অনেক বেশি! অথচ এই জায়গাতেই আমরা পিছিয়ে আছি সবচাইতে বেশি!
এটা বোঝা যায়, বাংলাদেশ জিততে না পারলেই, কোন প্লেয়ার আশানুরূপ ভালো খেলতে না পারলেই – গালাগালি, ট্রল শুরু হয়ে যায়, অমুক তমুক প্লেয়ারকে পাবলিক যেভাবে ও যত সহজে বাতিলের খাতায় ফেলতে পারে, কোচিং স্টাফরে ভাগায়া দেয়ার জন্যে যেমনে উঠেপড়ে, সেই তুলনায় ক্রিকেট অবকাঠামো নিয়া, ডমেস্টিকের সমস্যাগুলো নিয়ে কন্টিনিউয়াসলি উচ্চকিত হইতে কমই দেখা যায়! একই ভাবে, নাসির হোসেন, ইমরুল কায়েসকে নিয়ে আমাদের সমর্থকরা- সাংবাদিকরা, তার ছিটেফোটাও তুষার ইমরান, নাঈম ইসলাম, মার্শাল আইয়ুব, জহিরুল ইসলাম অমি, নুরুল হাসান সোহানদের মাপের ক্রিকেটারদের নিয়ে করে না।
উল্টা কেউ কেউ যদি তাদের নিয়ে দুই চারটা আফসোসের কথা বলেও ফলে – উল্টা কেউ কেউ এসে গালমন্দ করেন, কেউ কেউ নির্বাচকদের ডিফেন্ড করেন। এভাবেই চলে যাচ্ছে।